ক্রিস্টিয়ানো, ক্রিস্টিয়ানো! (পর্ব - ১)
পোস্টটি ৯০৮৪ বার পঠিত হয়েছেইউরো ফাইনাল ২০০৪, লিসবন, পর্তুগাল।
ঘরের মাঠে গ্রীসের কাছে ১-০ গোলে হেরে অঘটনের শিকার পর্তুগাল দলের সদস্যরা প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা হারানোর হতাশায় মুহ্যমান। তবে সবার মাঝে আলাদাভাবে নজর কেঁড়ে নিয়েছিলেন কোঁকড়া চুলের ১৯ বছর বয়সী এক কিশোর যিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। কোচ এবং সতীর্থরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ। সেদিন সেই কিশোরের কান্না দেখে যে কারোরই মনে হতে পারত এটিই বুঝি ছিল তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ!
ইউরো ফাইনাল ২০১৬, প্যারিস, ফ্রান্স ।
ম্যাচের ২৫ তম মিনিটে তৃতীয়বারের মত মাঠে পড়ে গেলেন পর্তুগাল দলনায়ক। স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় আইফেল টাওয়ারের বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠলো তার চোখ ছলছল মুখ। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন হয়ত এভাবেই বারবার স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় চোখের জলেই বিদায় নিবেন তিনি। তবে বিধাতা তাকে আরো একবার কাঁদালেন। ১২০ মিনিটের স্নায়ুক্ষয়ী ফাইনাল ম্যাচে ফেভারিট ফ্রান্সকে হারিয়ে দিল পর্তুগাল। সবাই আনন্দে দিশেহারা হয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছেন। তবে ঠিক ১২ বছর আগের মতো সবার মাঝেও আলাদা করে চোখে পড়লেন সেদিনের সেই কিশোরটি। দুহাত উঁচু করে তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ থেকে টপাটপ গড়িয়ে পড়ছে জল। তবে স্বপ্নভঙ্গের নয়, এবার তার চোখে ছিল আনন্দঅশ্রু। যেই উদযাপনের জন্য তিনি জগত বিখ্যাত, তিনিই সেদিন ভুলে গিয়েছিলেন কিভাবে মুহূর্তটি উদযাপন করবেন!
***
উপরের দুটি দৃশ্যপটের চরিত্র একজনই। তিনি রবার্ট ব্রুসোর মতোই আরেক যোদ্ধা যিনি বারবার হেরেও হেরে যাননি নিজের কাছে। পরাজয় থেকেই নিয়েছেন নতুন সঞ্জীবনী শক্তি এবং সেটিকে রূপান্তরিত করেছেন অনুপ্রেরণায়। তিনি যুদ্ধের ময়দানের সেই যোদ্ধা যিনি প্রবল পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষকে দেখে মনোবল না হারিয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করে যান শেষ বিন্দু দিয়ে। তাইতো ১৪ বছরের ব্যবধানে সেই কিশোরের অর্জনের শূন্য খাতাটা আজ পরিপূর্ন হয়ে উঠেছে একজন ফুটবলারের সম্ভাব্য সব অর্জনে। নাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো দস সান্তোস এভেইরো। পর্তুগাল, স্পোর্টিং সিপি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে যিনি উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্র। তাকে নিয়ে যতই বলা হবে, ততই যেন কম হয়ে যায়। জন্মদিনে কোটি মানুষের অনুপ্রেণার অসাধারণ সেই গল্পটি তুলে ধরার চেষ্টা রইলো।
জন্ম
