বিশ্বাস অবিশ্বাসের খেলাঘর
পোস্টটি ১৬২৫০ বার পঠিত হয়েছেআদনান ক্লাস নাইনে পড়ে। বন্ধুরা খেলা দেখতে যাওয়ার কথা বলতেই, একটুও না ভেবে রাজী হয়ে গেল আদনান। স্কুলে ড্রেসেই ছুটে গেল সাগরিকা, জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচ চলছে সেখানে। জীবনে প্রথমবারের মতো স্টেডিয়ামে আসাটা দারুণ উপভোগ্য হলো, সাকিবের কল্যাণে। পরদিনও স্কুলের জন্য বের হলো ঠিকই, তবে খুব উত্তেজনা নিয়ে চলে গেল স্টেডিয়ামেই। গতকাল বাংলাদেশের খেলা এত ভালো লেগেছে যে, আজও দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। বন্ধুরা আর কেউ আসেনি, একা এসেছে সে। সেজন্যেই বোধহয় আজকে আর তেমন ভালো লাগল না। একে তো বন্ধুরা নেই, তার উপর বাংলাদেশও আজ যাচ্ছে-তাই খেলেছে। মন খারাপ করে ঘরে ফিরল আদনান।
তৃতীয় দিন আর স্টেডিয়ামে যেতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু দু’দিন স্কুলে না যাওয়ায় কেমন ভয় ধরে গেছে। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করে আবার স্টেডিয়ামেই চলে গেল। এদিনও বাজে গেল খুব। একটা সময় তো স্টেডিয়ামে ঘুমিয়েও পড়েছিল। বাসায় কেউ জানে না, সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে স্টেডিয়াম চলে যাচ্ছে। জানলে আর রক্ষে থাকবে না।
শেষদিন নিউজিল্যান্ডের মাত্র ১৭২ রান দরকার। জিতে যাবে মনে হচ্ছে। আদনানের আর স্টেডিয়ামে যাওয়ার ইচ্ছে হলো না। স্কুলে যেতেও সাহস হচ্ছে না। সে ঠিক করল আজকের দিনটা কাটিয়ে দিয়ে, আগামীকাল স্কুলে গিয়ে বলবে অসুখ করেছিল। কিন্তু রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েই মুকিত স্যারের চোখে পড়ে গেল। ‘কিরে, তুই এখানে কি করছিস?’
‘আম্মুর অসুখ তো, খালার বাসায় খবর দিতে যাচ্ছিলাম।’ ধুম করে যা মনে এল বলে দিল আদনান।
মুকিত স্যার তাকে খপ করে ধরে ফেললেন, ‘চল, তোর বাসায় চল।’
বাসায় তো যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। যে ঝড়ে সবচেয়ে বেশী লন্ডভন্ড হলো আদনানই। আম্মা বকলেন, মুকিত স্যার বকার সাথে দিলেন উত্তম-মধ্যমও। সন্ধ্যায় আব্বা ফিরলে তিনিও আদনানের পিঠের চামড়ার পরীক্ষা নিলেন। সবচেয়ে বেশী কষ্ট হলো, মেজো মামার কথায়। ‘আপা, ওকে এখন থেকে স্কুলে নিয়ে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখে আসবেন। যাতে কোথাও পালাতে না পারে।’ লজ্জায়, অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে হলো আদনানের।
প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে জেরার মুখোমুখি হতে হয়। হুটহাট কেউ না কেউ স্কুলে চলে যায়, দেখে সে আছে কি-না স্কুলে। এসবে কি যে যন্ত্রণা হয় আদনানের! সে ঠিক করে, এই ঢের শিক্ষা হয়েছে। অবিশ্বাসের যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না, বড় কষ্ট লাগে!
এবার যদি তার উপর বিশ্বাস ফিরে আসে, সে আর কখনো বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না।
*
আমিরের বোলিং দারুণ লাগে আদনানের। প্রায় তার মতোই বয়স ছেলেটার। কি যে বোলিং করে, মনে হয় যেন প্রতি বলেই উইকেট পাবে! আদনানও মাঠে গেলে চেষ্টা করে অমন বোলিং করার। তার খুব ইচ্ছে সে ‘ডানহাতি’ আমির হবে। ভালোই চলছিল সব। কিন্তু হঠাৎ একদিন কোথা হতে এক ঝড় এসে যেন সব 'ইচ্ছে' কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমির নামের কিশোর-কিশোর ছেলেটা নাকি ফিক্সিং করেছে! ওইটুকুন ছেলে? কিভাবে সম্ভব?
