• ক্রিকেট

মা গো, ভাবনা কেন...?

পোস্টটি ১১৯৩৩ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

৪৭তম ওভারের ৫ম বলে সুরাঙ্গা লাকমলের ফুলটসটা ঠেলে দিয়েই দৌড় দিলেন মুস্তাফিজ। বল লাকমলের হাতে লেগে লাগল মুশফিকের গায়ে। বল তখনও ক্রিজে। মুস্তাফিজ বুঝলেন, বিরাট ভুল হয়ে গেছে। প্রাণপণে উল্টো দৌড় শুরু করলেন ক্রিজের দিকে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। কুশাল পেরেরা বল তালুবন্দি করেই ভেঙ্গে দিলেন স্ট্যাম্প। বাংলাদেশের ইনিংসের পরিসমাপ্তি। অন্তত স্কোরকার্ড বলছিল তাই-ই। দ্বিতীয় ওভারে হাতে ব্যথা পেয়ে হাসপাতালে এক্সরে-র জন্য চলে গেলেন ওপেনার তামিম ইকবাল। ইনিংসের মাঝপথে খবর আসল, কব্জি ভেঙ্গে গেছে তার। শেষ এশিয়া কাপও। ধারাভাষ্যকারেরা বললেন, “আ প্রিম্যাচিউর এন্ডিং টু অ্যান ইনিংস দ্যাট প্রমিজড আ লট ফ্রম বাংলাদেশ।” কিন্তু শেষ কি আমরা আসলেই দেখেছিলাম?

উত্তর? না। না, আমরা দেখিনি। মুস্তাফিজ মাঠ ছাড়লেন। কিন্তু মুশফিক তখনও ক্রিজে। “আরে ব্যাডা ইনিংস তো শ্যাষ মাডে কী করোস এহনও”, জোর গলায় বলে উঠলেন টংয়ের আকবর চাচা। কিছুটা অবাক হলাম আমিও। তবে উত্তরটা পেলাম খানিক পরেই। দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে শেষ যেবার আমরা খেলেছিলাম; সেবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন। জন্ম হয়নি মিরাজ, মোসাদ্দেক, রনি, অপুদের। সেই মরুর বুকে, ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের দাবদাহে নেমে এলেন এক দেবদূত। প্রচন্ড গরমে আমাদের মাঝে তিনি বইয়ে দিলেন প্রশান্তিময় আশা। একটু আগেও স্লিং গলায় জড়িয়ে হাঁটছিলেন ড্রেসিং রুমে। সেই তামিম বামহাতের ভাঙ্গা কব্জি গলে পড়া গ্লাভসে নেমে পড়লেন মাঠে। মালিঙ্গাকে একবার দেখাল ক্যামেরায়। পুরো ম্যাচে বাংলাদেশের 'যম' নিজেই যেন ভূত দেখলেন। তামিম আসলেন, মুশফিকও এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। কিছু একটা বলে ডানহাত দিয়ে মুশফিকের বুকে একটা ঘুষি দিলেন। যেন বললেন, “মচকাইসি বেটা, ভাঙ্গি নাই। দেখায়ে দেই চল।”

 

 

সেই চাপড় যেন মুশির শরীরে বইয়ে এল অসুরের শক্তি। সেই মুশফিক, যিনি প্রায় পুরোটা ম্যাচই খুঁড়িয়েছেন, রান নেওয়ার পর হাঁপিয়ে উঠেছেন প্রায় প্রতিবারই। যার ‘ট্রেডমার্ক’ ছয়ের স্ট্রোকগুলোও শক্তির অভাবে হচ্ছিল বাউন্ডারি। আর হবেনই বা না কেন? পাঁজরের নয় নম্বর হাড়ে চির নিয়েও শুধুমাত্র দেশের জন্য নেমে পড়েছিলেন মাঠে। নিজের এই অবস্থা, তার ওপর প্রথম ওভারেই নেই লিটন, সাকিব। মুশফিক পারতেন না নিজের স্বার্থটা আগে দেখতে। এক যুগেরও বেশি সময় লালসবুজ জার্সি জড়ানো মুশি আর যা-ই হোক, স্বার্থপর হতে পারেন না এক মুহূর্তের জন্যও। একটু পরপর ঘাম মোছা সেই মুশফিক যেন হয়ে উঠলেন মার্ভেলের হাল্ক, বা থানোস। ৪৭তম ওভারের শেষ বলটা একহাতে ঠেকালেন তামিম। সেই ছবি ভাইরাল হয়ে গেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আজীবন যা অমলিন থাকবে স্মৃতির মানসপটে।