১৯৮৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী পর্তুগালের মাদেইরার ফুঞ্চালে জোসে দিনিস এভেইরো ও মারিয়া দোলোরেস দস সান্তোস দম্পতীর ঘর আলো করে জন্ম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তবে দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত পরিবারে নতুন সদস্যের আগমনের আগেই তাকে নিয়ে মা ছিলেন ভীষণ চিন্তিত। তাই চেয়েছিলেন গর্ভে থাকা অবস্থাতেই সন্তানটিকে নষ্ট করে ফেলতে। শেষ পর্যন্ত তিনি তা আর করেননি। আর করবেনটাই বা কি করে? বিধাতা যে লিখে রেখেছেন তার গর্ভের এই সন্তানটিই একদিন বিশ্বশাসন করে আপন মহিমায় বিশ্বদরবারে পর্তুগালকে নতুন করে চেনাবেনএবং নিজেকে ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী করবেন। অবশেষে ডাক্তারের হস্তক্ষেপে সুন্দর এই পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখতে পায় এক ভবিষ্যৎ কিংবদন্তী। রোনালদোর বাবা ছিলেন আমেরিকার সাবেক সাবেক রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানের ভক্ত। তারই নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন রোনালদো।
বেড়ে ওঠা
মাত্র ৩ বছর বয়সেই ফুটবল নামক গোলকটির সংস্পর্শে আসেন রোনালদো। ফুটবলের প্রতি তীব্র আকর্ষণের কারণে পড়ালেখাও সেভাবে চালিয়ে যেতে পারেনি। স্কুলে রোনালদোর প্রিয় বিষয় ছিল ইতিহাস। কিন্তু একদিন শিক্ষককে চেয়ার দিয়ে আঘাত করে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন রোনালদো। শিক্ষকের অপরাধ ছিল রোনালদোর পরিবার এবং জন্মস্থানের ভাষা খারাপ কথাবার্তা বলা। ঘটনাটি খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হলেও রোনালদোর জন্য সেটি সাপেবরই হয়েছিল। এরপর থেকেই ফুটবলকে ধ্যানজ্ঞ্যান বানিয়ে ফেলেন তিনি। দিনরাত শুধুই ফুটবল আর ফুটবল। সারাদিন খেলার পর রাতেও বালক রোনালদোর ঘুমের সঙ্গী হত ফুটবলই। ছোট বেলায় তার পাস থেকে কেউ গোল করতে ব্যর্থ হলে মাঠেই কান্না শুরু করে দিতেন। ফলে বন্ধুমহলে তার নাম দেয়া হয়েছিল 'ক্রাই বেবি'। খুব জোরে দৌড়ানোর কারনে রোনালদোকে 'লিটল বি' নামেও ডাকা হত। ছোটবেলায় ফুটবলার হওয়ার পথে বড় বাঁধা হয়ে এসেছিল হৃদপিন্ডের অপারেশন। তবে অপারেশনটি সুষ্ঠু হওয়ার ফলে স্বপ্নযাত্রায় আরো একধাপ এগিয়ে যান তিনি।
পেশাদার ফুটবল যাত্রা
বাল্যকালে রোনালদোর প্রিয় ফুটবল ক্লাব ছিল বেনফিকা। ১৯৯৩ সালে জীবনের প্রথম ক্লাব আন্দোরিনহা ফুটবল ক্লাবে যোগ দেন তিনি। এখানেই তার বাবা কাজ করতেন। অসাধারণ নৈপুণ্য দিয়ে ১০ বছর বয়সেই মাদেইরার দুই বড় ক্লাব 'সিএস ম্যারিতিমো' ও 'সিডি ন্যাশিওনাল' ক্লাবের নজরে পড়েন তিনি। তবে ম্যারিতিমোর ব্যবস্থাপকের সাথে এক মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকায় ম্যারিতিমো তাকে সাইন করাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ন্যাশিওনাল তাকে দলে টেনে টেনে নেয়। ১২ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন তার প্রিয় ক্লাব বেনফিকার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব স্পোর্টিং সিপিতে। ইতিমধ্যে উয়েফা অনূর্ধ্ব-১৭ চ্যাম্পিয়নশিপে পর্তুগালের হয়ে দুর্দান্ত খেলে নিজের আগমনী বার্তা জানান দেন তিনি। তবে বিশ্বসেরা হওয়ার পথে রোনালদোর সাথে জড়িয়ে আছে বিরল এক বন্ধুত্ত্বের গল্প। স্পোর্টিং সিপিতে প্রথমে পাঁচ বছর রোনালদো প্রথম শ্রেণীতে খেলেন। সেখানে তার সতীর্থ ছিলেন আরেক প্রতিভাবান স্ট্রাইকার আলবার্ট ফ্যানত্রাও। একদিন স্পোর্টিং লিসবন ক্লাবের ম্যানেজার যুব দলের খেলা দেখতে এসে ঘোষণা দেন ফাইনালে রোনালদো ও ফ্যানত্রাওয়ের মধ্যে যে বেশি গোল করবে তাকেই তাদের একাডেমী দলে নেয়া হবে। ৩-০ গোলে জয় পাওয়া