• ক্রিকেট

ক্রিক-পাঁচালী (পর্ব-২)

পোস্টটি ৩১৭৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সবেমাত্র সকলে কিটিরপুর হইতে বেড়ার ঘরের ক্লাবঘরখানাতে পৌছাইয়াছে। কলাবাগান ক্রিকেট সংঘের সহিত শেষ ম্যাচে জয়সমেত সিরিজ জয় করিয়া ট্রফিনিয়া ক্লাবঘরখানাতে উল্লাস করিয়া ঢুকিবামাত্র পেয়াদা পত্রসমেত হাজির হইল। পত্রে কত্তা গৌরাঙ্গদেব আপন কিছু একটা লিখিয়াছে মনে করিয়া পড়িবার বাসনা করিলেন না দলপতি রাফি। পত্রখানা হাসানের হাতে দিয়া কহিলেন, 'ওখানা তুইই পড়'।

নিতান্তই আলসেমির ভঙ্গিতে পত্রের ভাজ খুলিয়া পত্রখানা দৃষ্টিসীমার সামনে ধরিয়া উচ্চৈস্বরে পড়িতে লাগিল হাসান,

''রাফি ও সকলে,
নিতান্তই কর্মব্যাস্ততার মধ্যে অভিনন্দন জানাইতে ভুলিয়া যাব মনে করিয়াছিলে কি? করিয়া থাকিলে ভুল কিছু কর নাই। ইহ যুগের সকলেই কি আমার মত তিন চারখানা পদ একসঙ্গে চালাইতেছে, অথচ দৃষ্টি প্রসার করিয়া দেখ উভয় দায়িত্বেই আমার কি গুণ, কি প্রজ্ঞা, কি দায়িত্ববোধ! আমি ইহা নিশ্চিত জানি, গতদিন ম্যাচ হারার পর ক্লাবঘরে আমার উপস্থিতিতেই তোমরা সকলে আজ এমত করিয়া জয় ছিনিয়া লইয়াছ। আমার উচ্চবাচ্চ অনুপ্রেরণাদায়ী বাক্যেই যে আজ সাগর শেষ দিকে দুই দুইখানা বাউন্ডারি হাকাইয়াছে তাহা আমি খুব ভাল করিয়া ঠাওর করিতে পারিয়াছি। তোমাদিগের সকলকে এই জয়ে অভিনন্দন।

পুনশ্চ: রাব্বির নামে কি সব গঞ্জের চায়ের আড্ডায় বলাবলি হইতেছে। রাব্বিও দেখিলাম আসিবার পথে গঞ্জের দেয়ালে কি সব ছাঁটিয়া দিয়াছে। রাব্বিকে দুষ্টুমি কম করিতে বলিও। সে আমার পুরাতন প্রেমিকা চন্দ্রিলার একান্তই পছন্দের পাত্র বলিয়া কিছু বলিতেছি না। তাই বলিয়া যে বলিবই না তাহা নহে। চন্দ্রিলাকে আমি ধীরে ধীরে ভুলিয়া যাইতেছি। রাব্বিকেও যাইতে সময় নিব না ''

চিঠিখানা পড়িয়া ভাঁজ করিয়া ক্লাবঘরখানার দক্ষিণ কোণে রাখা কাঠের আলমারিতে নিতান্তই অনিচ্ছায় তুলিয়া রাখিল হাসান। জয়ের আনন্দ এমত করিয়া ফিকে না করিলে কি কত্তাবাবুর চলে না?

সিরাজের এরই মধ্যে প্রচন্ড মন:ক্ষুন্ন হইতেছে। রাফি আজ চলিয়া যাইবে। দল সামলাইবে হাসান। সিরাজ রাফিকে বড্ড ভালবাসে। সারাক্ষণ পিঠাপিঠি লাগিয়া আছে। হাসানের উত্তরসূরি হইয়া রাফির পিঠাপিঠি লাগিয়া থাকার কারণে হাসানসহ বাকি সবাই সিরাজের সহিত মশকরাও করে। সকলেই এতে বিষম আনন্দ পায়। পটলডাঙ্গা ক্রিকেট ক্লাব আদতে একটি সুখী পরিবারের মতন। ইহাতে কেহই কারোর সহিত ঝগড়া করিয়া থাকে না। হাসান আর রাফির মিল দেখিয়া সকলে তো চমৎকৃত হয়!