তামিমের এই বীরত্বগাঁথা যেন মনে করিয়ে দিল ‘৭১-এর শহীদ জুয়েলের কথা। মারদাঙ্গা ব্যাটসম্যান ছিলেন। কেবল বাঙ্গালি হওয়ায় সুযোগ পাননি তৎকালীন পাকিস্তান দলে। এ নিয়ে কোনো ক্ষোভও ছিল না তার। যুদ্ধের সময় সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে রামপুরা বিলে পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশফায়ারে ডান হাতের তিনটা আঙ্গুল ভেঙ্গে গর্ত হয়ে গিয়েছিল তার। হাতটাকে পচনের হাত থেকে বাঁচাতে কেটে ফেলতে হবে আঙ্গুলগুলো। এটা শুনেই ডাক্তারকে করুন স্বরে মিনতি করলেন, “স্যার! ও স্যার!! দ্যাশ স্বাধীন হইলে আমি আমগো বাংলাদেশের হইয়া ওপেনিংয়ে  নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, দোহাই লাগে…" জুয়েলরা চলে যান। রেখে যান বীরত্বের রক্ত, দেশপ্রেমের আদর্শ।  যা বয়ে চলে তামিমদের ধমনীতে…

তামিমের এই অভাবনীয় আত্মবিসর্জন যেন পুরো দলকে গাঁথল এক সূতোয়। সবার মাঝে বিরাজ করল প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। এই ম্যাচ হারা অসম্ভব। তামিম নামার সময় ড্রেসিং রুম, দর্শকসারির জোর করতালি, উল্লাসই যেন তা-ই জানান দিচ্ছিল। খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন মুশিই। বাকিটা সময় যে দুর্দান্ত তান্ডব চালালেন, তাতেই হেরে গেছে শ্রীলঙ্কা। তিন চার, তিন ছয়ে তামিমকে সাথে নিয়ে যোগ করলেন ৩২ রান। মুশির টর্নেডোতে স্কোর দাঁড়াল ২৬১-তে। ৬ষ্ঠ সেঞ্চুরি করে থামলেন ১৪৪-এ। যা এশিয়া কাপের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস এবং বাংলাদেশের একক সর্বোচ্চ স্কোর। আমাদের ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস এখন আমাদের ‘লিটল মাস্টার’-এর। শেষ ওভারে পেরেরার প্রথম দুই বলে মুশির দুর্দান্ত দুই ছয়ের পর মাশরাফির মুষ্টিবদ্ধ উদযাপন যেন তখন আমাদের প্রত্যেকের প্রতিচ্ছবি। একটা সময় ২০০ না হওয়ার আশঙ্কা থেকে প্রজেক্টেড স্কোরের চেয়ে ৩৬ রান বেশি করে ইনিংস শেষ করল টাইগাররা। উদ্দীপ্ত না হয়ে উপায় আছে?

