ওয়ার্ন নাকি মুরালি?
পোস্টটি ২৭৬২৮ বার পঠিত হয়েছে১.
"সর্বকালের সেরা" টার্মটার সাথে বিতর্ক এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যে বিতর্ককে এই টার্মের একটা প্রতিশব্দ বলা যায়। ক্রিকেটে যখন কেউ সর্বকালের সেরা একাদশ দেন তখন বিভিন্ন পজিশন নিয়ে বিতর্ক একদম তুঙ্গে উঠে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় স্পেশালিষ্ট স্পিনার পজিশনে কে থাকবে সেটা নিয়েই, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ তাদের স্কোয়াডে একজন স্পেশালিষ্ট স্পিনারই নেন আর সেই একজন স্পেশালিস্ট স্পিনার হিসেবে ওয়ার্ন নাকি মুরালি - কাকে নেওয়া হবে এটা নিয়ে বিতর্ক গত একদশক ধরেই চলে আসছে। কারো মতে একাদশে ওয়ার্নই বেশি ইফেক্টিভ আর কারো মতে মুরালির মত কনসিস্টেন্ট পারফর্মারই একাদশে বেশি দরকার। দুইজনের মধ্যে কে সেরা এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু করলে সেটার শেষ কোথায় যাবে তা বলা মুশকিল। আচ্ছা এই দুইজনের মধ্যে তুলনা করার প্যারামিটার কি? এই দুইজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নেওয়ার বিতর্কহীন কোনো উপায় কি সত্যিই নেই? চলুন নিজেরাই খুঁজে দেখি কোনো উপায় পাওয়া যায় নাকি...
২.
উপায় খুঁজার আগে একপক্ষকে আগেই এই লেখা না পড়ার অনুরোধ করছি, যারা মুরালিকে মনেপ্রাণে চাকার হিসেবেই মনে করেন তাদের জন্য এই লেখা পড়া না পড়া সমান কথা। কারণ স্বয়ং আইসিসি যেখানে মুরালির বোলিং অ্যাকশনকে দুইবার লিগ্যাল ঘোষণা করেছে সেখানে আপনি যদি মুরালিকে এখনো চাকার মনে করে বসে থাকেন তাতে অন্যদের কিইবা করার থাকে? আর যারা ষড়যন্ত্র থিওরি আনবে তাদের জন্য বলছি, মুরালি ভারতীয় স্পিনার হলে তাও নাহয় এই ষড়যন্ত্র থিওরি মানা যেতো কিন্তু শ্রীলঙ্কা কবে থেকে আইসিসির সুপারপাওয়ার হলো যে তারা আইসিসির ডিসিশনকে ম্যানিপুলেট করবে?? আর যারা দাবি করবে যে মুরালি অবৈধভাবে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ হওয়ার সুযোগ নিয়েছিলেন তাদের জন্য বলছি, ফুটবলের সর্বকালের সেরা ড্রিবলার গারিঞ্চার বাম পা ডান পায়ের চেয়ে কিছুটা ছোট ছিল আর শরীরের এই অদ্ভুত গড়নই গারিঞ্চাকে তার ড্রিবলিং স্কিলে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলো, এখন আপনাদের যুক্তি অনুযায়ী গারিঞ্চাকেও কি অবৈধ ফুটবলার বলা যায় না? ওয়ার্ন মুরালি দুইজনই লিগ্যাল বোলার এটা মেনে নিয়েই আমরা পরের প্যারায় যাচ্ছি।
৩.
