যে পরাজয়ে কেঁদেছিল বীর
পোস্টটি ১৭২৮৮ বার পঠিত হয়েছে“রাজিব মাআআআআর! মার রাজিব মাআআআআআআআর!!”
না, কোনো বাংলা সিনেমার মারপিটের সংলাপ কপচাচ্ছি না। এমন কোনো দৃশ্যের কথাও বলছি না যার পরবর্তী ফ্রেমেই পিস্তল উঁচিয়ে একদল নীল পোষাকের পুলিশ এসে বলবে, “আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না”। আমি বলছি এক বৃহস্পতিবারের কথা। বলছি ১৬ কোটি বাঙ্গালির তীব্র বাসনার কথা। বলছি মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোডের সিঙ্গারের শোরুমের সামনে রাত ১০.৩০ টায়ও জটলা বাঁধা শ’খানেক মানুষের কথা। বলছি মিরপুর শের-এ-বাংলা স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজার ত্রিশেক সমর্থকের কথা। বলছি প্রবাসী বাঙ্গালিদের কথা, সাত সমুদ্র তের নদী দূরে হাজারও ব্যস্ততার মাঝেও প্রিয় মাতৃভূমির টানে যারা বসেছিলেন টিভিসেটের পাশে…
রাজিব পারলেন না। আইজাজ চিমার করা শেষ বলে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৪ রান। লেগে করা বলটি থেকে ১ রান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। বল কুড়িয়েই আফ্রিদি, মিসবাহর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন চিমা। শের-এ-বাংলা স্টেডিয়াম যেন এক মৃত্যুপুরি তখন। শূন্য দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে ২২ গজের দিকে, যেখানে মাথা নিচু করে বসে আছেন রিয়াদ। সবাই তাকিয়ে শাহাদাতের দিকে, যার সামনে এসেছিল শাপমোচনের সুবর্ণ এক সুযোগ। ৯ ওভারে দিয়েছিলেন ৬৩, যার মধ্যে ইনিংসের শেষ ওভারে আসল ১৯। পুরো টুর্নামেন্ট দারুণ ফর্মে থাকা নাজমুলের বদলে দীর্ঘদেহী এই পেসারকে বল করানোর ‘জুয়া’টা কাজে দিল না অধিনায়ক মুশফিকের। যে দিনের শুরুটা হয়েছিল হাজারও সম্ভবনা এবং অভূতপূর্ব ইতিহাস রচনার দৃঢ় প্রত্যয়ে, শেষটা হল স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়। যেই সাকিব, তামিম মুশফিকরা প্রাণখুলে হাসলেন পুরো টুর্নামেন্ট, তাদেরই বোবা কান্নায় ভারী হয়ে পড়ল সমগ্র শের-এ-বাংলা। ‘একাদশে বৃহস্পতি’ বলতে বোঝায় সৌভাগ্যের বিষয়। তাহলে ‘১২-এর সেই বৃহস্পতিকে কী বলব? দুর্ভাগ্যের বিষয়?
অথচ এতটা দূর কিন্তু আসারই কথা ছিল না আমাদের। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে ২২ রানের হার আবারও চোখ রাঙ্গাাচ্ছিল আরও এক ফাইনালে দর্শক হয়ে থাকার। কিন্তু সেবার যেন অদৃশ্য কোনো জেদ আচ্ছন্ন করেছিল সাকিব, তামিমদের। পরের ম্যাচ ভারতের বিপক্ষে। টেন্ডুলকার, কোহলির ভারত। কিন্তু দিনটা যে ১৬ই মার্চ! সেদিন মাঠের ১১ বাঘের সাথে উপস্থিত ছিলেন আরও একজন। শ্যাম বর্ণের, স্মিত হাসির একজন। সবার প্রাণপ্রিয় মঞ্জুরুল ইসলাম রানার ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রিয় রানা ভাইয়ের পরলোকগমনের পরদিনই মাশরাফিরা জন্ম দিয়েছিলেন ‘০৭ বিশ্বকাপে ভারতবধের রূপকথা। ভাগ্যের কী অপার খেল! বছর পাঁচেক পর আবারও সেই ভারতকেই পেল ‘টাইগার’রা। টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরি, পাহাড়সম ২৯০ রানের টার্গেট- কোনো কিছুকেই সেদিন তোয়াক্কা করেনি বীর বাঙ্গালিরা। দুই ভায়রা ভাই মুশফিক, মাহমুদুল্লাহর কব্জিতে সেদিন যেন ভর করেছিল প্রিয় রানা ভাইকে হারানোর শোক থেকে পাওয়া শক্তি। অশোক ডিন্ডার বলে বাউন্ডারি মেরে ম্যাচ বের করে আনলেন মাহমুদুল্লাহ। কে জানে, সেদিন হয়ত মিরপুর, টিএসসির জনস্রোতের বুনো উল্লাসে শামিল হয়েছিলেন রানা নিজেও…