 

 

ক্রিকেট বা যেকোনো খেলায় আত্মবিশ্বাস ঠিক কতটা বড় জিনিস, তা কমবেশি সবারই জানা। না থাকলে কালকের ম্যাচটিই যেন সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মাহমুদুল্লাহ, মোসাদ্দেক, মিরাজদের হারিয়ে ব্যাটিংয়ের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাওয়া বাংলাদেশ তামিমের ভাঙ্গা কব্জি, মুশির ভাঙ্গা পাঁজরে ভর করে পেরুল ২৫০-এর ল্যান্ডমার্ক। আবুধাবির মরুভূমিতে বাঘের গর্জনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল লঙ্কান সিংহরা। আত্মবিশ্বাসের ভীত ঠিক কতটা নড়ে গেছে ম্যাথিউসদের, বোঝা গেল ইনিংসের শুরুতেই। তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়লেন মুস্তাফিজ-মাশরাফিদের সামনে। ৯৬ রানে নেই ৮ উইকেট। শেষটা হল ১২৪ রানে। আর তাতেই রচিত হল বিদেশের মাটিতে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ের গল্প।

আজীবনের স্মরণীয় এক জয় শেষে পুরষ্কার বিতরণীতে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস পর্যন্ত মাতলেন তামিম বন্দনায়। মাশরাফিও বললেন, নিজের কথা একটাবারও চিন্তা না করে দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ায় তামিমকে আজীবন মনে রাখা উচিত দেশবাসীর। আমাদের ব্যাটিং বলতে যে দুজনের নাম সবার আগে আসে, তারাই ছিলেন সেদিনের জয়ের মূল কাণ্ডারি। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ওয়ানডেতে আমাদের সর্বোচ্চ রান তামিমের (২১৮২), যা দ্বিতীয় স্থানে থাকা মুশফিকের (১৫২১) চেয়ে ৭০০-এরও বেশি। গড় ৬২, ৫০-এর ওপরে নেই আর কারোই। সেঞ্চুরিও সর্বোচ্চ ৭টি, হাফসেঞ্চুরিও (১৪)। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে ক্রিকেটে ওপেনারদের মধ্যে মাত্র পাঁচজনের রান তার চেয়ে বেশি। আর গড়ের দিক দিয়ে পেছনে ফেলেছেন সবাইকেই (৬১.৩০)। কিন্তু এতসব কেতাবী পরিসংখ্যানের পরও ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তে আবুধাবিতে দাবদাহে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪ বলে ২ রানের ইনিংসটাই হয়ে থাকবে সবচেয়ে আপন। কাঠখোট্টা এসব পরিসংখ্যান যে আবেগ, ভালবাসা, বুকভরা গর্বের সামনে নস্যি!

 

 

ইনিংসের শেষ ১৬ বলে বাংলাদেশ, আরও ভাল করে বললে মুশফিকের ব্যাট থেকে এসেছে ৩২ রান। বোবা স্কোরবোর্ড আপনাকে জানান দেবে, এই রানে তামিমের ভাগ নেই এতটুকুও। কিন্তু আসলেই কি তাই? মুশফিকের প্রতিটি রানই কি তামিমের নয়? তামিম কি পুরোটা সময় নীরব অভিভাবক হয়ে আগলে রাখেননি আমাদের? তামিম যদি না-ই নামতেন, তাহলে কি আদৌ শেষের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে পাঠানো রান গুলো আসত?

কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি এবারের এশিয়া কাপের জন্য তাকে। ডানহাতে আঙ্গুলের চোটটা ছিল আগেই। সেই সাথে জড় হল ভিসা জটিলতা। এর মধ্যে আবার দ্বিতীয় ওভারেই সেই ইনজুরি। সংবাদ মাধ্যম ততক্ষণে সয়লাব ‘তামিমের এশিয়া কাপ শেষ’ সংবাদে। কিন্তু শেষটা হতে দিলেন না তামিম। রক্তের শেষবিন্দু দিয়ে লড়ে গেলেন লাল-সবুজের পতাকার জন্য। টুর্নামেন্টে আর না খেলার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ তার। কিন্তু যা করে গেলেন, এর জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে ষোল কোটি মানুষ। শহীদ জুয়েল, মোস্তাকরা নিশ্চয়ই গর্বের হাসি হেসেছিলেন ওপার থেকে। হাজারো অপ্রাপ্তি থাকতে পারে দেশটা নিয়ে, কিন্তু নিজেরা যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন; দেশের জন্য নিজেকে উজার করে দেওয়া- সেই আদর্শ যে আজও অটুট, এটাই কি সর্বোচ্চ প্রাপ্য নয়?