সেই ম্যাচে দলীয় প্রথম ও দ্বিতীয় গোলটি করেন যথাক্রমে রোনালদো ও ফ্যানত্রাও। তৃতীয় গোলের সময়ই দেখা গেল বন্ধুত্বের টান। গোলকিপারকে পাশ কাটিয়ে খালি পোস্টের সামনে থেকেও নিজে গোল না দিয়ে ফ্যানত্রাও বলটি বাড়িয়ে দিলেন রোনালদোর দিকে। সহজেই সেটিকে গোলে পরিণত করে রোনালদো স্পোর্টিং লিসবন একাডেমীতে খেলার সুযোগ পান। ম্যাচ শেষে নিজে গোল না দেয়ার কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন তার থেকে সুযোগটি রোনালদোরই বেশি প্রাপ্য, তাই তিনি গোলটি দেননি। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে বন্ধুত্বের নিদর্শন স্থাপন করার ফলশ্রুতিতে ফ্যানত্রাওয়ের ফুটবল ক্যারিয়ার আর বেশিদূর এগোয়নি এবং খুব দ্রুত তিনি বেকার হয়ে যান। তবে বন্ধুর ঋণ ভোলেননি রোনালদো। তাই ফ্যানত্রাওয়ের রয়েছে এখন বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি সবই।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অধ্যায়
২০০২-০৩ মৌসমে স্পোর্টিং সিপির হয়ে রোনালদোর মূল ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয়। ৩১ ম্যাচে ৫ গোল ও ৭ এসিস্টের মাধ্যমে মৌসুম শেষ করেন তিনি। স্পোর্টিংয়ের হয়ে তার খেলা প্রথম ম্যাচ শেষেই সাবেক কোচ পাওলো কারদোসো ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন এই ছেলেটি হতে যাচ্ছে একজন বড় তারকা। মৌসুম শেষে লিসবনে স্টাডিও স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচের আয়োজন করে স্পোর্টিং সিপি। দুই উইংয়েই দারুণ স্কিল ও ড্রিবলিংয়ের অসাধারণ প্রদর্শনীতে মুগ্ধ করেন প্রতিপক্ষ শিবিরকে। ম্যাচ শেষে ম্যান ইউ তারকারা স্যার আযলেক্স ফার্গসুনকে অনুরোধ জানান যেভাবেই হোক না কেন এই বিস্ময় বালককে যেন সাইন করানো হয়। বাকিটা ইতিহাস। প্রায় ১৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে রোনালদোকে দলে ভেড়ায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। রোনালদোকে প্রথমেই দেওয়া হলো ম্যানইউর ঐতিহ্যবাহী '৭' নম্বর জার্সি। সেই থেকেই তিনি হয়ে গেলেন ‘সিআরসেভেন’। ম্যানইউতে রোনালদোর অভিষেক হয় বোল্টন ওয়ান্ডার্সের বিরুদ্ধে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নেমে। এরপরের কাহিনীটা সবারই জানা। একে একে পার হয়ে গেলো ছয়টি বছর। অসাধারণ স্কিল, ড্রিবলিং, হেডার, লং রেঞ্জ গোল, চোখধাঁধানো ফ্রিকিক এবং ক্ষীপ্র গতির জন্য দ্রুত বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন রোনালদো। ২০০৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ২৯২ ম্যাচে ১১৮ গোল ও ৫৪ এসিস্ট করেন তিনি। ইউনাইটেডের হয়ে তার অর্জনের খাতায় রয়েছে তিনটি লিগ, দুটি ফুটবল লীগ কাপ ও একটি করে চ্যাম্পিয়ন্সস লিগ, এফএ কাপ, এফএ কমিউনিটি শিল্ড কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এখানেই জয় করেন ক্যারিয়ারের প্রথম ব্যালন ডি অর। এছাড়াও প্রাপ্তির খাতায় রয়েছে একই বছরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় ও সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরুষ্কার। কোটি কোটি ভক্তদের কাঁদিয়ে ক্লাব ত্যাগের পূর্বে মাত্র ছয় বছরেই নিজেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একজন কিংবদনন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন রোনালদো।
