• ক্রিকেট

একজন 'গাজী'র গল্প

পোস্টটি ১২৭৯৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মুশফিকের কি মনে হয়েছিল কে জানে!

ব্যাকরণ মেনে অধিনায়কত্ব করা মুশফিক অভিষেক টেস্ট খেলতে নামা একজনকে দাঁড় করিয়ে দিলেন ক্রিস গেইলের সামনে! হয়তো ড্রেসিং রুম থেকেও নির্দেশনা ছিল, হয়তো না। বাংলাদেশের বিপক্ষে আগে কখনোই তেমন ভাল টেস্ট স্কোর না করা গেইলের তাতে কি এসে যায়- সোহাগ গাজীর স্টাম্পের বাইরে ফেলা আলগা বলটা অনায়াসে তুলে দিলেন মাথার উপর দিয়ে। টেস্ট ক্রিকেট প্রথমবারের মত দেখল প্রথম দিনের প্রথম সেশনের প্রথম বলে ছক্কা।

সেটা ২০১২ সাল, বছরের শুরুতে এশিয়া কাপ থেকেই বাংলাদেশ তখন এক বদলে যাওয়া ‘বাংলাদেশ’। দলে অনেকদিন থেকে খেলা পঞ্চপাণ্ডবের ছায়াতলে নাসির-আনামুল-মমিনুলরা তখন কুতুব হবার চেষ্টা করছেন। দলে একই সাথে অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের মিশেল- ক্রিকেটে ভাল করতে এর বেশি আর কি চাই? সোহাগ গাজীর আগমন এমন সময়ই, বাঁহাতি স্পিনারদের ভীড়ে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। প্রথাগত অফ-স্পিনার সে অর্থে বাংলাদেশ কখনোই পায়নি, দুর্জয় ছিলেন বটে টেস্ট ইতিহাসের আদিতে- কিন্তু বিশেষজ্ঞ বোলার হিসেবে গাজীকেই বাংলাদেশের প্রথম অফ-স্পিনার বলা চলে।

শুরুটা ছয় খেয়ে হলেও গাজী দমেন নি, প্রথম তিন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়েছিলেন তিনিই। শুরু থেকেই চালিয়ে খেলা গেইলকে ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম আনন্দটা তিনিই এনে দিয়েছিলেন। প্রথম ইনিংসে ঐ তিন উইকেটই নেয়া গাজী দ্বিতীয় ইনিংসে হাজির হয়েছিলেন অবোধ্যরূপে! ওয়েস্ট ইন্ডিজের লেজ খসিয়ে দিয়ে ঐ ইনিংসে শেষমেশ ৬ উইকেট নিয়ে থামেন! টিনো বেস্টের দুর্বার গতির সামনে ঐ টেস্টটা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত হেরেছিল, কিন্তু বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতায় জ্বলজ্বল করছিল সোহাগ গাজীর নাম।

দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছিলেন এরপর, টেস্টে সাকিবের যোগ্য সহচর পেতে আকুল বাংলাদেশের তাঁকে পেয়ে দুদণ্ড শান্তি মিলেছিল। শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়েতে মোটামুটি করেছিলেন, কিন্তু ইতিহাসের অংশ হতে বেছে নিয়েছিলেন ঘরের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা সিরিজটিকে। এক টেস্টে হ্যাট্রিক আর শতক, ক্রিকেট ইতিহাসে এই কৃতিত্ব এখন পর্যন্ত কেবল তাঁরই আছে!

Gazi

অনবদ্য ছিল সে সিরিজটা, চট্টগ্রাম টেস্ট ছিল গাজীর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স আর মমিনুলের ১৮১ এর সৌরভময়- ড্র করে উত্তুংগ আত্নবিশ্বাসী বাংলাদেশ দল ঢাকায় ফিরেছিল টেস্ট জিতার স্বপ্ন চোখে নিয়ে। বৃষ্টিতে টেস্ট ভাসলেও ওয়ানডেতে আরেকবার ‘বাংলাওয়াশ’ করে কিউইদের বাংলাদেশ সফর একেবারে জঘন্য করে দিয়েছিল বাংলাদেশ দল! দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ গাজী পুরো সিরিজ জুড়ে ছিলেন মুশফিকের অন্যতম ফৌজ, ব্যাট হাতেও লোয়ার অর্ডারে ছিলেন একজন ভরসাদাতা কাণ্ডারি।

