• ক্রিকেট

আহা! অ্যাশেজ!!

পোস্টটি ৫৮৪২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

আমার কাছে ক্রিকেট আবেগ হবার কাল তখন। গ্রীষ্মের তপ্ত উনুনে স্কুলের টিনের চালার নিচে আধসিদ্ধ হয়ে বাসায় ফিরার তাড়া কেবলমাত্র ব্যাট-বল হাতে মাঠে নামার জন্য। সে এক রোমাঞ্চকর সময়, কোচ ডেভের হাত ধরে বাংলাদেশ দল ‘মিনোস’ তকমা মুছে দেয়ার যাত্রা শুরু করেছে মাত্র। কার্ডিফের আশরাফুল কাব্য, শাহরিয়ার নাফীসের ঝাঁকড়া চুলের ঔদ্ধত্য তখন কিশোর বুকে কাঁপন ধরায়; বিশ্বমঞ্চে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়ার সে দিনগুলোতে আমার মত বালকের চোখে তখন ক্রিকেট শুধু খেলা নয়- সেটা এক রোমাঞ্চ, নিজের দেশকে ভালোবাসা দেয়ার এক হাতিয়ার!

ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের আঁচ গায়ে আরো আগে থেকেই লাগতো, কিন্তু ২০০৫ এর সেই গ্রীষ্মই আমাকে স্পর্শ করিয়েছিল আরেক আগুনের আভায়- ‘অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড’ দ্বৈরথ।

ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ঐ ফাইনালে কি ছিল না? ফ্লিনটফ-হার্মিসনের বোলিং তোপে ১৯৬ রানে গুঁটিয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া যে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ টাই করবে সেটাতো বোধের অগম্য ছিল! এখনো চোখে ভাসে ম্যাকগ্রার সেই ঠাণ্ডা মাথার থ্রো, গফকে রানআউট করে জাইলসের ধরে রাখা নৌকার গলুই আরেক প্রস্থ ডুবিয়ে দেয়া। ট্রফি ভাগাভাগি হয়েছিল বটে, কিন্তু ইংল্যাণ্ড তো ঐ ফাইনাল থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করে দিয়েছিল- ‘এবার এতো সহজে ‘অ্যাশেজ’ হারছি না!’

গোটা আগস্ট-সেপ্টেম্বর বুদ হয়েছিলাম ক্রিকেটে, বাসায় ডিস ছিল না- খেলা দেখতাম সেলুনে গিয়ে! পরদিন সকালে পত্রিকা পাবার জন্য দরজা খোলা রেখে বসে থাকতাম। পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে বুঝার চেষ্টা করতাম হার্মিসনের বোলিং তোপ, ‘দক্ষিণ আফ্রিকান’ পিটারসেনের ‘ইংলিশ স্টার’ হয়ে উঠা, অথবা ফ্লিনটফের ‘বোথাম’ হয়ে যাবার গল্প। স্কুলে কথা হত ক্রিকেট নিয়ে, বিকালে দাঁড়িয়ে থাকা সেলুনের দরজায়- ডিস না থাকায় বাবার উপর রাগ করে রাতে ঘুমিয়ে পড়া ১৪ বছরের আমি তখন শ্বাস নিই ক্রিকেটে, বাসা বাঁধি ক্রিকেট মাঠে!

অস্ট্রেলিয়ার টানা আধিপত্য ক্ষুণ্ন হয়েছিল দেখে খুব খুশি হয়েছিলাম সেবার, মাইকেল ভনের অ্যাশেজ হাতে তোলার ছবি দেখে ভুলে গিয়েছিলাম যে কিছুদিন আগেও ওর দল বাংলাদেশ দলকে ছাতু বানিয়েছিল। সাথে এটাও বুঝেছিলাম বাংলাদেশ তখন যেটা খেলত সেটা আসল ক্রিকেট থেকে অনেক পিছনে, টেস্ট ক্রিকেটে মজতে হলে বনেদি ঘরের ক্রিকেট-মঞ্চই অনুসরণ করতে হবে।

এরপর থেকে প্রতিটি অ্যাশেজ দেখেছি, কখনো বন্ধুর বাড়িতে, কখনো সেলুনের দরজায়, কখনো পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি মাড়ানোর পর অ্যাশেজ দেখেছি নিজের বাড়িতে। ভোরের আলো ফুঁটার সময় নিজ বাড়িতে টিভি ছেড়ে শুরু থেকে খেলা দেখার আনন্দের কাছে ফিকে হয়ে গিয়েছিল অন্য সবকিছু! ব্রিসবেন, অ্যাডিলেড, পার্থের উইকেট গুলো পত্রিকার পাতা থেকে টিভির পর্দায় দেখে বুঝেছিলাম কল্পনার থেকেও মাঠগুলো আরো বেশি সুন্দর!

অস্ট্রেলীয় অথবা ব্রিটিশ না হয়েও অ্যাশেজ তাই আমার কাছে আবেগের। এই সিরিজটা আসলেই আমার সামনে একসাথে মূর্তিমান হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কাল। শেষ অ্যাশেজটা যখন শুরু হয় তখন আমরা চট্টগ্রামে, বৃষ্টিস্নাত দিনের অলস দুপুরে বন্ধুদের সাথে বসে দেখেছিলাম কার্ডিফের প্রথম টেস্ট। আরেকটা অ্যাশেজের সূচনায় সে দিনগুলো খুব মানসপটে আসে, সব ছেড়েছুড়ে আবার ইচ্ছা হয় চোখ বুলাই টিভির পর্দায়।

প্রবাস জীবনে টিভি এখন ‘বিলাসিতা’, টাইম জোনের খপ্পরে পড়ে বোঝা দায় খেলাটা আজ হচ্ছে নাকি আগামীকাল! এখন আবার অ্যাশেজ দেখি পত্রিকার পাতায়, কাগজের বদলে সেই পত্রিকা এখন ভেসে উঠে মনিটরের স্ক্রিনে। ‘প্যাভিলিয়ন’ এর হাত ধরে এখন বোঝার চেষ্টা করি স্মিথ কিভাবে সেঞ্চুরিটা করল, রুট কিভাবে ফিল্ডিং টা  সাজালো, স্টার্কের ইয়র্কারগুলো কেমন হল। গ্যাবার মাঠটা মিরপুরের মাঠের মতই এখন ভারাক্রান্ত করে, ‘অ্যাশেজ’ না দেখতে পারার দুঃখটা বাংলাদেশের খেলা মিস করার কষ্টটাকেই আরেকবার মনে করিয়ে দেয়। কৈশোরের খেলা দেখতে না পারার পুরনো আক্ষেপটা আরেকবার ফিরে এসে যেন জানান দিচ্ছে আমাকে- ‘জীবনটা এক চক্ররে পাগলা!’