আদনানের মনে পড়ে ছোটো মামার কথা। মামা বলতেন, ‘ক্রিকেটে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি জানিস? আজহারের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের তৃতীয় স্ট্যাম্প থেকে ফ্লিক করে মিড উইকেট দিয়ে চার মারা! পেলব কব্জীর মোচড় কত সুখকর যে হতে পারে!’ কেমন ‘আহ’ একটা শব্দ করতেন ছোটো মামা। হঠাৎ একদিন সেই ছোটো মামা বাচ্চাদের মতো ভেউ ভেউ করে কান্না করে দিয়েছিলেন। তখন না-বুঝলেও, আদনান পরে বুঝেছিল, ছোটো মামার খুব প্রিয় ব্যাটসম্যান ছিলেন আজহারউদ্দীন। আজহারউদ্দীনের পদস্খলন শুনে মনে হয় সবচেয়ে বেশী ব্যথা তিনিই পেয়েছিলেন।
ক্রনিয়েকেও খুব পছন্দ করতেন ছোটো মামা। একবার আব্বার সাথে ছোটো মামা যা একচোট ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন! আব্বার কাছে সেরা অধিনায়ক ছিলেন, মার্ক টেলর। ওদিকে ছোটো মামা বলতেন, ‘নর্থ-সাউথ অর ইস্ট-ওয়েস্ট ক্রনিয়ে ইজ দ্য বেস্ট।’ ক্রনিয়ের খবরটা তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি। বলেছিলেন, ‘বুঝলি বিরাট একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। দক্ষিন আফ্রিকার সাথে খেলায় পেরে উঠা যাচ্ছে না তো, তাই কূটকাচালি করে ওদের রুখে দেয়ার চেষ্টা চলছে। পারবে না, দেখিস!’ আদনানের স্পষ্ট মনে পড়ে ক্রনিয়ে যেদিন স্বীকারোক্তি দিয়েছিল, সেদিন থেকে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন ছোটো মামা। যে মানুষটা সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতেন, গল্প বললেও ক্রিকেট, খেতে গেলেও ক্রিকেট, ঘুমাতে গেলেও ক্রিকেট করতেন, সেই তাঁর কাছেই ক্রিকেটটা কেমন পানসে হয়ে গিয়েছিল। ছোটো মামা দেশের বাইরে গেছেন বহুদিন, ক্রিকেট-টিকেট এখন আর দেখেন কি না কে জানে!
হঠাৎ এই এতদিন পর আদনান যেন ছোটো মামার ব্যথাটা ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে পারল। কত গভীর বিশ্বাস আর ভালোবাসা নিয়ে যে মানুষ খেলাটা দেখে! সেই বিশ্বাস আর ভালোবাসার সাথে প্রতারণা কেন?
আদনান কিছুতেই ক্রিকেট থেকে বিশ্বাস হারাতে চায় না। আদনান তার ছোটো মামার মতো হতে চায় না। অবিশ্বাসের যন্ত্রণা বড় কষ্টের, সে খেলাটাতে বিশ্বাস রাখবেই।
*
সময়ের সাথে অনেক কিছুই বদলাতে দেখেছে আদনান। সে নিজেও অনেকটা বদলেছে। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাও অনেক বদলে গেছে। যত বয়স বাড়ছে তত যেন খেলাটার প্রতি আরো বেশী মুগ্ধ হয়ে পড়ছে সে। তবে ইদানীংকালে খেলাটাকে ঘিরে ফিসফিসানিও অনেক বেড়ে গেছে। সেসব একটুও সহ্য হয় না তার। বিশ্বকাপ ফাইনালকে ঘিরেও প্রশ্ন উঠেছে, সাঙ্গাকারার মতো ক্রিকেট চরিত্রকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না আদনান। ওদিকে আবার আইপিএল, বিপিএলের মতো টুর্নামেন্টগুলোকে তো রীতিমতো অবিশ্বাসের আখড়া বানিয়ে দেয়া হয়েছে। আদনানের ক্রিকেট দেখতে ভালো লাগে। আজে বাজে ব্যাপারগুলোকে একটুও মনে ঠাঁই দিতে ইচ্ছে হয় না তার।
এক সকালে পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে যেন চোখে অন্ধকার দেখল আদনান। আশরাফুল ফিক্সিং করেছে? এই কথাও বিশ্বাস করতে হবে? এই আশরাফুলের হাতেই না, বাংলাদেশ ক্রিকেটের কত রোমাঞ্চকর গদ্য-পদ্য রচিত হয়েছে? আইসিএল ধাক্কায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট, এই আশরাফুলেই না মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল?
অমন শিশুসুলভ সারল্য যার মুখে, তিনি কিভাবে ফিক্সিংয়ের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করবেন? কিছুতেই যেন বিশ্বাস হতে চায় না আদনানের।
আদনানের বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে, আশরাফুল ভুল স্বীকার করেছিলেন। ক্ষমা চেয়েছিলেন। আর আদনান আরো একবার দাঁড়িয়েছিল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কঠিন দোলাচলে!
