• ক্রিকেট

কোথায় সেই ঝাঁজ, সেই তেজ? কোথায় সেই মহারণ আমেজ?

পোস্টটি ৪২৭৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

১.

ক্রিকেটের সাথে প্রেমটা তখন সবে জমে উঠছে। আমি আর বন্ধু তারেক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ক্রিকেট দেখি, পুরনো পত্রিকা ঘেঁটে স্কোর দেখি, ক্রিকেট নিয়ে কথা বলি, আব্বুর কাছে গল্প শুনি... বুঝতেই পারিনি এই করতে করতেই কখন ক্রিকেট নামের পোকাটা আমাদের শরীরে ধীরে সুস্থে বাসা বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে!

ওয়াসিম আকরামের একটা বল তখন আমাদের কাছে একরকম ধোঁয়াশা। কেমন স্ট্যাম্পের থেকে বেরিয়ে যায়, আর ব্যাটসম্যানরা তাতেই খোঁচা দিয়ে ধরা পড়েন প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্লিপে। কখনো আবার উইকেট রক্ষকের বিশ্বস্ত হাতে। তারেককে এক সময় প্রশ্ন করে খুব অস্থির করে তুলেছিলাম, ‘আচ্ছা ওয়াসিম ওই বলটা দেয় না কেন? তাহলেই তো উইকেট পড়ে!’ তারেক বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বলেছিল, ‘ওই বলটা এখন সবাই বুঝে গেছে রে। দিয়ে আর লাভ হয় না।’

পরে বুঝেছিলাম, ওই ধোঁয়াশাপূর্ণ ডেলিভারীকে আউট সুইং বলে! যে সুইংয়ে ওয়াসিম আকরাম ছিলেন মহা ওস্তাদ পর্যায়ের।

 

২.

সুইংয়ে ওস্তাদ ছিলেন ওয়াকার ইউনিসও। গতির রাজা ছিলেন শোয়েব আকতার। ওদিকে ব্যাটিং শিল্পের সমস্ত কারুকাজ যেন শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড়, লক্ষনদের ব্যাটিংয়ে। উন্নত ব্যাটিংয়ের বিপক্ষে উন্নত ফাস্ট বোলিং, কি এক লড়াই!

বিশুদ্ধ রক্ষণ, দৃষ্টিনন্দন আক্রমণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে সুইং-গতির নিরঙ্কুশ আগ্রাসন, যেন সেয়ানে-সেয়ানে লড়াই। এই পুল বা হুক হলো তো, পরের বলই কানশিরায় বাতাস লাগিয়ে যেন বুকে ধরিয়ে দিল কাঁপন। সুইংয়ে পরাস্ত হয়ে পরের বলেই হয়তো চোখধাঁধানো কাভার ড্রাইভে বলের ঠিকানা হলো, সীমানা দড়ির ওপার। যেন কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান। রক্তচক্ষুর চোখাচোখি, নীরব আগ্রাসনে একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা, বোলারের জন্য অপমানকর ডাউন দ্য উইকেটের জবাবে ব্যাটসম্যানের আত্মারাম খাঁচাছাড়া বোলিং। কি ছিল না তখন?

বিশ্বমানের বোলিংয়ের বিপরীতে বিশ্বমানের ব্যাটিং, পাকিস্তানি বোলিং বনাম ভারতীয় ব্যাটিং। ক্রিকেটে যেন দেখার মতো এর চেয়ে সুখদৃশ্য খুব কমই আছে!

 

৩.

দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে শুয়ে ম্যাচ দেখছি। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বসতে হলো। সৌরভ গাঙ্গুলি ব্যাট-ট্যাট ফেলে দিয়ে পাঁজর চেপে ধরে কাতরাচ্ছেন। ওহ, সে কী দৃশ্য! শোয়েব আকতারের সে কী আগ্রাসন!

82658

                                 শিকারের পর যেন ছাড়তেন সত্যিকারের হুংকার।

 

সীমানা দড়ির কয়েক গজ সামনে থেকে একজন ফাস্ট বোলার ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ছুটে আসছেন, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারছেন বল নামের চর্মগোলক, ব্যাটসম্যান তাঁকে দেখে কি কাঁপছেন? মেজো মামা বলেছিলেন সেই ঘটনার পর থেকে নাকি শোয়েবকে দেখলেই পা কাঁপত সৌরভের। কতটুকু সত্যি কে জানে! তবে ফয়সালাবাদ টেস্টে শোয়েবের বলে শচীনের পা কাঁপুনির খবর পড়েছিলাম, একজন সাংবাদিকের লেখায়।

ইডেনের সেই টেস্টের কথা মনে আছে নিশ্চয়? গ্যালারীর কান ফাটানো গর্জন সঙ্গী করে টেন্ডুলকার এলেন, আর পরের বলেই শোয়েবের বিদ্যুৎ গতির বলে ছত্রখান হলো স্ট্যাম্প। মুহূর্তেই নন্দনকাননের গ্যালারীতে যেন নেমে এলো শ্মশ্মানের নীরবতা!

 

৪.

প্রখর রৌদ্রতপ্ত দিনে ফাস্ট বোলিংয়ের যে তেজ তা বুঝি হার মানাবে তেজস্বী সূর্যকেও, অন্যদিকে রোদের উত্তাপের চেয়েও ব্যাটিংয়ের ঝাঁজেই হয়তো বেশী পুড়তে হবে বোলারকে!