 

 

‘৮৪-তে পল টেরি, ‘৯৯-তে ম্যালকম মার্শালের একহাতে সেই অতিমানবীয় চার, ‘০৯-এ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গ্রায়েম স্মিথের একহাতে দাঁতে দাঁত চেপে টিকে থাকা- ক্রিকেটে দলের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হওয়ার এমন নিদর্শন দেখতাম। কিন্তু কখনও ‘নিজের’ বলে অনুভব করতে পারতাম না। তামিম সেই আক্ষেপটাও ঘুচিয়ে দিলেন। একটা সময় দেশের ক্রিকেটে হাস্য-বিদ্রূপের সবচেয়ে পাত্রই আজ দেশের চোখের মণি। সব শুনে গেছেন, কখনও কিছু বলেননি। এমনও দিন গেছে, তার বউ আয়েশাকে লোকে হাস্যরস করে কাঁদিয়েছে। তামিম ছিলেন নিশ্চুপ। ২০১৫-এর পর থেকে শুরু হল জবাব। ব্যাটের জবাব, মুখের নয়। সেই ‘ম্যাগি নুডুলস’, ‘ডানো ম্যান’, ‘চাচা কোটায় খেলা’ তামিম আজ বাংলাদেশের ‘আয়রন ম্যান’ আরও কত কী! তামিমের হয়তবা এসবে থোড়াই কেয়ার। দলকে বাঁচাতে একহাতে নেমে গেছেন, অনুসরণ করেছেন সাতবার সার্জারির পরও নিয়মিত বল করে যাওয়া ‘বড় ভাই’ মাশরাফিকে। দিনশেষে এই আত্মত্যাগ গুলোই তো চোখে পানি নিয়ে আসে, বুকটা দশহাত ফুলিয়ে দেয় গর্বে।

২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে কেঁদেছিলাম ২ রানের জন্য। গতকাল তামিম মনটা ভরিয়ে দিলেন ২ রানের এক ইনিংসেই। দুর্নীতির কালোগ্রাসে ডুবে থাকা দেশটায় তো এই মুহূর্ত গুলোই বেঁচে থাকাটা অর্থপূর্ণ করে তোলে।

 

 

একসময় ওয়ানডেতে আমাদের কেউ সেঞ্চুরি করবে- এমনটা ভাবতেও পারতাম না। মেহরাব হোসেন অপি তা করে দেখিয়েছিলেন। ওয়ানডেতে ১৫০ করা যায়, তা-ও বুঝতাম না। দেখেছি তা-ও। কে দেখিয়েছিলেন, তা আর না-ই বা বললাম। কিন্তু যত ইনিংসই আসুক, ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে তামিমের আজকের ৪ বলের ২ রানের ইনিংসটা থাকবে সবচেয়ে বেশি আপন। যে ইনিংসের প্রতিটা মুহূর্ত ছিল কলিজার পরিচয়। প্রতিটা মুহূর্ত ছিল দেশপ্রেমের অভূতপূর্ব নিদর্শন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছিল দেশের জন্য নিজের সর্বস্ব উজার করে লড়াই করে যেতে। যত কষ্টই হোক, মানচিত্রের মান রাখতে। মুক্তিযোদ্ধাদের শেখানো সব আদর্শ ভুলতে বসা দেশটায় তামিমের এমন স্বার্থহীনতা যেন আশ্বাস দেয়, এখন সর্বহারা বিবেকহীন প্রাণীতে পরিণত হইনি আমরা। এখনও সেই ঈষাণকোণে হতাশার কালো মেঘের আড়ালে উঁকি দেয় উন্নয়নের ক্ষীণ আভা।

ভাল থাকুক 'চাচা কোটায় খেলা' লোকটা। ভাল থাকুক প্রিয় দল। ওরে তোরা সব জয়ধ্বনি কর!