স্মৃতির দুয়ারে কড়া নেড়ে...
পোস্টটি ১১৫৯০ বার পঠিত হয়েছেমেঘে মেঘে বেলা কম হয়নি। বয়সও থেমে নেই। বেড়েছে অভিজ্ঞতার ঝুলি, জমেছে স্মৃতির অসংখ্যা নুড়ি। তাই কোনো স্মৃতি-কথা লিখতে গেলেই বেশ হ্যাপা সামলাতে হয়। স্মৃতিরা সব দল বেঁধে বড্ড শোর করে যে! এই যে আমাকে মনে করো! হুঁহ, আমিও আছি! আমার কথা লিখতে হবে কিন্তু! এত এত স্মৃতির ভিড় আর অভিজ্ঞতার জটলা থেকে ছেঁকে টেকে মুখরোচক (কিংবা পাঠ-রোচক!) যে কিছু তুলে আনবো, সে সম্ভাবনাও গুড়েবালি। অধম বড়জোর মিনিট-দুই দৌঁড়াতে পারি, উসাইন বোল্ট তো আর হতে পারি না! মনের আনন্দে খানিক ক্রিকেট খেলতে পারলেও, সাকিব আল হাসান হওয়ার সামর্থ্য কি আর আছে! কিংবা ফুটবলটায় খানিক লাথালাথি করা যায় হয়তো, তাই বলে লিওনেল মেসি তো আর হওয়া যাবে না!
সমস্যাটা এখানেই। স্মৃতি নিয়ে লিখতে তো পারি, কিন্তু সে লেখা আসলে পাঠযোগ্য হবে তো? ওহ হো, ‘হেয়ার এন্ড দেয়ার’ টাইপ উলটাপালটা আলোচনায় পাঠকের মূল্যবান সময় নষ্টের কোনো মানে হয় না। তার’চে মূল আলোচ্যে ঢুকে পড়াই বোধহয় ভালো। বরাবরের মতো পাঠকের উদারতার আশাবাদ-ই থাকল না হয়!
শৈশবের কলরব
বছর দশেক বয়স তখন। বিশ্বকাপ নিয়ে জোর আলোচনা। আব্বুর বদৌলতে ক্রিকেটটা গুলিয়ে খেলেও ফুটবলে অত আগ্রহ নেই। খেলতেও ভয় পাই। শুনেছি, আব্বু রাতারাতি আমাদের সাদাকালো টিভিটা কিনেছিলেন ’৯৪-এর বিশ্বকাপ দেখবেন বলে! সেই ’৯৪ তো দূরের, ’৯৮ এর কোনো স্মৃতিও স্মৃতির মানসপট থেকে উদ্ধার করতে পারি না। তাই আমি দেখেছি, আব্বু ঘরণী করেছেন ক্রিকেটকেই। হয়তো ফুটবল হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার মতোই ছিল। অথবা মৌসুমে মৌসুমে জমে উঠা প্রেম ছিল তা, বছরজুড়ে নিত্যসঙ্গী ক্রিকেট-প্রেমের মতো ছিল না। আমিও তাই ফুটবলের চেয়ে বেশী আগ্রহ আর আনন্দ পেতাম ক্রিকেটেই।
সেবারও এই আগ্রহে-আনন্দে কোনো হেরফের হয়নি। হিফজখানায় (যেখানে পবিত্র কুর’আন শরীফ মুখস্ত করানো হয়) পড়ি তখন। রিয়াদ ভাই, ফুরকান ভাই, নওশাদ ভাই, তারেক সবাই আর্জেন্টিনার কড়া সমর্থক। রায়হান ছিল ব্রাজিল-ভক্ত। তাদের মধ্যে খুব লাগত। কোয়ালিটি আইসক্রিমের কাঠিতে সেবার বিশ্বকাপের আসরগুলো লেখা থাকত, সেগুলো জমানোরও খুব হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বেশী সম্ভবত ফুরকান ভাই-ই জমিয়েছিল। আমিও তাদের সঙ্গে আনন্দে মাতি অনেকটা কিছু না বুঝেই। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন দল সমর্থন করি? খবর নিয়ে জানলাম, ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। ব্যস! পেয়ে গেছি, আমার দল। চ্যাম্পিয়নদেরই সমর্থক হবো। হায়! আমার কি দূর্ভাগ্য! ফ্রান্স সেবার প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিল। যদ্দুর মনে পড়ে বিকেল বেলা সেনেগালের কাছে ফ্রান্সকে হারতে দেখলাম। হারের শোকও কাটিয়ে উঠলাম মুহূর্তেই। এবার আমার দল, সেনেগাল। যারা চ্যাম্পিয়নদের হারাতে পারে, তাঁরা নিশ্চয় যেনোতেনো কোনো দল নয়। সেই সেনেগাল সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল। ব্রাজিলের পেন্টা, জার্মানীর অলিভার কান, রোনালদোর সেই অদ্ভুতুড়ে হেয়ারকাট, রোনালদিনহোর অবিশ্বাস্য গোলটা! এখনো মনে আছে, হিফজখানা থেকে দুপুরে ভাত খেতে এসেছিলাম বাসায়, আর রোনালদিনহো প্রায় মাঝমাঠ থেকে অবিশ্বাস্য ফ্রি-কিকটা নিয়েছিলেন! জাপান-কোরিয়া আয়োজক ছিল বলে খেলাগুলো সব দুপুর-বিকেলে দেখতে পেতাম।