ভারতকে হারিয়ে আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর ‘টাইগার’রা এরপর পোষ মানাল শ্রীলঙ্কার সিংহদের। জিতলেই ফাইনালে- এমন সমীকরণ নিয়ে মাঠে নেমেছিল মুশফিক বাহিনী। নাজমুল হোসেনের নিখুঁত বোলিং, সাকিবের ঘূর্ণিতে ২৩২ রানেই থেমে যেতে হল জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারাদের। বৃষ্টি আইনে জয়ের জন্য দরকার ৪০ ওভারে ২১২ রান। তিন ম্যাচে তামিমের তৃতীয় অর্ধশতক, বল হাতে জাদু দেখানোর পর সাকিবের ৫৬ তে ১৭ বল বাকি থাকতে আবারও জয়ের উল্লাসে মাতল সমগ্র বাংলাদেশ। ১৯৯৭-এর পর প্রথমবারের মত কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল- প্রায় এক যুগ হারতেই দেখা বাংলাদেশী সমর্থকদের জন্য এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতই।
অবশেষে আসল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২২ মার্চ, ২০১২। সেদিনের সূর্যটা দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সদ্যই শেষ হয়েছে এসএসসি। ঘুমোতাম দিনে, জাগতাম রাতে। তবে ফাইনালের কথা চিন্তা করেই একটু ‘আর্লি’ উঠলাম সেদিন। ঐ সময় দুপুর ১টা আমাদের জন্য ‘আর্লি’ই বৈকি। ফোন দিলাম এক বন্ধুকে। স্কুলজীবনে কতবার যে একসাথে পালিয়ে মিরপুরে খেলা দেখেছি আর গলা ফাটিয়েছি- ইয়ত্তা নেই।
“কিরে কি মনে হয়? জিতব?”
“ধুর ************ (ছাপার অযোগ্য), কি ***** কস! আজকে বিকল্প আছে নাকি?”
আসলেই তো। আবার কবে এমন সুযোগ আসবে কে জানে। মোট ১৪ জন একসাথে দেড়টার দিক চলে গেলাম সেই বন্ধুর বাসায়। ১টি রুম, ১৪জন মানুষ, ২৮ জোড়া চোখ। মনে একটাই প্রার্থনা; রাতে যেন মাততে পারি বুনো বিজয়োল্লাসে। টসের সময় শুরু হল ধুঁকপুকানি। সুনীল গাভাস্কার কিছুক্ষণ আগেই বলেছেন, এই পিচেই পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩২৯ তাড়া করে জিতেছিল ভারত। কাজেই পরে ব্যাট করাটাই শ্রেয়। আর ভারত, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তো ‘চেজ’ করেই জিতেছিল বাংলাদেশ! ‘বাংলাদেশ হ্যাজ ওয়ান দ্যা টস’ শুনতেই মিরপুরের গর্জনে শামিল হলাম আমরাও। বন্ধুর বাড়ি যেন তখন এক টুকরো শের-এ-বাংলা। মুশফিকের “উই আর গোইং টু বোল ফার্স্ট” শুনেই আনন্দে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললাম। আহ! এই মূহূর্তগুলোতেই যেন বেঁচে থাকাটা সার্থক মনে হয়…
শুরুটা হয়েছিল স্বপ্নের মতই। প্রথম পাঁচ ওভারেই জামশেদ, ইউনিস সাজঘরে। নাজমুল, মাশরাফিতে দারুণ এক সূচনা। হাফিজও ফিরতেন পরের ওভারেই। মাশরাফির বলে পয়েন্টে ক্যাচ ফেললেন জহুরুল। সুযোগটা কাজে লাগালেন ভালমতই। ২২তম ওভারে রাজ্জাকের শিকার হয়ে ফেরার আগে করলেন ৪০ রান। ১৫তম ওভারে হঠাৎ ভুল বোঝাবোঝি। জহুরুলের মত সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না নাসির। দারুণ এক থ্রোতে রান আউট করলেন মিসবাহকে। শের-এ-বাংলা তখন আনন্দে আত্মহারা। পুরো দেশ যেন এক বিন্দুতে একত্রিত…
