• ফুটবল

বিষাদ বেদনার টুকরো হাওয়া

পোস্টটি ৩৪৩৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

মহাকালের মহা বুভুক্ষু সময় প্রতিনিয়ত গিলে খাচ্ছে আমাদের সময়, কাল, ক্ষণ। আনন্দ-বেদনার মুহূর্তগুলোও টুপ করে কখন যে গিলে ফেলে টেরই পাওয়া যায় না। গত একটি মাস কেমন ফুটবলীয় মহোৎসব দেখতে দেখতে কেটে গেল। তর্ক-তত্ত্ব, আলোচনা-আড্ডা, বিশ্লেষণ-ব্যবচ্ছেদ... এই করতে করতে কখন যে মহাকাল ব্যাটা আমাদের গোটা ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি দিবস-রজনী গিলে খেল, বুঝতেই পারলাম না!

স্মৃতির পাতা থেকে যদি সেই দিনগুলির খেরোখাতাটা টেনে নিয়ে বসি, তাহলে সেখানে গিজগিজ করছে কত চিত্র-বিচিত্র অভিজ্ঞতা! চিৎকার-টিটকারি, উত্তেজনা-উল্লাস, কী হয় কী হয় সংশয়, নিরেট মুগ্ধতা ও ভীষণ বিরক্তির সাথে মাঝে মধ্যে হয়তো উঁকি ঝুঁকি দেবে একটুকরো বিষণ্ণ হাওয়া ও বেদনাবিধুর কিছু মুহূর্ত। এই বিশ্বকাপ সময়টাতে চিত্তে কখনো কখনো আনন্দ-হিল্লোলের অফুরান ফোয়ারা বইলেও, আবার কখনো-সখনো আক্ষেপ-হাহাকারের আঘাতও সইতে হয়েছে যে!

 

না, বিভ্রান্ত হবেন না, প্লীজ! আমি জার্মানী-ব্রাজিল সমর্থক নয় সত্যি, তাই বলে ফরাসী বিপ্লবে আর্জেন্টিনার উড়ে যাওয়ার মনোকষ্ট জানাতে এখানে আসিনি। স্পেন-বেলজিয়ামের আক্ষেপ-গল্পও আজকের বিষয়বস্তু নয়। আজ শুধু নিজের, একদম আমাদের নিজস্ব কিছু যন্ত্রণা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবো বলে এই আলেখ্যের সূত্রপাত ঘটিয়েছি।

 

আচ্ছা, বেলজিয়ামের খেলা কেমন লেগেছে আপনাদের?

দুর্দান্ত না!

বেলজিয়াম-জাপান ম্যাচটা এখনো চোখে লেগে আছে যেন! জাপানীরা কি অভাবনীয় ফুটবলটাই না খেলল! ধারণা করছি, ওদের এই অগ্রগামিতার স্বরুপ অব্যহত থাকলে, জাপান ফুটবল খুব শীঘ্রই বিশ্বকাপের ইতিহাসে নতুন কোনো অধ্যায় রচনা করতে সমর্থ হবে।

পাঠ অভ্যাস যাদের আছে তাঁরা জানেন, পাঠককুল বিশ্বকাপের দর্শক হওয়ার সাথে সাথে মনোযোগী পাঠকও বনে যান। নিত্য-নতুন কত গল্প-ইতিহাস জানা হয়ে যায়!

বেলজিয়ান ফুটবলে এই সোনালী প্রজন্ম কীভাবে এলো, হ্যাজার্ড-ডি ব্রুইন-কর্তোয়ারা তিলে তিলে কত পরিশ্রম আর পরিকল্পনার ফসল হিসেবে উঠে এসেছেন, সব জানা হয়ে যায় আমাদের। জাপানী ফুটবলের নির্ভুল কক্ষপথও জানতে পারি আমরা।

আর এসব পাঠশেষে প্রতিক্রিয়ার মুহূর্তে আমাদের ঘিরে ধরে হাহাকারের এক দমকা হাওয়া। ইশ, যদি আমাদের পরিকল্পনাও...!