ফুটবল ‘বিশ্বকাপ’ নামের উন্মাদনার সাথে মাত্রই পরিচয় হয়েছিল সেবার, উন্মাদ হলাম পরেরবার।
কৈশোর-আবেগে থরথর কেঁপে উঠা
খেলার পাতায় পুরো মজে গেছি ততদিনে। ফুটবলটা আর মৌসুমী-ভালোলাগা নেই, মোটামুটি ভালোই খবরাখবর রাখা হয়। ফিগো-রোনালদো-জিদান-বেকহামদের গ্যালাকটিকোতে বুঁদ হয়ে ২০০২ বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে ক’দিন রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থন করলেও পরে কীভাবে যেন বার্সালোনা সমর্থক হয়ে গিয়েছিলাম!
ক্যানেভারো, গাত্তুসো, বুফন, লেম্যান... বিকেলবেলা ফুটবল খেলতে গেলেই এই নামগুলো ফিরে আসত। অলিম্পিক বার-এ কখনো বুফন হতাম, লেম্যান হতাম, আবার ডিফেন্সে দাঁড়িয়ে নিজেকে ক্যানেভারো পরিচয় দিতাম!
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ‘ফিরে দেখা বিশ্বকাপ’ পর্বগুলি পড়ি। হাঙ্গেরী আর নেদারল্যান্ডের জন্য অদ্ভুত এক বেদনা অনুভূত হয়। জার্মানীর জন্য টের পাই প্রবল ঘৃণা। জার্মান-যন্ত্র বুঝি শুধু সুন্দর ফুটবল হন্তারকই নয়, আমার আনন্দ, আবেগ আর ভালোবাসারও হন্তারক! জাঁ ফন্টেইন, ক্রুইফ নামের ডাচ-রাজপুত্র, রবার্তো বাজ্জিও, মারিও ক্যাম্পাস, পাওলো রসি, ‘দ্য কাইজার’ বেকেনবাওয়ার, জার্ড মুলার... কত কত নামের সাথে পরিচয় হয়! স্যান্ডর ককসিস, মেজর পুসকাস, ন্যান্দর হিঁদেকুটিদের নিয়ে গড়া হাঙ্গেরীয়ানদের সেই সোনালী প্রজন্ম! গারিঞ্চা-পেলেদের স্বপ্নপূরণ আবার সক্রেটিস-জিকোদের স্বপ্নভঙ্গ... কত কি! টেলে সান্তানা নামের একজন একগুঁয়ে কোচের আপোষহীন সুন্দর ফুটবল। পড়ি আর জানি। অবাক হই, আশ্চর্য্য হই, আপ্লুত হই।
আর কিশোর মনে সবচেয়ে বেশী ঝড় তোলেন একজন। তিনি বেঁটে, তিনি ছোটোখাটো, তিনি পাগলাটে, তিনি ক্ষ্যাপাটে, তিনি একগুঁয়ে। তারপরও আবেগের সমস্ত অলিগলিতে তিনি বিচরণ করেন সাড়ম্বরে। অনেকেই তাঁকে ভালোবেসে ফুটবল-ঈশ্বর বলেন। অবিসংবাদিতভাবে সর্বকালের সেরা বললে- কেউ তর্ক করেন, কেউ মেনে নেন। কেউ তাঁকে ঘৃণা করেন, জোচ্চোর বলেন, আবার কেউ-বা ঐ জোচ্চোরতার জন্যেই তাঁকে আরো বেশী ভালোবাসেন।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামের এই মানুষটি কীভাবে কৈশোরের সমস্ত আবেগকে আন্দোলিত করেছিল সে এক রহস্য বটে! কোডেসালকে কখনোই ক্ষমা করতে পারিনি তা-ও এই মানুষটির অশ্রুসজল মুখটি দেখেই। জার্মানীর প্রতি প্রবল ঘৃণাও বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল সে-ও ক্লিন্সম্যান-ম্যাথিউজদের অমন অন্যায় আচরণের কল্যাণে। যুক্তি-বুদ্ধির মাথা খেয়ে ‘হ্যান্ড অব গড’-কে নির্দ্বিধায় সমর্থন করেছি, ম্যারাডোনা-উন্মাদনাতে ভেসেছিলাম বলেই। কিন্তু কখনো তাঁর খেলা না দেখা এক বঙ্গসন্তানের কীভাবে এই আবেগ এলো, সে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ রহস্য!
