• ক্রিকেট

এশিয়া কাপ : একটি সেঞ্চুরী, একটু তত্ত্বকথা আর খানিক স্মৃতিচারণা

পোস্টটি ৯৬৩৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

তিনজনের লম্বা সোফাটাতে বসেছেন তাঁরা। আমরা বিছানায়। একজনের সোফা দুটো খালি ছিল নাকি আরো কেউ ছিলেন, ঠিক মনে করতে পারি না। তাঁরা মানে মামারা (দু’জন ছিলেন), শহরে আপা-দুলাভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মাগরিবের আযান এই পড়লো বলে। আমরা ভীষণ মনোযোগে খেলা দেখছি। পাক-ভারত মহারণ যে!

৭০-এর আশেপাশে ব্যাট করছিলেন ইউসুফ (তখন ইয়োহানা), আমরা আলোচনা করছিলাম, তিনি সেঞ্চুরী করতে পারবেন কি না! ওভারও যে শেষ হয়ে আসছে প্রায়। এই সময় ক্রিকেট-অনভিজ্ঞ মামারা জিজ্ঞেস করে বসলেন, সেঞ্চুরী হয় কতো হলে?

স্বভাব সুলভ রসিকতায় আব্বু তাদের জানালেন, আশি হলে!

ব্যস! তাঁরাও আমাদের ক্রিকেট-উত্তেজনায় সংক্রমিত হয়ে বেশ উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন, কখন আশি হবে! সেঞ্চুরী হবে! আর আশি হতেই তাঁরা হাতে চাপড় দিয়ে বলে উঠলেন, এই তো সেঞ্চুরী করে ফেলল!

আমরা হাসতে থাকি। হো হো করে অট্টহাসি নয়, মুখ-চাপা দুষ্টু হাসি। আব্বুটা না পারেনও! এমনভাবেও কেউ কোনো মানুষকে বোকা বানায়!

 

*****

 

এই সময় এই অবস্থা হলে মামাদের বোকা ভেবে বেশ একচোট হেসে নেয়া অন্যায় হবে না নিশ্চয়! তবে সেই সময় এই ক্রিকেট-অনভিজ্ঞতা মোটেও বোকামি ছিল না কিন্তু। কয় শতাংশ মানুষই বা ক্রিকেট দেখতেন তখন? বুঝতেন তো আরো কম। যে সময়ের কথা বলছি তারও কিছুদিন আগে, দিদার ভাইয়া পাশের বাসায় খেলা দেখতে গিয়ে ফিরলেন মহা বিরক্ত হয়ে।

আমাদের সাদাকালো টিভির দিন তখনও ফুরোয়নি। পাশের বাসায় এক আঙ্কেলের বাসায় রঙিন টেলিভিশন ছিল, যেখানে একুশে টিভি ডিশ সংযোগ ছাড়াই দেখা যায়। সেবার কোনো এক টুর্নামেন্ট সরাসরি সম্প্রচার করছিল ইটিভি কর্তৃপক্ষ। সাদাকালো-তে ঐ খেলা দেখা যায় না, একুশে টিভি নেই যে! দিদার ভাইয়া গেলেন পাশের বাসায় খেলা দেখতে। ফিরলেন তিতিবিরক্ত হয়ে, খেলা অসম্পূর্ণ রেখেই। আঙ্কেল ভদ্রলোকের যে প্রশ্নের শেষ নেই, জানার অন্ত নেই! বল উড়ে গেল কেনো ছয়? চার হয় কখন? পায়ে লাগলে চিৎকার কেনো? এটা কেনো? সেটা কেনো? এমন কেনো? তেমন কেনো?

শুধু জানতে চাওয়ার মধ্যে উনি সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো সমস্যা হতো না। ভদ্রলোক যে জানার পর খুব বুঝে গেছেন ভাব করে দু’একটা মন্তব্যও করছিলেন, তা আর নিতে পারেননি ভাইয়া!

আজকাল যেভাবে যে-হারে মানুষ ক্রিকেট দেখে, ভাবে, বোঝে তখন তো সেসব অকল্পনীয় ব্যাপারই ছিল বলতে গেলে। আমার মনে আছে, নিউজিল্যান্ড বা দক্ষিন আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলগুলোর অধিনায়কের নাম বলতে পারতাম বলে তাজ্জব হয়ে যেতেন অনেক বড় ভাই! আরো নানান ক্রিকেটারের নাম জানা দেখে, বেশ পন্ডিত ভেবে আম্পারিংয়েও দাঁড় করিয়ে দিতেন কখনো। একবার এক লেগ বিফোরে সাড়া দিয়ে আঙুল তুলে দেয়াতে কোনো অভিযোগ তো করেইনি, উলটো পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন নন স্ট্রাইকিং এন্ডের বড় ভাই!

এখনকার মানুষ ক্রিকেট নিয়ে কতো ভাবে! অবশ্য এটার ভালো দিকের পাশাপাশি মন্দ দিকও আছে। ক্রিকেটারদের উচিত-অনুচিৎ নিয়ে, যে আলোচনা-সমালোচনা চলে- মাঝে মাঝে মনে হয় সবার ক্রিকেট বোঝাটা আসলে ঠিক না। ক্রিকেট সবার জন্য নয়। প্রখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে সি এল আর জেমস তাঁর বিখ্যাত ‘বেয়ন্ড অ্যা বাউন্ডারী’ বইয়ে লিখেছিলেন-

Cricket is an art. Like all arts it has a technical foundation. To enjoy it does not require technical knowledge, but analysis that is not technically based is mere impressionism.