Gazi 2

২০১৩ সালের ঐ সিরিজের পরই বাংলাদেশ পথ হারাতে শুরু করে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরের সিরিজে ঘরের মাটিতে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয় দলের। এশিয়া কাপের একের পর এক পরাজয়ের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হংকং এর কাছে হার- দলের সদস্যদের তখন মনে হচ্ছিল দিশা হারানো নাবিক- একের পর এক পরাজয়ে বিপর্যস্ত মুশফিক তখন হাল ভাঙ্গা জাহাজের কাপিতান! খারাপ সময়ের ফেরে পড়লেন গাজীও- অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ হলো, নিষিদ্ধ হলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।

তখন বিশ্বকাপের প্রস্তুতিকাল, পালাবদল চলছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। নতুন কোচ এসেছেন, নিজের মত করে গুছিয়ে নিচ্ছেন। কোচের সুনজর এড়িয়ে গেল এই অফ-স্পিনারের উপর থেকে, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া হল জাতীয় দলের কোন সংস্পর্শ ছাড়াই। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপ দলে থাকলেন না, নতুন কোচের অধীনে জাতীয় দলের সাফল্য একে একে আকাশ ছুঁল- অসাধারণ ২০১৫ এর উজ্জ্বলতায় একেবারেই হারিয়ে গেলেন একজন সোহাগ গাজী।

নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরেছেন এরপর, কিন্তু জাতীয় দলে আসতে পারলেন কই? বৈচিত্র্যের জন্য নতুন কোচ একের পর এক স্পিনার দিয়ে চেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু পরীক্ষিত গাজী থেকে গেছেন উপেক্ষিত। ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স দিয়ে মন জয় করতে পারেননি নির্বাচকদেরও।

গাজীর বিরুদ্ধে অবশ্য অনেকেই আঙ্গুল তুলেছেন। জিমে সিরিয়াস নন, ফিটনেসে গুরুত্ব দেন না, ওজন কমাতে ব্যর্থ- এমন অনেক গুরুতর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে। অ্যাকশন শুধরে ফিরে আসার পর ধার কমে গেছে এমন কথাও শুনতে হয়েছে তাঁকে। এক্ষেত্রে একটা গল্প বলা যায়-

গাজীর অ্যাকশনের সমস্যা ২০১৪ তে নয়, ২০১২ তেই প্রথম ধরা পড়েছিল। বাংলাদেশ এ দলের হয়ে ভারত সফরের সময়ই আম্পায়ার তাঁর কুইকার ডেলিভারি গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। একজন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটারের অ্যাকশান নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কারো তেমন মাথা ব্যথা ছিল কিনা বোঝা যায়না, কিছু রুটিন চেকের পর বিসিবি যে আর গা করেনি তাঁকে নিয়ে। সে বছর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর তো ডাকই পেয়ে যান জাতীয় দলে- আর দুই বছর পর সেই কুইকার ডেলিভারি দিতে কনুই ভাঙ্গার জন্যেই বহিষ্কৃত হন!

সিরিয়াসনেস নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, ঘরোয়া লীগে অধারাবাহিকতার কথাও বলা যায়- কিন্তু এসব কথা বলা যায়না, যেমনি ব্যাখ্যা করা যায় না ধারাবাহিক হয়েও অনেক ক্রিকেটারের জাতীয় দলের প্রাথমিক দল থেকে বাদ পড়াটা। মাঝে আমরা সোহাগ গাজীর সাঁ করে টার্ন করে যাওয়া অফস্পিন বল দেখা থেকে বঞ্চিত হই, ক্রমাগত ফ্লাইট দেয়ার মাঝখানে হুট করে কুইকার দিয়ে উইকেট পাওয়া গাজীর বুনো উল্লাস দেখার অভাব অনুভব করি। আর বিপিএল এর চার ওভার দেখে সোহাগ গাজীকে বিচার করি- ‘ধ্যাত ও ফুরিয়ে গেছে’।

এক পালাবদলের সময় হারিয়ে গিয়েছিলেন, আরেক পালাবদলে গাজী আবার ফিরে আসুন না আমাদের মাঝে! দিশা হারানো বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণ আরেকবার শাণিত হোক না তাঁকে পেয়ে। বয়স তো কেবল ২৭, নিশ্চয়ই সেরা সময় আসার এখনো ঢেঁড় বাকী!