বুঝতেই পারছেন, ২০০৬ বিশ্বকাপে আমি পাকাপাকিভাবে আর্জেন্টিনা-সমর্থক বনে গিয়েছিলাম। হিফজখানা ছেড়েছি ততদিনে দুই বছর হয়ে গেছে। একেকজনের পথ একেকভাবে বেঁকে গেছে। তারপরও মনে আছে ইতালি-জার্মানী সেমিফাইনালের পরদিন রিয়াদ ভাইয়ের সাথে সকাল বেলা দেখা হতেই প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল, খেলা দেখছিলা?
রিয়াদ ভাই খেলা দেখেছিল। লুকা টনির জোড়া গোল-এ জার্মানীর পরাজয় শুনে মুহূর্তেই কেমন আনন্দ যে পেয়ে বসেছিল!
সেবারের আর্জেন্টিনা-জার্মানী কোয়ার্টার ফাইনাল যতটা যন্ত্রণা দিয়েছিল, তেমন যন্ত্রণা বুঝি আর কোনো ফুটবল ম্যাচ দেখে কখনো হয়নি। হোসে পেকারম্যান কেন রিকুয়েলমেকে তুলে নিলেন, কেন মেসিকে নামালেন না, বিপরীতে ক্লিন্সম্যান কীভাবে অসুস্থ বালাককে পুরোটা সময় খেলিয়ে গেলেন! এদিকে আবেদানজারির ইঞ্জুরীটা কি ইচ্ছাকৃত ছিল? আমাদের আড্ডায়, আলোচনায় অনেকদিন দখলে ছিল এসব।
ছোটবোন আর আমি দু’জনই কেমন মিঁইয়ে গিয়েছিলাম! সারারাত ছটফট করছিলাম। মনে হচ্ছিল, ইশ, সকালে যদি এমন কোনো ঘোষণা আসে, ম্যাচটা আবার হবে! অথবা যদি বলা হয়, জার্মানীর এই এই ভুলের কারণে ম্যাচটা আর্জেন্টিনাকে দিয়ে দেয়া হলো! শিশুতোষ কত চিন্তা, কত ভাবনা! শুধু একটাই চাওয়া- কোনোভাবে যেনো আর্জেন্টিনা আবার ফিরে বিশ্বকাপে!
কৈশোরের পালে সবে হাওয়া লেগেছে তখন, আবেগটাও ছিল তাই বড্ড মাত্রাছাড়া। রাত জেগে প্রথম খেলা দেখা, কি যে শিহরণ! আব্বু তখন বদলির সুবাদে রাঙামাটির লংগদুতে। সপ্তাহান্তে ফিরে যখন শুনলেন, আজকাল রাত জেগে খেলা দেখা হচ্ছে, বেশ বকেছিলেন তখন। আমাকেও, আম্মুকেও। অথচ আব্বুও আর্জেন্টিনা-সমর্থক শুনে কি যে আনন্দ পেয়েছিলাম! পরে আব্বু ফিরে গেলে রাত জেগে খেলা আর দেখেছিলাম কি-না এখন অবশ্য আর মনে নেই। তবে ফাইনালটা যে ঘুম ঘুম চোখে দেখতে হয়েছিল তা মনে আছে বেশ ভালোভাবেই।
তারুণ্যের প্রথম প্রহরে
সুকান্তের ‘আঠারো বছর বয়স’ খুব আন্দোলিত করে তখন। থুতনির নীচে কৃষ্ণকেশ উঠি উঠি করছে। তারুণ্য, তরুণ, আঠারো শব্দগুলো ভীষণ দোলা দেয়। ইন্টারমিডিয়েটের চৌকাঠে সদ্য পা পড়েছে, সবমিলিয়ে সময়টা কেমন যেন ঘোরজাগানিয়া।
ম্যারাডোনা দায়িত্ব নিয়েছেন আকাশী-নীল পতাকাবাহীদের। পাগলাটে বা ছন্নছাড়া হলেও ‘ম্যারাডোনা’ নামে একটা জাদু আছে, মোহ আছে। শুধু এই একটা নাম জপে মাঠে নামলে যে কেউ সর্বস্ব উজার করে দিতে পারেন নির্দ্বিধায়। আর্জেন্টাইনদের কাছে তিনি ফুটবল-ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরের দূত। তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েছেন তবে সোনা ফলবেই। সবশেষ সোনার ফলনটা যে তাঁর পায়ে (কিংবা হাতেও!) ফলেছিল!