কুবের আজ আগের সকল ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছে। কুবেরকে ডাকিয়া রাফি বলিল, 'কুবের, আজ তুমি যাহা করিয়াছ তাহাতে আমি বড্ড খুশি হইয়াছি । আজিকেও যদি তুমি আগের দিনের অনুরূপ কার্য সংঘটন করিতে আমি তোমাকে ক্ষমা করিতে পারিতাম না। কলাবাগানের দানবটাকেই তুমি ফিরিয়া দিয়াছ। দু:স্বপ্ন ভুলিয়া শেষের দিকে একের পর এক গোলা ছুড়িয়াছ। মাঠের বাহির হইতে ডন মিরাজুল অব্দি চিল্লাইতেছিল - কুবের প্রতিপক্ষের বড় মাছখানাই শিকার করিয়াছে। তোমার এই অবস্থা আগামী আন্ত:গ্রাম ক্রিকেট চ্যাম্পিওনশিপ অব্দি বজাইয়া রাখিও, তাহলেই চলিবে। '

যথারীতি রাব্বির কানে এসব কিছুই যাইতেছে না। বেচারা ভীষণ মানসিক চাপে পড়িয়াছে। আসিবার পথে গঞ্জের দেয়ালে পোস্টারখানা ছাটিয়া আসা ঠিক হইয়াছে কিনা সে বুঝিতে পারিতেছে না। সকিনার ভাবনাও মন হইতে দূর হয় নাই। জরিনাও তাহাকে দু চারখানা পত্র পাঠাইয়াছে। তাহার সহিত জরিনা সাক্ষাৎ করিতে চাহে। ঠোটের কোণে হালকা হাসির রেখা উঁকি দিয়াই মিলিয়া গেল, 'এমত অবস্থাতেও যদি ললনাদিগের এহেন পত্র মিলিতে থাকে তবে কি হইবে আর ক্রিকেট খেলিয়া?'
ইকবাল আজ প্রচন্ড ব্যাথা পাইয়াছে। কিছুটা মন:ক্ষুন্ন হইয়াছে। তবে আজি আর হাসানের জন্যে নহে, নিজের অপরিণামদর্শিতা প্রত্যক্ষ করিয়া। ঐ পরিস্থিতিতে তাহার উইকেট দিয়া ফিরিয়া আসা মোটেও দায়িত্বসুলভ হয় নাই, সে তাহা চাহেও নাই। এরপর হইতে এমত ভুল আর করিবে না বলিয়া সে বারংবাত শপথ করিয়া লইল।

রাফি হাসানকে দায়িত্ব বুঝাইয়া দিতেছে। বুঝাইয়া দিতেছে বলিতে আদতে যাহা মনে হয়, আসলে তাহা নহে। এই দলে হাসানের উপর রাফির অগাধ বিশ্বাস। ছোটবেলা হইতে সে হাসানকে দেখিতেছে। দাঁতে দাঁত চাপিয়া শেষ অব্দি লড়াই করিবার এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের জন্যে হাসান বরাবরই রাফির প্রিয়। এবং এর উল্টোটাও কিন্তু সত্য।

ছোটখাট গড়নের শেতু কাঁধে ব্যাগ গুছাইয়া বের হইয়া যাইতেছে দেখিয়া রাফি ডাকিয়া জিজ্ঞেস করিল, 'তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ হে বাপু?'

মুখ কাচুমাচু করিয়া গভীর আবেগ সঞ্চার করিয়া শেতু জবাব দিল, 'আজিকের ম্যাচে আমি ব্যাট হাতে অনেক সফল হইতে পারি নাই। তাই কিছুটা ব্যাট ঝালাই করিয়া আসি। এক ভৃত্যকে আসার পথে বলিয়া আসিয়াছি। সে জাল খাটাইয়া মাঠে অপেক্ষা করিতেছে। '

শেতুর এই মনোভাবে রাফি আরেকবার মুগ্ধ হইল। বছরের পর বছর ধরিয়া শেতু এইভাবেই নিজেকে সামলাইয়া চলিয়াছে। এহেন পরিশ্রমী মানুষ রাফি খুব কম দেখিয়াছে।

ইকবাল আজ প্রচুর পুরস্কার পাইয়াছে। ক্লাবঘরের আলমারিতে সেইসব তুলিয়া রাখিতেছে। বাড়ি ফিরিবার সময় একত্রে নিয়া যাইবে সব। আপাতত এক বৈদ্য ডাকিয়া দেখানো দরকার।

হাসান ঐদিকে খাতা কলম লইয়া বসিয়া গিয়াছে। নেতৃত্বগুণ তাহার মধ্যে প্রকট। কিন্তু দল ভাল না করিলে তাহা সবার সামনে প্রকট হইতে পারিতেছে না। আগামী ম্যাচ নিয়ে সে আশাবাদী হইতেছে। সবাই সেরাটা খেলিয়া দিলে সেও হইতে পারে সফল দলনেতা।

হায়দার আর জাবেদেরও উঠিতে হইবে। এতদিন না খেলিলেও আসছে ম্যাচ হইতে দলে তাহাদের দায়িত্ব থাকিবে, তাহার জন্যে চর্চা করিতে হইবে। দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল জাবেদ আর হায়দার।

সাগর আর কুমার ও তাহাদের পিছু লইল........