হাম্মাদ আজমকে নিয়ে উমর আকমলের ৬০ রানের পার্টনারশিপ দিয়ে ইনিংস পুনর্গঠনের প্ল্যান ভেস্তে দিলেন স্পিনজুটি সাকিব-মাহমুদুল্লাহ। ক্রিজে তখন সরফরাজ, পুরো টুর্নামেন্টে যিনি করেছিলেন মাত্র ১৯ রান। আর আফ্রিদি? বাংলাদেশের সাথে প্রথম ম্যাচে মেরেছিলেন স্বভাবসুলভ ‘গোল্ডেন ডাক’। কিন্তু সেদিন ফিরলেন অগ্নিশর্মা রূপে। সাকিবের বলে আউট হওয়ার আগে ২২ বলে করলেন ৩২ রান। ‘ক্যামিও’টা ঠিক কতটা কার্যকরী ছিল, জানা গেল ম্যাচ শেষে। গুলকে নিয়ে স্কোর ২০০ পার করলেন সরফরাজ। খেললেন জীবনের সেরা ইনিংস। তার ৪৬-এ সওয়ার হয়েই শেষ পর্যন্ত ২৩৬ করল পাকিস্তান, ‘মোমেন্টাম’-এর পাল্লা ঝুঁকে পড়ল পাকিস্তানের দিকে। ইতিহাস এবং আমাদের মাঝে তখন ব্যবধান ২৩৭ রানের।
‘টেনশনের মহৌষধ’ চা-সিগারেটের দাবি মেটাতে নেমে আসলাম বাড়ির নিচে সাদ্দাম মামার টং-এ। ছোট্ট সাদাকালো টিভিতে খেলা দেখছিলেন মামাও। চায়ের কাপগুলো এগিয়ে দেওয়ার সময় তার মুখে ছুটল শাহাদাতের উদ্দেশ্যে গালির তুবড়ি। পাশেই সিঙ্গারের শোরুম। ৫২ ইঞ্চির এক টিভিতে ম্যাচ দেখাচ্ছে। সামনে গোটা ত্রিশেক মানুষ, সবার মুখে একটাই কথা, “শ্যাষ ওভারটা মাইরে দিল রে”। মিশে গেলাম সেই জটলাতে, উদযাপনের পূর্বপ্রস্তুতিতে...
স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক সূচনা করলেন তামিম। কিন্তু নাজিমুদ্দিন! কচ্ছপের গতিতে রান করে আস্কিং রেটটা বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। প্রথম ১০ ওভারে রান এল ৩৫। চিমার বলে জীবন পেয়েও সেই শ্লথ গতিতেই এগুতে থাকলেন তিনি। কিন্তু তামিম ছিলেন স্বরূপে। ১৭তম ওভারে পূরণ করলেন নিজের টানা ৪র্থ অর্ধশতক। এরপরই ডাগআউটে কাকে যেন উদ্দেশ্যে করে একে একে দেখালেন চার আঙ্গুল, যা স্মৃতিপটে আজীবন থাকবে অমলিন। এই টুর্নামেন্টের আগেই বাদ পড়েছিলেন দল থেকে। ফিরেছিলেন হাজারও গঞ্জনা সয়ে। কোণঠাসা বাঘের মত ফিরেই জবাবটা দিলেন মাঠেই। হাঁসফাঁস করতে থাকা নাজিমুদ্দিনকে ঐ ওভারেই বিদায় করলেন আফ্রিদি। পরের ওভারেই আজমলের ‘দুসরা’য় কুপোকাত জহুরুল। সবাই যখন মুশফিকের অপেক্ষায়, তখন মাঠে নামলেন নাসির। কিন্তু তাকেও যেন পেয়ে বসল নাজিমুদ্দিনের ‘রোগ’। সিঙ্গেল বের করতেই রীতিমত গলদঘর্ম হলেন। রানের চাকা সচল রাখতে ২৩তম ওভারের প্রথম বলে পুল করলেন তামিম। ব্যাটে-বলে হল না। তালুবন্দি করলেন ইউনিস খান। পুরো মিরপুর জুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা। আমাদের মাথায় হাত।
সাকিব নামলেন। প্রথম বলেই মিড উইকেট দিয়েই সজোরে পুল করে বাউন্ডারি মারলেন। প্রাণের সঞ্চার হল শের-এ-বাংলায়। পুরনো উদ্যম ফিরে পেলাম আমরা। নাসিরের সাথে ৮৯ রানের দারুণ এক পার্টনারশিপে স্বপ্ন দেখাতে লাগলেন আমাদের। ৪৩তম ওভারে নাসির ফিরলেন, ৬৩ বলে করলেন মাত্র ২৮ রান। জিততে তখনও দরকার ৪৬ বলে ৬৭ রান। সংশয়, উৎকন্ঠায় পুরো দেশ। চোখজোড়া আটকানো স্ক্রিনে, আর করজোড়ায় বিধাতার কাছে জোড় প্রার্থনা।
