• ফুটবল

এরন রামসিঃ এবং তার অভিশপ্ত গোল।

পোস্টটি ৭৮১৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

05745fb514f660facfa1c896b8acb309

ডিসেম্বর ২৬, ১৯৯০। মার্লেইন এবং ক্যাভিন দম্পতির ঘর আলো জন্ম নেয় যে শিশুপুত্র; তাকে অলক্ষুনে বলার কোনোই কারণ নেই। শিশুরা দেবতুল্য। বছর কয়েক পরে ছেলেটি যখন বড় হতে শিখেছে তখন থেকেই ফুটবলের সাথে তার সখ্য। তারা থাকতো ওয়েলস এর কার্ডিফ শহরে। স্কুলের গৎবাঁধা নিয়ম তার ভালো লাগতো না। কিন্তু দেখা যেত স্পোর্টস উইকে সে ই সবচেয়ে বেশি দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

ছেলেটির খেলার হাতেখড়ি ঘটেছিলো 'Urdd' বা ওয়েলস লীগ অব হোপ' এর মাধ্যমে। কতোই বা বয়স ছিলো তখন তার? মাত্র নয়। ফুটবলের পাশাপাশি সেই ক্ষুদে বালকের রাগবী খেলার প্রতিও ছিলো প্রবল ঝোঁক! সে ঝোঁক অবশ্য বেশিদিন ঠিকলোনা। কার্রডিফের স্থানীয় ক্লাবে যোগ দেয়ার পরপরই মাথা থেকে রাগবির ভূত পালালো। বয়স ভিত্তিক দলে সাফল্যের পর ছেলেটি কার্ডিফ ক্লাবের মেইন দলের হয়ে খেলতে থাকে। ২০০৮ সালে সেখান থেকে ৫ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফি'র বিনিময়ে নিজেদের দলে বেড়ায় আর্সেনাল। প্রিয় পাঠকশ্রোতা এতক্ষনে অবশ্যই বুঝে ফেলেছেন আমি কার কথা বলছি। বলছিলাম বর্তমান ওয়েলস দলের অধিনায়ক 'এরন রামসি'র কথা



বলা হয়ে থাকে, গোলকিপার হিসেবে আপনি যখন এরন রামসি'র একটি শট রুখে দিলেন, ঠিক তখন আপনি একজন সেলেব্রিটির জীবন বাঁচিয়ে দিলেন! এবং শর্ট রুখে দেয়ার পর অসুস্থ সেলিব্রেটিরা খানিকের জন্যে হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন!



শুরুটা ঘটেছিলো ২০০৯ সালে। ২২ আগস্টে পোর্টসমাউথ এর বিপক্ষে আর্সেনালের ম্যাচ দিয়ে। দারুন উজ্জীবিত আর্সেন ওয়েঙ্গার শীর্ষদের কাছে পাত্তাই পায়নি পোর্টসমাউথ। একে একে পোর্টসমাউথের জালে ৪টি গোল জড়ায় আর্সেনাল। স্কোরশিটে নাম তুলেন তরুন ওয়লেশ মিডফিল্ডার এরন রামসি। দলীয় জয় এবং ব্যাক্তিগত গোল; সব মিলিয়ে দারুন মুহুর্তে ছিলেন রামসি। তখন তিনি হয়তো জানতেন ই না কিছু বিশেষজ্ঞ মানুষ তার ক্যারিয়ারের অদ্ভুত একটি অধ্যায় সেদিন থেকে রচনা করতে যাচ্ছে! যদিও সে অধ্যায়ের শুরুটা করেছিলেন খোদ এরন রামসি' ই। রামসির সেদিনের দেয়া গোলের মাত্র ৪৬ ঘন্টা পরে মারা যান আমেরিকান বিখ্যাত রাজনীতিবিদ টেড কেনেডি। ম্যাসাচুসেট এর সিলেটর হিসেবে কেনেডি ১৯৬২ সাল থেকে সিনেটর পদে আসীন আছিল। কিন্তু হায়! রামসির দেয়া গোলের পরই সিনেটর পদ এবং শেষ নিঃশ্বাস- দুটোই ত্যাগ করে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।



এছাড়াও আরো কয়েকটি মর্মান্তিক অলক্ষুণে গোলের কথা বলি।





১ মে ২০১১। আর্সেনালের এমিরেটস স্টেডিয়াম। ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে গোল করে বসেন এরন রামসি! তার একমাত্র গোলে সেদিন ১-০ গোলের জয় পায় আর্সেনাল। ম্যাঞ্চেষ্টার ইউনাইটেডকে হারানোর সে ম্যাচে রামসি গোল করেন, তাও প্রায় দুই বছর পরে! রামসির গোল নিয়ে মাতামাতি হয়তো কয়েকদিন চলতো। কিন্তু, তা আর হলো না। ওই গোলের পরের দিন ই পাকিস্তানের এবোটাবাদের একটি বাড়িতে আল- কায়দার মাষ্টারমাইন্ড 'বিন লাদেন' কে হত্যা করে আমেরিকান সিল টিম!

