• ক্রিকেট

'২' এর দ্যোতনা

পোস্টটি ১৪৭২৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

"কী পাইনি তারই হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি"- রবীন্দ্রনাথের কথাটার যথার্থতা যাচাই করতে এই লেখার সূত্রপাত।

এশিয়া কাপ ফাইনাল। পাকিস্তান। ২ রান। এই কয়টি শব্দই আমাদের স্মৃতির তারে করুণ রাগিণী তুলতে যথেষ্ট। ৫ বছর আগের এক ক্রিকেট ম্যাচের কারণে কীভাবে ১১ জনের চোখের পানি ১৬ কোটি বাঙালি ভাগাভাগি করে নিয়েছিলো তা ভুলার নয়।

কী হয়েছিলো সেইদিন? এককথায় যদি বলতে হয়- স্বপ্নভঙ্গ। প্রথমবারের একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে, যেখানে খেলেছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মত সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পরাশক্তিরা- তাতে আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছিলাম। বাংলাদেশ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছিলো!

হয়নি সেদিন, মাত্র ২ রানের জন্য হয়নি। আইজাজ চিমার করা শেষ ৬ বলে ৯ রান পাওয়া হয়নি আমাদের। মাহমুদুল্লাহর হতভম্ব হয়ে পিচে মাথা ঝুলিয়ে বসে পড়া, আনামুলের অঝোর কান্না, তামিমের নির্বাক দৃষ্টি এবং ক্রন্দনরত সাকিবের বুকে অধিনায়ক মুশফিকের চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা এখনো ক্রিকেটপ্রেমী বাংলাদেশিদের জন্য হয়তোবা সবচেয়ে বেদনাবিধুর ছবি।

"কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!"- জীবনানন্দের বিরোধিতা করছি না, স্রেফ ক্রিকেটীয় যুক্তিতে একটু ফিরে দেখার চেষ্টা করি কেন ম্যাচটি সেইদিন আমাদের হয়নি।

একটা ফাইনাল ম্যাচের ফলাফল যখন শেষ বলে নির্ধারিত হয় তখন স্বভাবতই ম্যাচের বাকি ২৯৯ বলের হিসাবনিকাশ করার অবকাশ পাওয়া যায়না। কিন্তু নিশ্চয়ই কিছু টার্নিং পয়েন্ট থাকে যেগুলো পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকা এরকম একটা ম্যাচের ফলাফলে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

টসজয়ী বাংলাদেশের বোলিং ও ফিল্ডিং এর এরকম কয়েকটি মুহূর্তের উপর আলোকপাত করা যাক।

প্রথমত, ৭ রানে মোহাম্মদ হাফিজের ক্যাচ ড্রপ করেন জহুরুল ইসলাম- যেই ইনিংস পরবর্তীতে ৪০ রানে শেষ হয়।
দ্বিতীয়ত, শাহাদাত হোসেনের অমিতব্যয়ী বোলিং- বিশেষ করে শেষ ওভারে তার দেওয়া ১৯ রানই যে পাকিস্তানকে উইনিং স্কোর তৈরি করতে সাহায্য করেছে তা বলাই বাহুল্য।
তৃতীয়ত, শহীদ আফ্রিদি নামক ক্রিকেটীয় 'হ্যালির ধূমকেতুর' আবির্ভাব- ২২ বলে ৩২ রানের ঝড়ো, ছোট, কিন্তু কার্যকরী ইনিংস।
চতুর্থত, সরফরাজ আহমেদের অপরাজিত ৪৬ রান- যেটা কি না ২৬ রানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো, হয়নি নাজিমউদ্দিনের পিচ্ছিল হাতের কারণে।

এরমধ্যেই শেষ হয় পাকিস্তানের ৮ উইকেটে ২৩৪ রানের ইনিংস- ঐ টুর্নামেন্টেই ভারতের বিপক্ষে ২৮৯ ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২৩৪ রান ৫ উইকেটে অতিক্রম করা দলের জন্য আপাতদৃষ্টিতে যেটা খুব একটা অনতিক্রম্য বলে মনে হচ্ছিলো না। কেন অতিক্রম করা হলো না? এবার সেদিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।