দুইজন খেলোয়াড়ের মধ্যে তুলনা করার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই ওই দুইজন খেলোয়াড়ের ওভারল স্ট্যাট তুলনা করা শুরু করি। এক্ষেত্রে যদি আমরা মুরালি আর ওয়ার্নের ওয়ানডে স্ট্যাট দেখি তাহলেই বুঝতে পারবো যে ওয়ানডেতে মুরালির সাথে ওয়ার্নের ব্যবধানটা একটু বেশিই তাছাড়া টেস্টে মনোযোগ দেওয়ার জন্য ২০০২ সালের পর ওয়ার্ন আর কোনো ওয়ানডেও খেলেন নি। একারণে সিংহভাগ ওয়ানডে স্কোয়াডে সোলো স্পিনার হিসেবে মুরালিই সুযোগ পায়। তাই আমাদের বিতর্কের টপিক থেকে ওয়ানডে ফরম্যাটও সরিয়ে নিলাম। মূলত টেস্টে এই দুই স্পিন উইজার্ডের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েই বিতর্ক খুব বেশি হয়ে থাকে তাই চলুন এই দুইজনের ওভারল টেস্ট স্ট্যাট দেখে আসি।
শেন ওয়ার্ন ও মুত্তিয়া মুরালিধরন দুইজনেরই টেস্ট অভিষেক হয়েছিলো ১৯৯৩ সালে, ওয়ার্ন অবসর নিয়েছিলো ২০০৭ সালে আর মুরালি ২০১০ সালে। তিন বছর আগে অবসর নিলেও মুরালির চেয়ে ১২ টেস্ট বেশি খেলেছেন ওয়ার্ন এবং সংখ্যাটা আরো বাড়তো যদি না ডোপ কেলেঙ্কারিতে ওয়ার্ন এক বছর মাঠের বাইরে না থাকতেন!!! শ্রীলঙ্কার চেয়ে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট খেলার সুযোগ বেশি পায় আর সেটাই ওয়ার্নের বেশি টেস্ট খেলার কারণ। ওয়ার্ন ১৪৫ টেস্টে পেয়েছেন ৭০৮ উইকেট, উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২৫.৪১ রান। অন্যদিকে ১৩৩ টেস্ট খেলে ৮০০ উইকেট পেয়েছেন মুরালি, উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২২.৭ রান। মুরালি প্রতি ৫৫ বলে একটি উইকেট শিকার করেছেন অন্যদিকে ওয়ার্নের ক্ষেত্রে সেটা ২.৪ বল বেশি। মুরালি ওভারপ্রতি ২.৪৭ রান খরচ করেছেন আর ওয়ার্ন খরচ করেছেন ২.৬৫। ওয়ার্ন ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৩৭ বার আর মুরালি ৬৭ বার! মুরালি ম্যাচে দশ উইকেট নিয়েছে ২২ বার আর ওয়ার্ন দশবার।
৪.
কিন্তু এসব সোজাসাপ্টা পরিসংখ্যান দেখেই যদি শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করা যেতো তবে এত বিতর্ক তো কখনোই হতো না, পরিসংখ্যানের ভিতরের ব্যাপারগুলো না জানলে পরিসংখ্যান কিছু মূল্যহীন উপাত্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। চলুন দেখে নেওয়া যাক মুরালি আর ওয়ার্নের ক্যারিয়ারের কিছু ভিতরকার কথা।
মুরালি আর ওয়ার্নের মধ্যে তুলনা করার আগে মনে রাখতে হবে শ্রীলঙ্কায় জন্ম নেওয়ার কারণে মুরালি স্বাভাবিকভাবেই স্পিন ফ্রেন্ডলি কন্ডিশনে বোলিং করার সুযোগ বেশি পেয়েছেন। অন্যদিকে ওয়ার্ন হোম কন্ডিশন হিসেবে পেয়েছে পেসারদের স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত মাঠগুলোকে যেখানে স্পিনারদের জন্য খুব অল্পপরিমাণ সাহায্যই থাকতো। মুরালি ঘরের মাঠে ৭৩ টেস্ট খেলে ১৯.৬ এভারেজে পেয়েছে ৪৯৩ উইকেট!! কিন্তু ঘরের বাইরে ৬০ ম্যাচ খেলে পেয়েছে ৩০৭ উইকেট কিন্তু উইকেটপ্রতি খরচ করতে হয়েছে ২৭.৮!!!
