বৃহস্পতিবারেরা
পোস্টটি ১৩৬৮৭ বার পঠিত হয়েছেবৃহস্পতিবারের ইতিকথার আগেরকথা
কেউ আমাকে বলেনি কিভাবে ছয় মারতে হয়,যত দিন না আমি এইটে উঠি।দুধ ভাতের মত ইনিংস শেষ হওয়ার দুই-তিন বল আগে নেমে বিপক্ষের ক্যাচিং অদক্ষতার উপর ভরসা করে বল আকাশে তুলে দিয়ে দৌড় দিতাম।জীবন আমাকে শেখাল কিভাবে ব্যাট ঘোরালে বল একবারে পুলসিরাত পার হয়ে যায়।
কেউ আমাকে বলেনি '৭১-এর ২৫শে মার্চ কি বার ছিল।যখন সেটা জানতে পারলাম, ২২ মার্চের এশিয়া কাপ'১২ এর ফাইনাল তখন কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে।সেদিন বৃহস্পতিবার, ফাইনালটাও হচ্ছিল বৃহস্পতিবার।পক্ষ-প্রতিপক্ষও সেই একই- বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান।জানি এটা স্রেফ একটা খেলাই কিন্তু রাজনীতির খানিক অধঃক্ষেপ তো পড়ে থাকেই।তাই ২৫ শে মার্চ রাতের কথা মনে হয়।সে রাত দেখিনি, প্রত্যক্ষদর্শী কার কথায় সে রাতে নিজেকে নিয়ে গিয়ে ঢাকা শহরের পথে-পথে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও মেলেনি।কেন জানি রাস্তায় নিজের রিকশায় ঘুমান নিশ্চিন্ত রিকশাচালকের বুক মুহুর্তে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া চোখে ভাসে।কেন জানি ভাসে।মনে হয় এই ফাইনালটা জিতলে ওদেরকে দেখিয়ে দেব আরেকবার।
এত কাছে তবু এত দূরে
কারণ মায়ের পেট থেকে মাটিতে পড়ে শুধু দেখেছি ওদের সাথে হারতে।সবদিক দিয়ে।ওরা আমাদের জন্মের উদ্দেশ্যকেই স্লো পয়জনিংয়ে পাল্টে দিয়ে ওদের হাতের পুতুল বানিয়ে তুলেছে।শুধু একবার আমরা পেরেছিলাম।ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে।ওই প্রথমবার ছোট্ট আমি শুনেছিলাম পাড়ায় পাকিস্তান ভিন্ন অন্যকোন ক্রিকেট দলের নামে রাত একটায় স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল।ওই প্রথম,ওই শেষ।এরপর শুধু এত কাছে তবু এত দূরে-
এতদিনে একটা মোক্ষম সুযোগ যেন পাওয়া গেল ওদেরকে দেখিয়ে দেবার।বাংলাদেশ আছে ইতিহাসের চরমতম ছন্দে।বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত, তারপর শ্রীলংকাকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে এসেছে।অবশ্য গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের কাছে সেই এত কাছে তবু এত দূরে- কি হল মাশরাফির কে জানে।সাকিব এক পাশে শুধু সেট না জীবনের অন্যতম সেরা ফর্মে,৩১ বলে রান লাগে ৩৩,শুধু দাঁড়িয়ে থেকে স্ট্রাইকটা পরিবর্তন করে সাকিবকে দিলেই হয়, তখন হার্ড হিট করতে গিয়ে আউট!এরপর কার সংগ না পেয়ে সাকিবের আত্মহূতি।
মুলতানী মাটির ঘ্রাণ
ফাইনালে টসে জিতে মুশফিকের ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্তটা সঠিক করে তুললো বোলাররা ৭০ রানেই পাকিস্তানের চারজন টপওর্ডারকে প্যাভিলিয়নমুখো করে দিয়ে।সেখান থেকে একশো পেরলো আজম ও উমর আকমলের ব্যাটে।কিন্তু ১৩৩ মধ্যে তাদের চিহ্নও মুছে গেল।থাকল আফ্রিদির পাল্টা আক্রমনে ২২ বলে ৩২ আর সফররাজের বল নষ্ট করে উইকেটে মাথা কুটা।১৭৮ রানে আফ্রিদিকে সাকিব ফেরালে লেজ বের হয়ে গেল পাকিস্তানের।একপাশে একজন রান নিতে সংগ্রাম করছে আর অন্যপাশে লেজ- এ নিয়ে দুইশোর মধ্যে লক্ষ্য পাওয়ার আনন্দে হোস্টেলের কমন রুমে আমি লাফাচ্ছি তখন।
কিন্তু সেখান থেকে ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করল।যে এতক্ষন রান নিতে হাসফাস করছিল, কিসের ছোয়ায় যেন সে হয়ে গেল দলের সবচেয়ে ফ্লুয়েন্ট ব্যাটসম্যান, ব্যাট থেকে বেরলো ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৪৬*!অবশ্য বাংলাদেশের সাথে এমনটাই হয়ে থাকে।
শেষ ওভারে শাহদাত দিল উনিশ রান,নো বল-ফ্রি হিট, মাশরাফির অবিশ্বাস্য থ্রোতে নিশ্চিত রান আউট মিস,ওভারের শেষে রাগান্বিত মুশফিকের মাটিতে ছুড়ে মারা বল।কমনরুমে তখন সবাই রাগ ঝাড়ছে নাজমুলকে না দিয়ে কেন শাহদাতকে বল দিল মুশফিক। তখনই প্রথমবারের মত মনে উঁকি দিল মুলতান, আবার হাতছাড়া হয়ে যাবে না তো?