৪ মাস পরের কথা। ২ অক্টোবর ২০১১। টট্যানহ্যামের হোয়াইট হার্ট লেন স্টেডিয়াম। ম্যাচে পিছিয়ে পড়া আর্সেনালকে গোল করে সমতায় ফেরান এরন রামসি। যদিও সমতা ধরে রাখতে পারেনি আর্সেন ওয়েঙ্গারের শীর্ষরা। ম্যাচের ৭০ মিনিটে আরেকটি গোল খেয়ে বসে তারা। ফলে ২-১ এর হার নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় রামসি'দের। কিন্তু আর্সেনালের স্কোরশিটে নাম ছিলো একমাত্র রামসি'র। ফলাফল হাতে-নাতেই এলো। অক্টোবরের ৫ তারিখ আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রযুক্তির শীর্ষ প্রতিষ্টান 'এপ্যল' এর সিইও স্টিভ জবস ৫৬ বছর বয়সে মারা যান!

ফুটবল ফ্যানদের কাছে ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ মানেই অন্যরকম এক উন্মাদনা। ইউরো শ্রেষ্টত্বের লড়াইয়ে মাঠে এবং মাঠের বাইরে ব্যস্ত থাকে ফুটবল ক্লাব আর তাদের প্লেয়াররা। সেই চ্যাম্পিয়ন্স লীগ উন্মাদনায় আর্সেনালকে আনন্দে ভাসালেন এরন রামসি। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর। মার্সেইল্লের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লীগ সে ম্যাচে ইঞ্জুরী টাইমে গোল দিয়ে এক নাটকীয় জয় উপহার দেন এমিরেটস'বাসীদের। তবে সে গোলটিও কিনা ছিলো আরেকটি অলক্ষুণে গোল; যার প্রমান আমরা পরের দিন ই পাই। ২০ অক্টোবর লিবিয়ার সৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে নির্মমভাবে আঘাত করে এবং পরমূহুর্তে মৃত্যু হয় তার। বিদ্রোহীদের হাতে প্রাণ হারান লিবিয়ার সাবেক এ সেনাপ্রধান।

বেশ কয়েকমাস বিরতি দিয়ে আবারো স্কোরশিটে নাম লিখালেন এরন রামসি। সময়টা ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। প্রিমিয়ারলীগ গেইমউইক ম্যাচে সান্ডারল্যান্ড এর বিপক্ষে ২-১ গোলের জয় পায় আর্সেনাল। দলের হয়ে একটি গোল করেন ৮ নাম্বার জার্সিধারী এরন রামসি। আর সে গোলের মাত্র ২১ ঘন্টা পর মৃত্যুবরণ করেন আমেরিকান তারকা সঙ্গীত শিল্পী হোইটনি হাস্টন! লস এঞ্জেলস এর বেভারলি হিল্টন' এ নিজ বাসভননের বাথরুম থেকে তার মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। অলক্ষুনে গোল দেয়া যেন পিছুই ছাড়ছেনা রামসির!

প্রায় ১৩ মাস পরের কথা। ২০১৩ সালের ২১ মার্চ। দীর্ঘ বিরতি আর ইঞ্জুরি কাটিয়ে আবারো দলে ফিরলেন এরন রামসি। নিজেদের মাঠ এমিরেটস স্টেডিয়ামে স্পার্সদের বিপক্ষে একটি গোলও করেন রামসি। তবে সে ম্যাচ তারা হেরে যায় ২-১ গোলের ব্যবধানে। ম্যাচ হারার সাথে সাথে প্রাণও হারে এক তারকা বাস্কেটবল প্লেয়ারের! রামসির ওইদিনের ঘটনার পরের দিন মৃত্যুবরণ করেন পল উইলিয়ামসন! সাথে পরলোকে নিয়ে যান আরেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব বরিস বারাজোবস্কি'কে! এরন রামসির এক গোলে দুজন তারকা মানুষের মৃত্যু; কাকতালীয় হলেও ব্যাপারটা যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতোই ব্যাপার।



নভেম্বর ৩১, ২০১৩ সাল। বিশ্বের অন্যতম পপুলার মুভি সিরিজ 'ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস' এ অভিনয় করে কোটি ভক্তের মন জয় করা হলিউড কাপানো অভিনেতা পল ওয়াল্কার এর মৃত্যুটা ঘটেছিলো হঠ্যাৎ করেই। এমন জনপ্রিয় এবং প্রতিভাবান একজন অভিনেতাকে হারিয়ে শোকে ভেসেছিলো হলিউড সহ পুরো বিশ্ব। কিন্তু গুঞ্জন উঠে, পল ওল্কারের আকস্মিক মৃত্যুর পিছনেও নাকি হাত আছে এরম রামসির আর তার গোলের! অবাক করা হলেও এটা সত্য যে পল ওল্কারের মৃত্যুর আগেরদিনও গোল করেন রামসি! সাবেক ক্লাব কার্ডিফ এফসির বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয়ের ম্যাচে আর্সেনালের হয়ে একাই ২টি গোল করেন এরন রামসি। এবং অলক্ষুনে গোলের ফলাফল যথারীতি পরেরদিন ই পাওয়া যায়।