আমার ক্রিকেট-পান্ডিত্যের নীরব শ্রোতা ছোটো বোনকে একবার বলেছিলাম সে কথা। ক্রিকেটটা আসলে অভিজাত খেলা, এটা অভিজাতদেরই বোঝা উচিৎ। দেখা উচিৎ। আমাদের জন্য ক্রিকেট নয়। এহেন কথা শুনে সে চোখ তুলে চেয়েছিল আমার দিকে- সবসময় অভিজাত-অনভিজাত বৈষম্য ও বিভাজনের বিপক্ষে বলা, নাক উঁচু বৃটিশ আর অজি অহংকে ধুয়ে দেয়া ভাইয়াটা এসব কী বলে?

সি এল আর জেমস থেকেই আরেকটা কথা ধার করি। খুবই পছন্দের। সুযোগ পেলেই সেটা ঝেড়ে দিই।

What do they know of Cricket, who only cricket know? যার সরল বাংলা দাঁড়ায়, “যারা কেবল ক্রিকেট জানে, তারা ক্রিকেটের কী জানে?”

যাক, সেসব তত্ত্বকথা।   

 

*****

 

স্মৃতিচারণায় ফেরত আসি। ইউসুফের আশি পার হয়ে গেলেও আমাদের হাব-ভাব দেখে মামারা ঠিক বুঝে গেলেন, সেঞ্চুরী এখনও হয়নি আসলে। ইউসুফ ইয়োহানা তখন চূড়ান্ত বিরক্তিকর একজন। টুকে টুকে খেলার মাস্টার। তাঁকে কেনো ভালো লাগবে?

আগের ম্যাচেও আশি রান ছিল তাঁর। সেঞ্চুরী পাননি। ইমরান নাজিরও আশি করেছিলেন সে ম্যাচে। এবং ইমরান নাজিরের রান আউটে ইউসুফ ইয়োহানা চমৎকার অবদানও রেখেছিলেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল ম্যাচটা।

মনে আছে, জুমাবারে আয়েশ করে ম্যাচটা দেখতে বসেছিলাম। বিশ্বকাপের সেই জয়ের পর এই ম্যাচ নিয়ে প্রত্যাশাও ছিল সেরকম। কিন্তু পাকিস্তানের ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে সব ধুলিস্ম্যাৎ হয়ে যায়। খালেদ মাহমুদের ৮১ রান দেয়াটা তখন কোনো বোলারের দ্বিতীয় বা তৃতীয় রান বিলানোর রেকর্ড হয়েছিল সম্ভবত। আর বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের তো ছিল আরো ভয়াবহ অবস্থা। ভারতের বিপক্ষে যে ব্যাটিং দারুণ দেখিয়েছিল, সেই ব্যাটিং-ই এখানে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে! সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হারের লজ্জাটাও সঙ্গী হয়েছিল সেবার।

থাক, আর না। বিরহের গল্পগুলো বরং সিঁন্দুকেই তালাবন্দী থাকা ভালো।

ইমরান নাজিরের অভিশাপে (অন্তত আমাদের ধারণা তা-ই ছিল) আগের ম্যাচে সেঞ্চুরী মিস করা ইউসুফ, এই ম্যাচে সেঞ্চুরী পাবেন কি-না সে সংশয় সময়ের সাথে আরো বাড়ছিল বৈ কমছিল না। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, শেষ বলে ছয় দরকার, ইউসুফ তখন ৯৪ রানে। শেষ বলে ঠিক ঠিক ছয় মেরে দিলেন টুক টুক ইউসুফ! অবিশ্বাসে তাকিয়ে থাকি আমরা। আব্বুর কাছে জাভেদ মিঁয়াদাদের কতো গল্প শুনেছি! আর শেষ বলে এমন স্বচক্ষে দেখা ছক্কা!

মামারাও সেদিন বুঝে যান, সেঞ্চুরী আসলে কতো-তে হয়! সেজো মামা তো ক্রিকেটের মহা আনন্দের আস্বাদটাও বুঝি পেয়ে গিয়েছিলেন! তারপর শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে কতো ক্রিকেট-আলাপে যে মামা-ভাগ্নে মজেছিলাম!

 

*****


সময় বয়ে যায়, সময়ের মতো। আমরা বড় হই। বুড়ো হই। বছর ঘুরে এশিয়া কাপ আসে। স্মৃতির মানসপটেও ফিরে আসে প্রথম এশিয়া কাপ দেখার টুকরো স্মৃতি। সময়ের সাথে কতো গল্প জমা হয়, কতো অনুভূতি বিলীন হয়।

সময়ের সঙ্গে বয়স বাড়ে, স্মৃতির ঝুলি তরতর করে ফুলে ফেঁপে উঠে। এক অদ্ভুত অনুভূতিও ভর করে এখন। স্মৃতির বেড়ে উঠার আনন্দের সঙ্গে বুড়িয়ে যাওয়ার আশংকাও যে ঘিরে ধরে!