 

ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল দারুণ চমক দেখিয়েছে। সেই চমকের পেছনের নিষ্ঠাবান পুরুষটি হলেন- ক্রোয়েট কোচ যলাতকো ডালিচ। তাঁর কোচিং, তাঁর দর্শন নিয়ে কেউ কথা বলতে আসেনি। তাঁর দলে বাইরের কেউ নাক গলায়নি, দলের জন্য সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নেয়ার চূড়ান্ত অধিকার তাঁরই ছিল। স্ট্রাইকার কালিনিচকে বাড়ির ব্যাগ গোছাতে বাধ্য করেছেন, তাঁর সিদ্ধান্ত প্রত্যাখানের শাস্তিস্বরুপ। তাঁকে এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাও নিঃসন্দেহে ক্রোয়েশিয়া ফুটবলের অভিভাবক সংস্থাই দিয়েছিল।

দিদিয়ের দেশমকে নিয়ে অভিযোগের অন্ত না থাকলেও, তাঁর উপর ভরসার হাতটা ঠিকই রেখেছিল ফ্রেঞ্চ ফুটবলের নিয়ন্ত্রকেরা। এক-দুইদিন নয়, সাফল্যহীন ছয়-ছয়টি বছর কাটানোর পরও। জোয়াকিম লো, গত ১২টি বছর ধরে সামলাচ্ছেন জার্মান ফুটবলের দায়িত্ব। এই সময়ে জার্মানীর শো-কেস সেজেছে কেবল ১টি বিশ্বকাপ ও ১টি কনফেডারেশন ট্রফিতে। ট্রফি-বুভুক্ষু ব্রাজিলও ‘প্রফেসর’ তিতের হাতে দায়িত্ব সঁপে, দায়িত্ব সেরেছে। ফুটবল দল নিয়ে কোচকেই মেনেছে সর্বেসর্বা। সাউথগেটের সাফল্যেও আছে ওই অভিভাবকদের ভরসার হাত।

কোচই তো একটি ফুটবল দলের ‘সর্বেসর্বা’ হবেন, এই আর নতুন কি! এটা নিয়ে এত কথা বলার দরকারটাই বা কি?

না, পাঠক! সবসময় তা হয় না। তাহলে এই বঙ্গদেশে একজন ভিনদেশী কোচ কেন বলবেন- “এই দেশে সবাই ফুটবল বোঝে, কেবল আমিই বুঝি না!”

আমরা কতটা ফুটবলবোদ্ধা, সে জ্ঞান গত এক মাসের অভিজ্ঞতায় আবার নতুন করে নিশ্চয় উপলব্ধি হয়েছে আপনার।

 

ছেলেবেলায় জর্জ কোটান, অটো ফিস্টারদের কথা শুনতাম। টোগোকে নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়ে তো অটো ফিস্টার এই দেশে বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। তারপর ম্যারাডোনার দেশ থেকে ক্রুসিয়ানি এলেন, পেলের দেশ থেকে ডিডো এলেন, কিন্তু সাম্বা ছন্দ বা আকাশী-সাদার নান্দনিকতা, কোনোটাই আমাদের পাওয়া হয় না।

তবুও তখন তো ফুটবল কোচ বা বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য কিছু আলোচনা বরাদ্দ ছিল, এখন যে তাও নেই!

বিশ্বাস হচ্ছে না? প্রমাণ চান?

আচ্ছা, বলুন তো বাংলাদেশ ফুটবল দলের বর্তমান কোচ কে?

কি, মনে পড়ছে না! মাস-দুয়েক আগে নিয়োগ প্রাপ্ত ‘জেমি ডে’ নামের ইংলিশ ভদ্রলোক আলোচনার কোথাও নেই, তাঁকে আমি-আপনি বা আমরা চিনবো কোত্থেকে?

ক্রুইফের দেশ থেকে বড় আহ্লাদ করে লোডভিক ডি ক্রুইফকে আনা হয়েছিল, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই। ক্রুইফ তিন দফায় চেষ্টা করেও আমাদের দেশে থিতু হতে পারেননি। এই না পারার দায় কার?