মুশফিক নামলেন অবশেষে। প্রতি ওভারে রান প্রয়োজন প্রায় ১০ করে। যার ব্যাটে সবচেয়ে বেশি ভরসা পাচ্ছিলাম, সেই সাকিব ৪৪তম ওভারে চিমার বলে ‘স্কুপ’ করতে গিয়ে উইকেটটা বিলিয়ে আসলেন। আউট হয়েই ব্যাট দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন স্ট্যাম্পে, হয়ত নিজের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কথা ভেবেই। ৩৯ বলে প্রয়োজন ৫৮ রান, ক্রিজে আসলেন মাহমুদুল্লাহ। দলের দুই স্তম্ভ তখন ২২ গজে। আবারও বাঁধ সাধলেন চিমা। তার শর্ট বলেই ডিপ স্কোয়ার লেগে ধরা পড়লেন ‘মুশি’। প্রথমবারের মত হারের আশঙ্কা জেঁকে বসল। চারদিকে এত মানুষ, কিন্তু কি নির্মম এক নীরবতায় ঢাকা চারপাশ! কান পাতলে শোনা যাচ্ছিল পাশের মানুষটার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা হার্টবিটও। ২৯ বলে দরকার ৪৭ রান। নামলেন মাশরাফি। আফ্রিদির মতই ‘ক্যামিও’ খেলে উসকে দিলেন স্বপ্নের আগুনটা। মাহমুদুল্লাহর সাথে মাত্র ১৫ বলে ২৮ রানের ঝড়ো পার্টনারশিপ। ১৫ বলে তখন দরকার ১৯ রান। ‘হইব ভাই হইব। ইন শা আল্লাহ’ আশপাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল নির্ভয়ের ধ্বনি।
কিন্তু তখনই আবারও আত্মাহুতি! আজমলের বলে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন মাশরাফি। আবারও চাপে বাংলাদেশ। আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে পরের ৮ বলে ১০ রান করলেন মাহমুদুল্লাহ। শেষ ওভারে গড়াল খেলা। প্রয়োজন ৯ রান। চিমাকেই বেছে নিলেন মিসবাহ। প্রথম বলেই বিতর্ক। দুই রান নেওয়ার সময় চিমার সাথে ধাক্কা লাগল মাহমুদুল্লাহর, সত্যি বলতে চিমা ইচ্ছাকৃতভাবেই ধাক্কা দিলেন। সফলও হলেন মিশনে। ক্রিজে থেকে গেলেন রাজ্জাক। এসিসিকে ম্যাচ শেষে অভিযোগ জানালেও নাকচ হয় সেই আবেদন। পরের বলেই অবশ্য ১ রান নিয়ে ননস্ট্রাইকে ফিরে গেলেন রাজ্জাক।
পরের বলটা ডট। দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম আশেপাশে। ‘গেল!’ ‘হইবো না রে’ রব উঠতে লাগল একে একে। কিন্তু এমনটা মানতে প্রস্তুত ছিলাম না। পাকিস্তান পরিষ্কার ফেভারিট হলেও মন বলছিল, এই তো এখনই বাউন্ডারি মারবেন মাহমুদুল্লাহ। মনের বাসনাটাই সত্যি হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ৪র্থ বলে দুবার ফিল্ডিংয়ের ভুলে ৩ রান পেল বাংলাদেশ। কিন্তু ক্রিজে যে রাজ্জাক! ২ বলে তখনও দরকার ৪ রান। সাকিবের মত শর্ট ফাইন লেগের ওপর দিয়ে মারতে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন তিনি। শেষ বলে দরকার বাউন্ডারি। নামলেন শাহাদাত হোসেন রাজিব। সারাটা জীবন, এমনকি আজও, তিরষ্কার সহ্য করেই যিনি খেলে গেছেন। বল করলেন চিমা। লেগের বলটাকে মারতে পারলেন না রাজীব। প্রাণপনে ছুটলেন মাহমুদুল্লাহ। ১ রান। স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার। পাকিস্তানিরা মাতল উল্লাসে। আমরা নির্বাক। মাত্র ২ রানের জন্য স্বপ্ন পরিণত হল দু:স্বপ্নে...
হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন মাহমুদুল্লাহ। ড্রেসিং রুমে শূন্য চোখে তাকিয়ে সাকিব, তামিম, মুশফিকরা। রূপকথার মত এক টুর্নামেন্টের শেষটা হল ট্র্যাজেডিতে। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে স্বজনহারানোর কান্নার রোল পড়ল আমাদের চারদিকে। অনেক কষ্টে চোখে রুমাল চেপে সামলে নিলাম নিজেকে। ছেলেদের যে কাঁদতে নেই! কাঁদলেন সাদ্দাম মামাও। কাঁদল পুরো মিরপুর। মনে বাজছিল হায়দার হোসেনের সেই গান। আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার...
ম্যাচ শেষে পুরষ্কার বিতরণীতে সেদিন অঝোরে কাঁদলেন আনামুল, নাসির। সাকিবের বুকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপালেন মুশফিক। বন্ধুকে সামলাতে গিয়ে হাজার চেষ্টায়ও নিজেকে সামলাতে পারলেন না সাকিব। কাঁদলাম আমরাও। কিন্তু এই অশ্রুতে কেবল বেদনা ছিল না। ছিল গর্ব, ছিল নতুন দিনের প্রত্যয়। এই বাংলাদেশ হারার আগে হার মানে না, এই বাংলাদেশ এখন সমানে সমান টেক্কা দেয় সবাইকে- এর চেয়ে গর্বের আর কীইবা হতে পারে?
ঐ ম্যাচের ৬ বছর পূরণ হল আজ। কি আশ্চর্য! আজও বৃহস্পতিবার! সিঙ্গারের সেই শোরুম আর নেই আগের জায়গায়। বন্ধু আমার পাড়ি জমিয়েছে কানাডায়। আড্ডার সেই আখড়া, সেই সাদ্দাম মামার টং থাকলেও নেই তিনি। সংসারের হাল ধরেছে তার ছেলে। বাংলাদেশ যেদিন পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ করল, সেদিন গিয়েছিলাম টংয়ে। ছেলেটার নাম মজিদ। জিজ্ঞেস করলাম,
“কিরে কেমন লাগল খেলা?”
“ভালা ভাইজান। খুব ভালা লাগসে। তয় আব্বায় থাকলে আরও ভালা লাগত”
মজিদকে কেমন যেন অন্যমনষ্ক লাগে। চায়ের কাপে চুমুকটা দিতে গিয়ে থমকে যাই। মাঝের ৬টা বছর কত কিছুই না পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের গোণায় না ধরার দিনগুলো পালিয়েছে অনেক আগেই। সিরিজ জিতেছি ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানের সাথে। বিশ্বকাপে হারিয়েছি ইংল্যান্ডকে। টেস্ট জিতেছি শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড এমনকি অস্ট্রেলিয়ার সাথেও। খেলেছি চাম্পিয়নস ট্রফি, হারিয়েছি নিউজিল্যান্ডকে। ‘১২-এর ফাইনালের মত তীরে এসে তরী ডুবিয়েছি ভারতের বিপক্ষে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে। এই তো গত সপ্তাহেই শেষ বলে ৬ খেয়ে হেরেছি নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল। কেঁদেছি অনেকবার। কিন্তু ‘১২-এর সেই এশিয়া কাপ ফাইনালের মত কষ্ট পাইনি। বিশ্ব দরবারে এখন আমাদের নামডাক আছে, কিন্তু ট্রফিকেসটা যে এখনও শূন্য! আর কতদিন ‘ভাল খেলে হেরেছি, দল নিয়ে গর্বিত’ বলে কাটাব জানি না। শুধু একটা বার, শুধু একটা বার বাংলাদেশকে ফাইনাল জিততে দেখতে চাই। শুধু একটা বার মাততে চাই বিশ্বজয়ের উল্লাসে। শুধু একটা বার, যাতে দ্বাদশের সেই বৃহস্পতির দু:খ ঘোচাতে পারি। কিছুটা হলেও...
- 0 মন্তব্য