প্রথমত, ওপেনিং এ নামা নাজিমউদ্দিনের ৫২ বলে ১৬ রান আর টু-ডাউনে নামা নাসিরের ৬৩ বলে ২৮ রানের দুইটি শম্বুকগতির ইনিংস- শিশিরভেজা উইকেটে পাকিস্তানের নিরীহদর্শন বোলিং এর সামনে যেটা নিতান্তই অব্যাখ্যনীয়।
দ্বিতীয়ত, সাকিব আল হাসানের ৭২ বলে ৬৮ রানের ঝকঝকে ইনিংসের অপরিপক্ক সমাপ্তি- ৩৯ বলে বাকি ৫৬ রান সংগ্রহের জন্য তার মত সেট ব্যাটসম্যানের প্যাভিলিয়নে ফিরে আসা নিশ্চিতভাবেই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়।
তৃতীয়ত, আবারও আফ্রিদি- ১০ ওভারে ২৮ রান দিয়ে ও ১ উইকেট নিয়ে যিনি ঐদিন বাংলাদেশের রানের চাকা শ্লথ করে দেন।
চতুর্থত, শেষ ওভারে মাহমুদুল্লাহর স্ট্রাইক অদলবদলে একটু ভুল- শেষ ওভারের মহামূল্যবান শেষ ৩ বলে ৭ রান যখন প্রয়োজন তখন শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের স্ট্রাইক ধরে রাখতে পারলে হয়তো গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো।
143877.3

অপ্রাপ্তির খেরোখাতা বন্ধ। এবার প্রাপ্তিযোগের গল্প।

অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন এই ম্যাচেরও আবার প্রাপ্তি?

ক্রিকেট বাংলাদেশের জন্য কী, বাংলাদেশিদের কাছে কী- সেটা এই ম্যাচ ও ম্যাচ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বে দেখিয়ে দিয়েছে। যেই দলটাকে ভাবা হয়েছিলো টুর্নামেন্টে আন্ডারডগ, যারা বাঘের থাবায় চমকে দিয়েছিলো গোটা ক্রিকেট দুনিয়া, তারা কী শুধুই রানার্স আপ হয়েছিলো সেইদিন?

মোটেও না। বরং কীভাবে ফিনিক্স পাখির মত ছাইভস্ম থেকে পুনরুজ্জীবিত হওয়া যায়, কীভাবে শোক কে শক্তিতে পরিণত করতে হয়- তা এর পরবর্তী ৫ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল দেখিয়ে দিয়েছে। জিম্বাবুয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সাফল্য তো আগেই ছিলো, ২০১২ পরবর্তী বাংলাদেশ ভারত, সাউথ আফ্রিকা, পাকিস্তানকে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছে, বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে, শ্রীলঙ্কা ও র‍্যাঙ্কিং এ ১ এ থাকা ইংল্যান্ডকে টেস্ট ম্যাচে হারিয়েছে- ভাবা যায়! হোম-অ্যাওয়ে-প্রতিপক্ষ নির্বিশেষে বাংলাদেশ এখন প্রতিটা ম্যাচ জেতার জন্য খেলতে নামে- এই আপ্তবাক্য আগে কেবল আমরা বিশ্বাস করতাম, এখন প্রতিপক্ষও বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।

আসছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। গ্রুপ পর্বেই বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের। একটা সময়ে হয়তো আমরা এই ধরণের প্রতিপক্ষ দেখে অংশগ্রহণ করেই খুশি থাকতাম- কিন্তু আজকে এই ২০১৭ তে এসে উন্নতির গ্রাফে নিজেদের এতটাই উপরে নিয়ে গেছে বাংলার টাইগারেরা যে তারা জয়ের বিকল্প কিছু ভাবে না।

এটা সংবাদ সম্মেলনে মুখরক্ষার জন্যে নয়, এটা আত্মবিশ্বাস থেকে বলা এবং আমার মতে আত্মবিশ্বাসের এই বীজ বপন হয়েছিলো ৫ বছর আগের সেইদিন সেই মিরপুরে, যা ১৬ কোটি মানুষের অশ্রুসিক্ত ভালোবাসায় আজ সাফল্যের ফুলফোটানো বৃক্ষে পরিণত হয়েছে।

শেষ করছি ঐ ম্যাচের পর নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসের একটা অংশ উদ্ধৃত করেঃ

"১১ মার্চের আগে কেউ যদি বলতো বাংলাদেশ এশিয়া কাপ থেকে মাত্র ২ রানের দূরত্বে থাকবে তখন তার পক্ষে বাজী ধরার লোক হাজারে একজনও খুঁজে পাওয়া যেত কী না সন্দেহ। আজকের এই পরাজয় কষ্টের, তবে লজ্জার নয়। এই দল গত ১২ দিন পুরো জাতিকে যা দিয়েছে তার জন্য তাদেরকে স্যালুট করা উচিত। নিশ্চিতভাবে হাজারো প্রতিকুলতার এই দেশে ক্রিকেটারদের চেয়ে বড় কোন আনন্দের ফেরিওয়ালা নেই।"