আমরাও আশায় বসত গড়ি। ‘ম্যারাডোনা-মেসি’ যুগল জাদুর কাঠির স্পর্শে সব ত্রুটি, সব ফাঁকফোকর অনায়াসে জয় হয়ে যাবে। সোনালী ট্রফিটা গুরু-শিষ্য পরম আনন্দে উর্ধ্বপানে উঁচিয়ে ধরবেন অবশ্যই। কল্পনা বা স্বপ্ন সবসময় বাস্তবতার রঙে রঙিন হয় না। কোয়ার্টার ফাইনালে আবার সেই জার্মান-বাঁধার সম্মুখে পড়ে ছত্রখান হয়ে গেল সব স্বপ্ন, সব আনন্দ। আমার বিশ্বকাপও শেষ হয়ে গেল সেখানেই। স্পেন-নেদারল্যান্ড ফাইনাল নিয়ে খুব একটা আগ্রহ টের পাইনি।
তবে হ্যাঁ, সেবার প্রথমবারের মতো জার্মান-ফুটবলে মুগ্ধ হলাম। ওজিল-মুলার-শোয়েনস্টাইগাররা মোহনীয় কোনো জাল বিছিয়ে মোহাবিষ্ট করেছিলেন বুঝি! জোয়াকিম লো নামের তরুণ কোচের কোচিংয়েও মুগ্ধ হলাম। জার্মান তরুণ দলটি যেন এক ঝটকায় ক্লিন্সম্যান-লেম্যান-বালাকদের শাপ-মুক্ত করে দিলেন!
কিন্তু আর্জেন্টিনা যে জার্মান শাপমুক্ত হতে পারল না! যেমন পারেনি নব্বইতে, ২০০৬ ও পরের আসর ২০১৪-তেও!
হাসির একখান অভিজ্ঞতাও আছে এই আসরে। শাকিরা ‘ওয়াকা ওয়াকা’ ঝড় তুলে খোকা-বুড়ো সবাইকে নাচিয়ে দিয়েছিলেন। ভাগ্নে মুয়াজের বয়স তখন হয়তো দু-তিন, তার বড় ভাই ত্বকির বয়স কত আর, পাঁচ-ছয় হবে বোধহয়! ভিয়া-মেসি-রোনালদো আর ওয়াকা ওয়াকাতে তারাও নাচছে, কাঁপছে। ত্বকি বললো- ‘আমি মেসি।’ জবাবে মুয়াজ বলে উঠল- ‘তাহলে আমি বোলাপোঁকা।’
ছোট্ট মুয়াজ আসলে মেসি-কে ‘মাছি’ ভেবেছিল যে!
বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে
দ্বিতীয় সেমিস্টার চলছে তখন। একদিন ক্লাসের ফাঁকে হঠাৎ শুরু হলো চাঁদা তোলা। একটা বল কেনা হবে। সেই বল কেনার জন্য কত কাঠখড় পুড়িয়ে স্টেডিয়াম গেল ক’জন, তার পরদিন আমাদের মধ্যে সে কী উৎসব উৎসব ভাব! বয়স, সময় ভুলে গিয়ে সবাই যেন ছোট্টটি হয়ে গেলাম এক নিমেষে। ডিপার্টম্যান্টের সামনের মাঠ আর সেন্ট্রাল মাঠে সেই বল নিয়ে কত দৌঁড়াদৌঁড়ি! অফসাইড হয়ে বসে থাকতাম বলে কত বিদ্রুপ আর তামাশার শিকারও যে হয়েছি!
জার্মানী আর ব্রাজিল সমর্থকদের সঙ্গে কত্ত গলাবাজি! ইনজামুল ছিল ব্রাজিল সমর্থক। ফাইনাল শেষে সেহরীতে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ‘কি অবস্থা? কেমন বোধ হচ্ছে?’ আস্তে করে শুধু বলেছিলাম, ‘কেমন বোধ আর হবে?’ সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তর ছিল, ‘ঠিক আছে, পরে ফোন করবো। আগে একটু ঠিক হও।’ বেঠিক কি ছিলাম? জানি না আসলে!