রিয়াল মাদ্রিদ অধ্যায়
২০০৮ সালে রিয়াল মাদ্রিদের তৎকালীন ক্লাব প্রেসিডেন্ট ক্যালেডেরন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেয়ার ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলেন। তবে স্যার ফার্গির অনুরোধে আরো একটি মৌসম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলে ২০০৯ সালের গ্রীষ্মে তৎকালীন রেকর্ড ট্রান্সফার ফি ৯৪ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে শৈশবের প্রিয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন রোনালদো। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেয়াটা রোনালদোর জন্য ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কারন সেই সময়টাতে রিয়াল মাদ্রিদ পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল এবং একটা বড় সময় ধরে শিরোপাবঞ্চিত ছিল। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে নিয়মিতভাবে বিদায় নিত দ্বিতীয় রাউন্ড কিংবা কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই। এছাড়া স্প্যানিশ একটি ক্লাবে নিজেকে মানিয়ে নেয়া এবং ফর্মের তুঙ্গে থাকা মেসির সাথে সরাসরি চ্যালেঞ্জে অবতীর্ন হওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে নামটা রোনালদো বলেই কঠিন সে পরীক্ষায় তিনি লেটার মার্কসহ উত্তীর্ন। রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল দেপোর্তিভো লা করুনার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে এবং সেই ম্যাচেই তিনি রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে তার প্রথম গোলটি করেন। সেই শুরু, মাত্র ৯ বছরেই হয়ে গেলেন ক্লাবের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। রোনালদোর কাঁধে ভর করেই ২০১৮ তে এসে রিয়াল মাদ্রিদ আবারো ফিরে এসেছে সেরাদের কাতারে এবং ভাগ বসিয়েছে বার্সেলোনার একক আধিপত্যে। সম্প্রতি নতুন চুক্তির মাধ্যমে ২০২১ সাল পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রোনালদো।
পর্তুগাল গাথা
২০০৩ সালের আগষ্টে কাজাখস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে পর্তুগালের হয়ে অভিষেক হয় রোনালদোর। পর্তুগালের হয়ে রোনালদোর জন্য বড় কোন আসরে সাফল্য পাওয়াটা ছিল দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। ইউসেবিও, ফিগোরা যা পারেননি, চেয়েছেন তা করে দেখাতে। তবে একটি চ্যাম্পিয়ন দল সেভাবে কখনই পাননি তিনি। রোনালদোর ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে একে একে অবসরে চলে যান লুইস ফিগো, ডেকো, কোস্তারা। সেই ২০১০ সাল থেকে পর্তুগালের মাঝারিমানের দল নিয়েই লড়াই চালিয়ে গেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো । সম্ভাবনা জাগিয়েও বারবার হোঁচট খাচ্ছিলো রোনালদোর স্বপ্ন। তবে তিনি দমে যাননি। সবসময়য় চেষ্টা করে গেছেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে দলকে সাহায্য করতে। ২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দলকে একাই পার করলেও মূল আসরে আর শেষরক্ষা হয়নি। প্রথম রাউন্ডেই পর্তুগালের শোচনীয় বিদায়ের পর ধারণা করা হয়েছিল হয়ত সাবেক অনেক গ্রেটদের মতোই ক্লাব ক্যারিয়ারের সাফল্য নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে রোনালদোকে।