অতি ‘সাবধানীর’ গলায় দড়ি
জবাব দিতে নেমে তামিম-নাজিমউদ্দিনের শুরুটা হল শম্বুকগতির সাবধানী।শম্বুকের খোলস ছাড়ার চেষ্টা তামিম করলেও নাজিমউদ্দিনের বল নষ্টের মচ্ছব চলতেই থাকল।১৭ ওভারের সময় যখন ইউনুস খানের হাতে বন্দী হল তখন দলের রান মাত্র ৬৮। সেখানেই দ্বিতীয়টা গেল।
যে নাসির সারা টুর্নামেন্ট একশোর কাছাকাছি স্ট্রাইক রেটে রান করে আসল, ফাইনালে সেও বলের পর বল ডট দিয়ে গেল।এখানে অবশ্যই কৃর্তৃত্ব আজমল-হাফিজ-আফ্রিদির নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের।এবং অবশ্যই আরেক কারন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের তূণে স্ট্রাইক বদলের অপ্রতুল শট থাকা।
নাসির যখন আউট হল তখন দরকার ৪৫ বলে ৬৭ রান।২৩৬ মামুলী স্কোর যে এত জটিল অংকে ফেলে দেবে কে জানত!কিন্তু টি-টোয়েন্টির জামানায় এটা কোন ব্যাপার হল।আর একপাশে ক্রমশ স্বরূপে প্রকাশিত ‘এক যে আছে সাকিব’।সাকিব থাকলে এই রান উঠে যাবে।সাথে মুশফিক।কিন্তু দিনটা বৃহস্পতিবার ছিল।তাই বোধহয় হল না।স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড সাকিব, অব্যাহতি পরেই মুশি।ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।
ম্যাশ-ঝড়
মাশরাফির ২০০ স্ট্রাইক রেটের ঝড়ে ম্যাচ আবার বাংলাদেশের উপকূলে।কিন্তু ওখানেই ম্যাচ মোচড় খেল মাশরাফির বিদায়ে।১৪ বলে দরকার ১৯টা রান।
শেষ ওভারের ট্রাজিডি
১৪ বলের প্রথম ৮টা থেকে এল দশ রান।মানে শেষ ওভারে দরকার নয় রান।মাহমুদুল্লাহ স্ট্রাইকে মানে আমি স্ট্রাইকে।ভারতের সাথে একটা সিরিজে ওর স্ট্র্যাটেজী দেখে মনে হয়েছিল যেন আমিই ব্যাট করছি।বল উইকেটের পাশে ফেলেই রান, কভার ড্রাইভ, লেগ গ্লান্সে চার। এককথায় ২০টা বল খেললে ২০ বা ২২ করার মত খেলোয়াড়।
শেষ ওভার করবে আইজাজ চিমার মত নবীন বোলার।সুতরাং সুযোগ আমাদেরই বেশি।প্রথম দুই বলে আসল দুই রান।তিন নম্বর বলে স্লোয়ার মাহমুদুল্লাহ মিস করল।তিন বলে সাত রান চাই।এই বলে একটা চার না হলেই নয়।এইরকম উত্তেজনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট পড়েনি,আমরা পড়িনি।মিড অফে পাঠিয়ে অসম্ভব দুই রান নিয়ে রিয়াদ আবার স্ট্রাইকে।ওই রানের পরই বাই এক রান নেয়ার সুযোগ আসল,নিয়েও নিল।আৎকে উঠলাম হায়রে কি করে!
হয়ত শেষ দুই বলে পাঁচের জায়গায় চার লাগবে এমন ভেবেই।কিন্তু ওইপাশে রাজ্জাকের মত বোলার।আর যদি স্ট্রাইক না পায়!সত্যিই আর পেলনা!এরপরের ছবিগুলো ২৫শে মার্চের বৃহস্পতিবারের মতই টুকরো টুকরো।তার মধ্যে সবসময় মনে বয়ে বেড়ায় মাহমুদুল্লাহর মাথা নুয়ে সবচেয়ে পরাজিত মানুষের মত ফিরে আসা, সাকিবের বুকে মুশফিকের কান্না,সাকিবের সান্ত্বনা দেয়া,নিজের কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টার পর মুখে সব নখ পুরে কান্না।
মাহমুদুল্লাহকে আর দেখলাম না সেদিন।
খেলা শেষের তর্ক এবং শুক্রবারেরা
৬ বলে ৯ রান হবে না।রুমে ফিরে এক চোট হয়ে গেল রুমমেটের সাথে।আগে পরের সবকিছু ক্ষমার যোগ্য।শুধু রিয়াদ এর বাইরে।মাহমুদুল্লাহর নাকি সব দোষ।না মেনে উপায় থাকে না।ওই বাই রানটাই যে ফাইনালের এপিটাফ লিখে দিয়েছে।
সারা রাত নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করলাম- আসলেই রিয়াদের সামর্থ্য নেই,আমার সামর্থ্য নেই।আমরা শুধু চুপিচুপি বেঁচে থাকতে পারি এখানে, আমাদেরকে ঘিরে থাকা স্রোতের ভেতর, যারা চায় বাংলাদেশ জিতুক কিন্তু আফ্রিদি পাঁচ উইকেট পাক!
শুক্রবার সকালে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক আশ্চর্য নৈঃশব্দের মধ্যে।সকালের পত্রিকায় সাকিবের ছবিটা দেখে আবার কাঁদলাম।রাস্তায় নেমে এগলি-সেগলি ঘুরলাম।সবখানেই সেই বিষাদ-নৈঃশব্দ্য লেগে আছে।ঠিক যেমন লেগেছিল ২৫শে মার্চ বৃহস্পতিবারের পরদিন শুক্রবারে।
এ পরাজয় ভোলার নয়।এ দুঃখ ভোলার নয়।
- 0 মন্তব্য