এত কাছে গিয়ে গোটজে নামের এক ছটফটে জার্মান তরুণের জন্য যে সব এমন ভন্ডুল হয়ে যাবে কে জানতো! দিন কয়েক আগেই, ঠিক এমন সেহরীর পর নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটায়, রোমেরোর পেনাল্টি-বীরত্বে কি একখান লাফ যে দিয়েছিলাম! পায়ের মুড়ি খানিক ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। আর এদিন, ব্যথা বুঝি সর্বাঙ্গে!
আলসান্দ্রো সাবেলা রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার নড়েবড়ে রক্ষণকে কি এক মন্ত্রবলে তিনি দূর্ভেদ্য দূর্গে পরিণত করেছিলেন। এক পা এক পা করে ছয়-ছয়টি ধাপ অতিক্রম করে সাত নম্বর ধাপে পৌঁছেছিল আর্জেন্টিনা। ২৮ বছর ধরে অনতিক্রম্য সেই ধাপ আর পেরোনো গেল না। নির্বাক বিমূঢ়তায় অবলোকন করলাম শ্রুলে, লাম, ক্লোসা, গোটজেদের বাঁধনহারা উদযাপন। হিগুয়েন-পালাসিওদের মুন্ডুপাত করার শক্তিটুকুও তখন আর অবশিষ্ট নেই।
সোনালী ট্রফিটা কত কাছে, তবুও কত দূরে! কী যে দুঃসহ এমন ব্যর্থতার ব্যথা!
অবশেষে এইবার
কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে আর্জেন্টিনা, আর কোথায় বাংলাদেশ! তবুও ওই আকাশী-নীল রঙে এত আবেগ আসে কোথা থেকে আমাদের? আমি জানি না আসলে। এ ভীষণ জটিল মনস্তত্ত্ব। বিশ্বকাপ সংখ্যা বা জয়-পরাজয় দিয়ে এই আবেগ বিচার্য্য হয় না, এই আবেগ বিচার্য্য হবে হয়তো আবেগ দিয়েই।
মেসি-ম্যারাডোনোর বাঁ পা অদ্ভুত আনন্দে উদ্বেলিত করে আমাদের। আর্জেন্টিনার জন্য কোমর বেঁধে ঝগড়া, মেসির জন্য ডজন ডজন যুক্তি খাঁড়া, ম্যারাডোনার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা... কীভাবে, কেন, কোন পথে যে আসে, কে জানে! যিনি এই অদ্ভুত মনস্তত্ত্বের কারিগর, ব্যখ্যাটা তিনিই জানেন আসলে।
এবারের বিশ্বকাপটা রোযার শেষদিকে শুরু হচ্ছে। একদিক দিয়ে ভালোই ব্যাপারটা। গতবার রোযায় পড়েছিল। বছরান্তে সৃষ্টিকর্তা যে বোনাস দেন, তখন আমরা সেই বোনাসের সার্থক ব্যবহার ভুলে মেতে উঠেছিলাম অন্য আলোচনায়। এবার আর সে সুযোগ থাকছে না। বছরান্তের বোনাস শেষ হলেই যে ব্যাপক আকারে বিশ্বকাপ-উচ্ছ্বাসে বুঁদ হবে সবাই!
এই দেখুন, আবার ট্র্যাক বদলে গেছে। কি আলোচনা থেকে যে কোথায় চলে যাই!
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ খানিক চুকে গেছে। ঝক্কি-ঝামেলাহীন হয়ে হয়তো উপভোগ করা যাবে এবারের আয়োজন। এবারো আকাশী-নীল খামেই স্বপ্নটাকে সিলগালা করে রেখেছি। একটু একটু করে স্বপ্নটা খাম থেকে বেরিয়ে বিশ্বকাপের আকাশটাকে আকাশী-নীলে রাঙিয়ে দিক! আমরা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আনন্দে মাতি। বহুদিন এই আনন্দে মেতে উঠতে পারি না যে!
সোনালী ট্রফিটায় চুমু এঁকে দিচ্ছেন ‘লিওনেল মেসি’ নামের ফুটবল রাজপুত্তুর, অনিন্দ্য সুন্দর এই দৃশ্য দেখার আন্দন কেমন হয় জানতে ইচ্ছে হয় যে! বড় দেখতে ইচ্ছে হয় যে!
- 0 মন্তব্য