ক্রিকেট পুরাণের অংশ হয়ে যাওয়া সেঞ্চুরীয়নের সেই বিকেল কি কখনো ভোলা যায়? শচীন টেন্ডুলকারের ৭৫ বলে ৯৮ রানের যে ইনিংসটা অনেক সেঞ্চুরীর চেয়েও বেশী মর্যাদা পেয়েছে। যেদিন ওয়াসিম-ওয়াকার-শোয়েব-আব্দুল রাজ্জাকদের সমন্বয়ে গঠিত পেস-চতুষ্টেয়কে স্রেফ তুলোধুনো করেছিলেন, শচীন টেন্ডুলকার। কিংবা শেওয়াগের মুলতানের সেই ট্রীপল, রাওয়ালপিন্ডিতে দ্রাবিড়ের ২৭০ বা সৌরভের এডিলেইডের সেই ১৪১। সমৃদ্ধ পেস আক্রমণকে কচুকাঁটা করা কি সব রাজসিক ইনিংস!

93278

                                  সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত আপার কাট!

 

প্রভাবশালী বোলিং ইউনিটের বিপক্ষে প্রতাপশালী ব্যাটিং ইউনিটের এক ধ্রুপদী লড়াই। যা ক্রিকেটের শিল্প-রসে টইটম্বুর, উত্তেজনা আর উন্মাদনায় এক অদ্ভুত আনন্দের আধার। যেন মেলে ধরা রোমাঞ্চ আর নান্দনিকতার এক মোহনীয় পসরা।

 

৫.

ইনজামামের পাকিস্তান আবার কিছুটা ব্যাটিং নির্ভর ছিল। করাচীর সেই ৬৯৩ রানের ক্ল্যাশ, এখনও যেন রোমাঞ্চ জাগায়! আমাদের কৈশোরের আড্ডায় ভালোই জায়গা করে নিয়েছিল ম্যাচটা। নেহরার অনবদ্য শেষ ওভার, ফর্মহীন মঈন খানের নির্বিষ ব্যাটিং, রানা নাভিদের নো বল, শেওয়াগের বেধড়ক পিটুনী, অলস-সৌন্দর্য্যের ইনজি, আলোচনার জন্য কত কি!

তখনও পাকিস্তান-ভারত ম্যাচে ঝাঁজ-তেজ ভালোই ছিল। ওয়াসিম-ওয়াকার ছিলেন না তো কি হয়েছে, শোয়েব-সামি তো ছিলেন। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের সাথে পাকিস্তানের বোলিং, লড়াইটা খুব একটা খারাপ জমত না।

কিন্তু সময়ের সাথে ধীরে ধীরে সেই ধ্রুপদী লড়াইয়ের উত্তাপ এখন অনেকটাই জুড়িয়ে গেছে।

একটা কারণ হতে পারে, ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপে শচীন-শেওয়াগদের উত্তরাধিকার থাকলেও, পাকিস্তানি বোলিং আক্রমণে নেই ওয়াসিম-ওয়াকারদের উত্তরসূরী। ফাস্ট বোলিংয়ের সুদক্ষ কুশীলব ছাড়া পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ভারতের ব্যাটিংয়ের লড়াইটা জমে কি করে?

 

৬.

বছর খানেক আগে, আমাদের মিরপুরে কিন্তু লড়াইটা কিছুক্ষণের জন্যে ভালোই জমে উঠেছিল। ঘিরে ধরেছিল নাইন্টিজ নস্টালজিকতাও।

মোহাম্মদ আমিরের টো-ক্রাশিং ইয়র্কার সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন রোহিত-রাহানে। মিরপুরের সবুজ গালিচায় তখন আমির মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁর পূর্বসূরীদের। গতি, সুইং, বাউন্সে নাকাল করে দিচ্ছেন ভারতের দুর্দান্ত ব্যাটিং লাইনআপকে। আর তার কিছুক্ষণ পর, বিরাট কোহলি বুঝি ভাবলেন, অনেক হয়েছে। এবার ভারতের ব্যাটিং-গ্রেটদেরও একটু মনে করিয়ে দরকার। ফ্লিকের পর রাজকীয় এক কাভার ড্রাইভে মঞ্চে প্রবেশ করে, কোহলি যেন জানিয়ে দিলেন, এই মঞ্চে এরপর আর একচ্ছত্র গতির আধিপত্য চলবে না।

 

৭.

এই পৃথিবীতে বিনোদনের অভাব নেই, ক্রিকেট মাঠেও নেই আনন্দের কোন খামতি। তবে শক্তিশালী বোলিংয়ের বিরুদ্ধে জবরদস্ত ব্যাটিং দেখার একটা পরিতৃপ্তি আছে, সাথে পরিপার্শ্বিক পরিবেশ, চাপান-উতোর, উত্তেজনা। সব মিলিয়ে একজন পাঁড় ক্রিকেটভক্তের কাছে ক্রিকেট মাঠে ব্যাট-বলের ঠোকাঠুকিতে পাক-ভারত মহারণ, যেন বিশেষ সুখানুভূতি সৃষ্টি করে।

আমাদের শৈশব-কৈশোরের সেই পাকিস্তান-ভারত চির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ-তেজ নেই বহুদিন। পাক-ভারত মহারণের যে মহাকাব্যিক জৌলুস ছিল, তা-ও যেন অনুপস্থিত। দেশ-কাল-সমাজ, পরিবেশ-পরিস্থিতি, ভৌগলিক রাজনীতি বিবেচনায় পাকিস্তান-ভারত ম্যাচ একটা আলাদা আলোচনার দাবী রাখে বটে, তবে সেই উত্তাপ-আমেজ কই?

কোথায় সেই গতি-সুইংয়ের সাথে ব্যাটিং শিল্পের নান্দনিক লড়াইয়ের শিহরণ? কোথায় সেই মহা উত্তাপের রোমাঞ্চ জাগানিয়া মহারণ? কোথায় সেই দুরন্ত এক ম্যাচের আবাহন?