অন্যদিকে ওয়ার্ন তার হোমগ্রাউন্ডে ৬৯ টেস্ট খেলে ২৬.৪ গড়ে পেয়েছে ৩৭৯ উইকেট আর অস্ট্রেলিয়ার বাইরে ৭৬ টেস্ট খেলে ২৪.৭ গড়ে পেয়েছেন ৩৭৯ উইকেট। তারমানে দেখা যাচ্ছে যে মুরালির মত স্পিন ফ্রেন্ডলি হোম পিচ পেলে ওয়ার্নের রেকর্ড যে আরো ভালো হতো সেটা বলাই বাহুল্য।
৫.ওয়ার্ন-মুরালি বিতর্কে যেই পয়েন্টটা মুরালিকে এডভান্টেজ দেয় সেটা হচ্ছে সতীর্থদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সমর্থনের পরিমাণ। ওয়ার্ন যেখানে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছে ম্যাকগ্রা, লি, গিলেস্পিকে সেখানে এক চামিন্দা ভাস ছাড়া বলার মত বিশ্বমানের বোলার মুরালি সঙ্গী হিসেবে পায় নি। এক্ষেত্রে একটা পরিসংখ্যান দেখলেই ব্যাপারটা সবার বোধগম্য হয়ে যাবে, টপ টিমের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কার খেলা ১০৬ টেস্টের মধ্যে মুরালি একাই নিয়েছে ৬১১ উইকেট আর বাকিরা মিলে নিয়েছে ৮৮৯ উইকেট! অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার খেলা ১৪২ টেস্টে ওয়ার্ন একা নিয়েছে ৬৯১ উইকেট আর বাকিরা নিয়েছে ১৭৫৪ উইকেট! অনেকের মতেই ভালো সঙ্গী পাওয়ায় ওয়ার্নের কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু ভালো সঙ্গী পাওয়ার উলটো দিকটাও কিন্তু আমাদের দেখতে হবে। মুরালির দলে তেমন ভালো বোলার না থাকায় শুধুমাত্র মুরালিকে ঘিরেই শ্রীলঙ্কা তাদের গেমপ্ল্যান সাজাতো আর স্বাভাবিকভাবেই মুরালি বেশি ওভার করার সুযোগ পেতেন। তাই ভালো সতীর্থ পাওয়ায় এক্সট্রা এডভান্টেজ ওয়ার্ন পেয়েছে ঠিকই তবে সেটার সাথে বড় একটা বিগ ডিসএডভান্টেজও ছিল।
৬.
ওয়ার্ন মুরালি বিতর্কে মুরালির বিপক্ষে সবচেয়ে বড় পয়েন্ট হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দূর্বল দলের বিপক্ষে বেশি উইকেট লাভ। তখনকার সময়ে জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ বাকি দলগুলোর চেয়ে টেস্টে বেশ পিছিয়ে ছিল, এই দুই দলের বিপক্ষে মুরালি ২৫ টেস্ট খেলে শিকার করেছিলেন ১৭৬ উইকেট, প্রতি উইকেট পেতে খরচ করেছিলেন মাত্র ১৫.১ রান!!! (এগুলো লিখতে গিয়ে আমাদের বিপক্ষে মুরালির সেই রুদ্রমূর্তি ও আমাদের ব্যাটসম্যানদের অসহায় আত্মসমর্পণের কথা মনে পড়ে গেলো ) অন্যদিকে এই দুই দলের বিপক্ষে ওয়ার্ন মোটে তিনটা টেস্ট খেলতে পেরেছিলো, এই তিন টেস্টে ওয়ার্ন ২৫.৭ গড়ে পেয়েছিলেন ১৭ উইকেট! যদি এই দুই দলের বিপক্ষে ম্যাচগুলো বাদ দিই তবে মুরালি ১০৭ টেস্টে ২৪.৮৮ গড়ে পেয়েছিলেন ৬১৬ উইকেট অন্যদিকে ওয়ার্ন ১৪২ টেস্টে ২৫.৪ গড়ে পেয়েছিলেন ৬৯১ উইকেট। অর্থাৎ জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা ম্যাচগুলো বাদ দিলেও মুরালির গড় ওয়ার্নের চেয়ে ভালো, উইকেটসংখ্যায় ওয়ার্ন এগিয়ে থাকলেও ৩৫ ম্যাচ বেশি খেলায় সেটিও খুব একটা বড় পার্থক্য না। তাছাড়া জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা তিন টেস্টে ওয়ার্নের রেকর্ড আহামরি কিছু না তাই এই দুই দলের বিপক্ষে মুরালির সমান ম্যাচ খেললে ওয়ার্নও মুরালির মত অস্বাভাবিক সাফল্য পেতো সেটাও হলফ করে বলা যায় না।
৭.