*
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজিত হচ্ছে। সারা শহরে কেমন উৎসবের আমেজ। নানা রঙে রঙিন হয়েছে, এ-মাথা সে-মাথা, এ-মোড় সে-মোড়। সন্ধ্যার দিকে নগরীতে হাঁটতে ভালোই লাগে আদনানের। বন্ধুদের সাথে তেমনই এক হাঁটার সন্ধ্যায়, একজন বলল, ‘চল নেপালের বিপক্ষে ম্যাচটা স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখে আসি।’ প্রস্তাবটা খুব মনে ধরল আদনানের। সেই কবে স্কুলে পড়ার সময় স্টেডিয়ামে গিয়েছিল, আর যাওয়া হয়নি। টিকেটের জন্য একজনকে বলে সে বাসার পথ ধরে।
কথা প্রসঙ্গে স্টেডিয়ামে যাওয়ার কথা বলতেই, আম্মা বেঁকে বসলেন। দেশের পরিস্থিতি খারাপ। সুতরাং রাত-বিরেতে অতদূর যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ‘সবাই যাচ্ছে তো’ বলে আদনান অনুমতি আদায়ের চেষ্টা করলেও, আম্মার এক কথা, ‘উঁহু, সবাই যাক। তোমার যাওয়া হবে না।’ সে কথা বন্ধুদের জানাতেই তাঁরা বলে উঠল, ‘আরে ব্যাটা, এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়িস। এখনো মায়ের আঁচল ধরে পড়ে থাকলে হবে?’
যত যা-ই হোক সে যেতে পারবে না। বন্ধুরা বিকল্প প্রস্তাব দিল, তুই আন্টিকে বলবি যে, আমাদের কারো বাসায় আছিস। মিথ্যা? নাহ, সেটা একদমই করা যাবে না। অবিশ্বাসের যন্ত্রণা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সে। এই বয়সে এসে আবার অবিশ্বাসের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে পারবে না। মাঠে গিয়ে খেলা আরো অনেক দেখা যাবে। কিন্তু একবার বিশ্বাস হারালে তা কি সহজে ফিরে পাওয়া যায়?
*
আদনানের ক্রিকেট দেখতেই ভালো লাগে, সে যা-ই হোক। পাড়ার ক্রিকেট যেমন আগ্রহ নিয়ে দেখে, তেমনি আগ্রহ পায় টিভির ক্রিকেটেও। ঘরোয়া নাকি আন্তর্জাতিক, সাদা বল নাকি লাল বল, সেসবের চেয়েও তার কাছে প্রাধান্য পায় ক্রিকেট খেলাটাই।
কোনদিকে যে আইপিএলের দশটা বছর হয়ে গেল, যেন টেরই পায়নি আদনান। একটু চোখ বুজলেই যেন প্রথম আইপিএলটা স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পায় সে। ব্যস্ততা বেড়ে গেছে বলে, আগের মতো পুরো টুর্নামেন্ট, ম্যাচ বাই ম্যাচ সেভাবে দেখতে পারে না সে। তবে এখনো সময় পেলে আগ্রহ নিয়ে আইপিএল দেখে।
দারুণ উত্তেজনা নিয়ে আইপিএলের একটি ম্যাচ দেখছিল আদনান। ছোটো বোনটা হঠাৎ বলে উঠল, ‘ভাইয়া এসব পাতানো খেলা দেখিস কেন বলতো? কোন লাভ আছে?’ মুহূর্তেই পেটের ভেতর যেন একটা পাক দিয়ে উঠল আদনানের। সে শুনেছে মানুষের ফিসফিসানি, প্রমাণও আছে অনেকের কাছে। কিন্তু কখনোই কান দেয়নি সেসবে। আজ হঠাৎ ঘরেও সেসব শুনতে পেয়ে কেমন একটা হয়ে যায় সে!
*
ক্রিকেটের প্রতি মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। কি ভয়ংকর! অথচ যখন আইপিএলের সূচনা হচ্ছিল, তখন শোনা গিয়েছিল এই ধরণের টুর্নামেন্ট মানুষকে ক্রিকেটের প্রতি আরো আগ্রহী করে তুলবে। এই কি আগ্রহের নমুনা?
ক্রিকেট নিয়ন্ত্রকরা কি বুঝতে পারছেন না, খেলাটার মধ্যে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে একটা শুদ্ধি অভিযান চালানো প্রয়োজন? নাকি তাঁরাও এটাকে গুজব বলে মানছেন? আচ্ছা ক্রিকেট-নিয়ন্ত্রকরাও তার মতো, মুখ গুজে চোখ বুজে, বিশ্বাস-বিশ্বাস বড়ি গেলার চেষ্টা করছেন না তো? কি যে হচ্ছে, কে জানে!
আদনানের কেমন যেন লাগে! সে ভাবতেই চায় না, মানুষ ক্রিকেট থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। রেসলিং দেখার মতো মানুষ ক্রিকেট দেখবে ঠিকই, তবে জানবে সেসব সাজানো। না, ক্রিকেটের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। কেন একটা নো বল, একটা ক্যাচ মিস, একজনের বাজে বোলিং, একজনের বাজে ব্যাটিং... সবকিছুকে দেখা হবে সন্দেহের আতশি কাঁচের নীচে? ক্রিকেটের অনিশ্চিত সৌন্দর্য্যগুলো কেন এমন সংশয়ের আবর্তে পাক খেয়ে মরবে?
ক্রিকেটের প্রতি বিশ্বাস, খেলাটার প্রতি আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার আগেই কিছু একটা করা দরকার। খুব দরকার।
কিছু একটা করার তাগিদে দরদর করে ঘামতে থাকে আদনান।
- 0 মন্তব্য