তবে রোনালদো যে সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। তিনি টার্গেট করলেন ২০১৬ ইউরো এবং ২০১৮ বিশ্বকাপকে। ২০১৬ ইউরো শুরুর আগেও কেউই গোনায় ধরেনি পর্তুগালকে। আর কেনইবা ধরেবন? রোনালদো, পেঁপে, নানি ছাড়া দলে নেই কোন তারকা খেলোয়াড়। গ্রূপ পর্বেই বাদ পড়ার শঙ্কা জাগলেও নতুন নিয়মের মারপ্যাঁচে গ্রুপে তৃতীয় হয়েও পর্তুগাল পরবর্তী রাউন্ডে চলে যায়। এরপর একে একে দ্বিতীয় রাউন্ড, কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনালের বাঁধা টপকে ফাইনালে চলে গেলেও স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে পর্তুগালের পক্ষে বাজি ধরার সংখ্যাটা ছিল নেহায়েত কম। ২০০৪ সালে নিজ দেশে ইউরো ফাইনালে হেরে অঝোরে কেঁদেছিলেন কিশোর রোনালদো। এবার আরেক ইউরো ফাইনালেও কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ত্যাগ করেন রোনালদো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে প্রথমার্ধের ২৩ মিনিটেই ইনজুরির শিকার হয়ে স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
অতিরিক্ত সময়ে ইডারের গোলে স্বপ্নের ফাইনালে ১-০ গলে জয় পায় পর্তুগাল। তবে মাঠের বাইরে থেকেও এই জয়ের অন্যতম পার্শ্বচরিত্র সেই রোনালদোই। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে সাইড বেঞ্চে বসে কিংবা টাচ লাইন থেকে চিৎকার করে করে সহকারী কোচের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন পুরোটা সময়। পর্তুগালের কোচ সান্তোস বারবার সরিয়ে দিলেও রোনালদো স্থির থাকতে পারছিলেননা। রোনালদোর এহেন কর্মকাণ্ড চারিদকে নিন্দিত হলেও দেশ ও দলের জন্য একজন যোদ্ধার মত যেভাবে তিনি মাঠের বাইরে থেকেও গর্জে উঠছিলেন, সেটা তার হার না মানা অদম্য মানসিকতারই পরিচয় দেয়। পর্তুগালের ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলের মালিকও তিনি। ২০০৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিটি ইউরো ও বিশ্বকাপ গোল করেছেন রোনালদো যা একটি রেকর্ড।
ফুটবল গুরু
স্যার আযলেক্স ফার্গসুনকে রোনালদো তার বাবার মতোই সম্মান করেন। আর কেনইবা করবেন না? বাবা হারানো দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কিশোর এক বালক যার পক্ষে ফুটবলের চাকচিক্যময় দুনিয়ার সাথে মানিয়ে নেয়াটা সহজ কোন কাজ ছিলোনা। রোনালদোর সেরা খেলোয়াড় হিসাবে গড়ে ওঠার পাশাপাশি হটাৎ পাওয়া তারকাখ্যাতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার ব্যাপারেও অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিলেন ফার্গসুন। নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে গুরুকে ছেড়ে গেলেও আজো ফার্গসুনের প্রতি রোনালদোর সম্মান আগের মতোই বিদ্যমান। এমনকি ২০০৮ সালের গ্রীষ্মে রিয়াল মাদ্রিদে যোগদানের কথা থাকলেও শুধুমাত্র ফার্গসুনের অনুরোধেই রোনালদো আরো একটি মৌসম থেকে যান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। নিজের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে সবসময় ফার্গসুনের নামটিই প্রথমে স্বরণ করেন রোনালদো। রোনালদোর প্রতিটি বড় অর্জনে গুরু শিষ্যের মেলবন্ধন ফুটবলের অন্যতম সুন্দর একটি মুহূর্ত।
(চলবে )
- 0 মন্তব্য