উত্তর নেই। জবাদ দেয়ার কেউ নেই যে!

 

সারা বছর খেলার মতো পরিবেশ বিরাজ করে না, আইসল্যান্ডে। তাই ওরা সেভাবে পরিকল্পনা করে, সেভাবে প্রস্তুতি নেয়। পরিকল্পনার ফসলও ঘরে তোলে বছর কয়েকের মধ্যে। অথচ যে দেশে সারা বছর ফুটবল খেলার মতো অবস্থা বর্তমান, সে দেশ কেবল পরিকল্পনার অভাবে পিছিয়ে যেতেই থাকে। আমরা বিমুগ্ধ চোখে আইসল্যান্ড-রুপকথা চাক্ষুষ করি, স্বদেশের ফুটবল অবনমনে কোনো ভাবান্তর অনুভব করি না!

 

বাংলাদেশ ফুটবলের শ্রেষ্ঠসন্তান সভাপতির আসন অলংকৃত করছেন- এটা যতটা আশার আলো হয়ে এসেছিল, ঠিক ততটাই হতাশ করেছেন তিনি। তিনি স্বপ্ন দেখান, আমরা স্বপ্ন দেখি। কিন্তু স্বপ্নপূরণের পথে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।

শুধু তাঁর কথা বলেই-বা কী হবে? আমরা নিজেরা কি করছি?

দূর দেশের ফুটবল নিয়ে যত উৎকন্ঠা-উত্তেজনা, তার সিকিভাগ নিবেদনও যদি স্বদেশের ফুটবলের জন্য দেখাতে পারতাম! ‘ধুস শালা! এই দেশে কিচ্ছু হবে না।’ বলেই খালাস আমরা, দেশের ফুটবল নিয়ে কথা বলবো সে সময় কোথায়! বিশ্বকাপ শেষ, ক্লাব মৌসুম শুরু হবে, তা-ই নিয়ে আড্ডা জমবে, আলোচনা হবে।

 

দেশীয় ফুটবলের গুমোট হাওয়া যতবার ভাবনার রেখা পথে হানা দিয়েছে, ততবারই বিশ্বকাপ মুহূর্তগুলো কেমন পানসে ও যন্ত্রণার হয়ে গেছে। ইশ! যদি পরিকল্পনার জায়গাটা ঠিক রাখা যেত! একজন যদি স্বপ্নপূরণের কারিগর হয়ে পথ বাতলে দিতেন!

বিশ্বকাপের বিশ্ব আসরে তাহলে কি আমাদের লাল সবুজটাও উড়ত না? পানামার সেই গোলদাতার মতো আমাদের কেউ কি আধ ডজন গোল হজমের লজ্জা ও সংকোচ ভুলে কীর্তির উল্লাসে মাতোয়ারা হতে পারতেন না?

থাক থাক, অনেক হয়েছে। মন খারাপের গল্প লিখে এতক্ষণে পাঠকের আনন্দের অনেকটাই মাটি করে দিয়েছি নিশ্চয়! এসব নিয়ে যত কম কথা বলা যায় তত ভালো। যত কম লেখা যায় তত ভালো। আমার মতো নরাধম যে ক’জন এক-আধটু লিখতে জানি, আমরা বেলজিয়াম ফুটবলের মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে শব্দগুচ্ছের সমাহার সাজাবো, আইসল্যান্ডের রুপকথা নিয়ে আবেগ মথিত রচনা উপহার দেবো, সেই ঢের ভালো।

 

আসুন, আমরা কথা বলি রোনালদোর জুভেন্টাস অধ্যায় নিয়ে, বার্সায় মেসি আর কতদিন, ইংলিশ লীগে কি ফিরবে সেই জমজমাট পুরনো আসর...।

এসব দেশীয় ফুটবল-টুটবল ভুলে গিয়ে, এই বিষাদের কালো ছায়া আর বেদনার দমকা হাওয়াটাকে তাড়িয়ে দিন তো!