এরপর কেটে গেলো বেশ কিছু রজনী। সংখ্যার হিসেবে যা ২ বছর ১ মাস বা ৭৬০ দিন। এরন রামসি আবারো গোলকিপারকে পরাস্থ করলেন। এমিরেটস দর্শকদের আনন্দে ভাসালেন, সেলিব্রেশনটা সারলেন আকাশে হাত উঁচিয়ে। প্রিমিয়ারলীগ ম্যাচে ম্যাঞ্চেষ্টার সিটি'কে ৩-১ গোলে হারায় আর্সেনাল। ১০ আগস্টের ওই ম্যাচে একটি গোল করেন এরন রামসি। বারবার অলক্ষুণে গোল দিতে থাকা রামসি এবারও আরেকটি ঘটনার সাক্ষী হলেন! রামসির দেয়া গোলের পরদিন ই '৭০ এর দশকের আমেরিকান খ্যাতিমান স্টেন্ড-আপ কমেডিয়ান এবং অভিনেতা 'রবিন উইলিয়ামস' গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন!



জানুয়ারি ৯, ২০১৬। সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে নামে আর্সেনাল। ম্যাচশেষে ৩-১ গোলের জয় পায় গানার্সরা। ম্যাচে একটি গোল করেন এরন রামসি। এর পরের দিন, অর্থাৎ ১০ ই জানুয়ারি নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে মৃত্যুবরণ করেন ইংলিশ সঙ্গীত রচয়িতা ও গায়ক ডেভিড বোওয়্যে।

২০১৬-১৭ সিজনের কথা। প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচে মুখোমুখি লিভারপুল বনাম আর্সেনাল। নিজেদের মাঠে লিভারপুল কে আতিথ্য দেয় আর্সেনাল। আক্রমন পালটা আক্রমনে চলতে থাকে খেলা। ম্যাচশেষে রেজাল্ট দাঁড়ায় ৩-৩! আর্সেনালের হয়ে এ ম্যাচে একটি গোল করেন ৮ নাম্বার জার্সিধারী এরন রামসি। ঘটনা এখানে ই শেষ হতে পারতো, কিন্তু শেষ হলোনা। রামসির গোলগুলো যে অলক্ষুনে তার প্রমাণ আবারো পাওয়া গেলো। লিভারপুলের বিপক্ষে করা গোলের পরের দিন ই মারা যান হলিউডের সময়ের সেরা ছবি নির্মাতাদের একজন; এলেন রিকম্যান। 'হ্যারি পটার, রবিনহুড, ডাইহার্ড'... এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় মুভির নির্মাতা এলেন রিকম্যান এর মৃত্যু হয়েছিলো ১৪ জানুয়ারিতে। এরন রামসির দেয়া গোলের পরেরদিন ই...!



২০১৬ এর মার্চের ঘটনা। ৫ মার্চের ম্যাচে টট্যানহ্যমের হোয়াইট হার্ট লেন' স্টেডিয়ামে মুখোমুখি আর্সেনাল- টট্যানহ্যাম। ম্যাচের শুরুতেই স্পার্সদের এগিয়ে দেন হ্যারি কেইন। বিরতিতে যাওয়ার আগ মুহুর্তে বেল্লেরিন এর গোলে ম্যাচে সমতায় ফিরে আর্সেনাল। দ্বিতীয়ার্ধে স্কোরশিটে নাম লিখালেন রামসি। ২-১ এ ম্যাচ শেষ করার সুযোগ অবশ্য কাজে লাগাতে পারেনি গানার্সরা। শেষ মুহুর্তে ডেলে আলির অসাধারণ এ হেডারে ২-২ এর সমতায় ফেরে স্পার্সরা। ফলে ড্র নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় দু'দলকে। ম্যাচের কাহিনি এখানে শেষ হয়ে গেলেও রামসির কার্স থেকে রক্ষা পেলেন না আরেক সেলেব্রেটি। এবার অলক্ষুনে গোলের শিকার আমেরিকার ৪০ তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এর স্ত্রী, মডেল অভিনেত্রী এবং একসময়ের ফাস্টলেডি- ন্যান্সি রিগ্যান! রামসির দেয়া গোলের পরদিন ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস এ মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

সমীকরণরটা এরকম দাড়িয়েছে যে, এরন রামসির গোল করা আর সাথে একজন সেলিব্রেটির প্রাণ হারানো অবধারিত ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে রামসি'কে মজা করে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন,
'রামসি, আপনার গোলগুলো নাকি অলক্ষুণে? আর আপনার গোলের পর নাকি বড় কোনো সেলিব্রেটি মারা যান?' উত্তরে মৃদু হেসে রামসি বলেছিলেন-
- ভাগ্যিস! আমি খুব বেশি গোল করিনি। নয়তো রেজাল্ট আরোও ভয়াবহ হতে পারতো।'

এমন কথার পর আমিও চাইবোনা রামসি বেশি বেশি করে গোল করুক। ইয়ে মানে, বলা তো যায়না কখন এই লেখক আর লেখার পাঠকশ্রোতাদের কি হয়ে যায়!

© আহমদ আতিকুজ্জামান।