মুরালি ওয়ার্ন বিতর্কে ওয়ার্নকে এগিয়ে রাখার আরেকটি কারণ হচ্ছে ওয়ার্ন একজন লেগ স্পিনার আর মুরালি অফ স্পিনার। অফস্পিন করার চেয়ে লেগস্পিন করাটা অনেকবেশি কঠিন আর লেগস্পিন অনেক বেশি শৈল্পিক সেটা যেকেউ মানবে তবে দুসরার সঠিক প্রয়োগ করে মুরালি যেভাবে অফস্পিনের ভূবনকে সমৃদ্ধ করেছে সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
দুইজনের মধ্যে আরেকটা মিল ছিল দুইজনের ক্যারিয়ারেই বিতর্ক বেশ বড় একটা অংশজুড়ে ছিল তবে একজনকে ঘিরে বিতর্ক ছিল অন দ্য ফিল্ডে আরেকজনকে ঘিরে বিতর্ক ছিল অফ দ্য ফিল্ডে। অবৈধ অ্যাকশনের জন্য নো বল ডাকা তারপর চারবার বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষায় যাওয়া এমন আরো অনেক বিতর্কিত ঘটনা মুরালির ক্যারিয়ারে ছিল অন্যদিকে নারী কেলেঙ্কারি, ডোপ কেলেঙ্কারি এমন আরো বহু বিতর্কে জড়িয়ে ওয়ার্ন বারবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিলেন। তবে এত্ত বিতর্ক কিন্তু দুইজনের গ্রেট হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।
৮.
লেখা শুরু করেছিলাম ওয়ার্ন মুরালির মাঝে যেকোনো একজনকে বেছে নেওয়ার উপায় বের করার জন্য কিন্তু শেষে দেখা যাচ্ছে আমি নিজেই একেকবার একেকজনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে সবাইকে আরো কনফিউজড করে দিচ্ছি আসলে ওয়ার্ন মুরালি দুইজনই সাফল্যের এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো যে এই দুইজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নেওয়া খুবই কঠিন কাজ। দুইজনের মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য,কেউ এক প্যারামিটারে এগিয়ে গেলে অন্যজন ঠিকই আরেক প্যারামিটারে এগিয়ে গিয়ে সবকিছু সমান করে দেন। আজকাল অনেক জায়গায় দেখি অলটাইম বেস্ট স্কোয়াডে নিজেদের পছন্দের স্পিনারকে রাখার জন্য কেউ ওয়ার্নকে হেয় করছেন আবার কেউ মুরালিকে ছোট করছেন! অথচ একবার বর্তমান সময়ের স্পিনারদের সাথে এই দুইজনের তুলনা করলে যেকেউ সহজে বুঝতে পারবে এই দুইজন স্পিন বোলিংটাকে ঠিক কোন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলো। তাই অলটাইম বেস্ট স্কোয়াডে সলো স্পিনার কারো ইচ্ছা হলে সে যেমন মুরালিকে রাখতেই পারে আবার অন্য কারো ইচ্ছা হলে সে ওয়ার্নকেও রাখতে পারে, কাউকেই ভুল বলার উপায় নেই।
এরপরও যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয় আমার স্কোয়াডে আমি ওয়ার্ন মুরালির মধ্যে কাকে রাখবো তবে আমার জবাব কি হবে? আমি একাদশে দুজনকেই একসাথে চাইবো। হ্যাঁ জানি দুই স্পিনার রাখা কিছুটা বিলাসিতা কিন্তু দুই গ্রেটকে একসাথে একাদশে পাওয়ার জন্য এতটুকু বিলাসিতা করতে আমার কোনো আপত্তি নাই।
- 0 মন্তব্য