যুদ্ধ শেষে ছাড়া পাওয়ার পর আবার তার প্রাক্তন ক্লাব কাইসারস্লটার্নেই আবার যোগ দেন তিনি। পরের ৮ মৌসুমে ১৭৬ ম্যাচ খেলে করেন ১৯৫ গোল, জিতে নেন ২বার জার্মান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। অবসরের আগ পর্যন্ত এই ক্লাবেই কাটিয়ে দেন তিনি।
ফুটবলের সৈনিক, নাকি সৈনিকদের ফুটবলার?
পোস্টটি ৩৪৫০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
জার্ড ম্যুলার, ফ্রাঞ্জ ব্যাকেনবাওয়ার কিংবা সেপ মাইয়েরের মত কিংবদন্তিদের নামের আড়ালে তার নাম অনেকটা চাপা পড়ে গেলেও জার্মান ফুটবল ভক্তরা চিরদিন তার নাম মনে রাখবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জার্মানি যেভাবে অন্য বিশ্বসেরা দলগুলোকে হারিয়ে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল তা সত্যি চমকে দেওয়ার মত। আর এই বিশ্বকাপ জেতার পিছনে যার অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনি হলেন ফ্রিটজ ওয়াল্টার।
১৯২০ সালের ৩১শে অক্টোবর জার্মানির কাইসারস্লটার্নে জন্মগ্রহন করেন এই জার্মান কিংবদন্তি। তার বাবা-মা কাজ করতেন কাইসারস্লটার্নের স্থানীয় ফুটবল ক্লাব এফসি কাইসারস্লটার্নের রেস্টুরেন্টে। মাত্র ৮ বছর বয়সে ভর্তি হন এফসি কাইসারস্লটার্নের যুব একাডেমিতে। নিজের অক্লান্ত প্রচেষ্টা আর অধ্যবসায়ের সাহায্যে কোচের নজর কাড়তে সমর্থ হন।
১৯৩৯ সালে শুরু করেন নিজের প্রফেশনাল ক্যারিয়ার। ১ম মৌসুমেই কাইসারস্লটার্নের হয়ে অবিশ্বাস্যভাবে মাত্র ১৫ ম্যাচে করেন ৩০ গোল। পরের বছরেই জার্মানির জার্সি গায়ে মাঠে আলোকদ্যুতি ছড়াতে শুরু করেন তিনি । করে ফেলেন রোমানিয়ার বিপক্ষে নিজের হ্যাট্রিক।
১৯৪০-৪১ মৌসুমে ১২ ম্যাচে ১৬ গোল, তার পরের মৌসুমে ১৪ ম্যাচে ৩৯ গোল, যেন রূপকথার ফুটবলার। ১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরম আকার ধারন করেছে সারা ইউরোপ জুড়ে। ফ্রিটজ ওয়াল্টার জড়িয়ে পড়েন যুদ্ধে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়েন মিত্রশক্তির সৈন্যদের হাতে। রোমানিয়ার মারামুরেস নামক স্থানে যুদ্ধবন্দী হিসেবে কাটান কিছুদিন। তবে সেখানেও খেলার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। স্লোভাকিয়া আর হাঙ্গেরির রক্ষীবাহিনীর সাথে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন ওয়াল্টার। বিশ্বযুদ্ধ শেষে সোভিয়েত সৈন্যরা শ্রমিক হিসেবে তাদের দেশে সকল জার্মান যুদ্ধবন্দীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার যুদ্ধশিবিরে এলেও সৌভাগ্যজনকভাবে বেচে যান তিনি।
এক হাঙ্গেরিয়ান রক্ষী তার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে সোভিয়েত সৈন্যদের কাছে বলেন তিনি জার্মান না বরং তিনি জার্মানির ফ্রেঞ্চ অধ্যুষিত সার প্রদেশের বন্দী। ফলে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
যুদ্ধ শেষে ছাড়া পাওয়ার পর আবার তার প্রাক্তন ক্লাব কাইসারস্লটার্নেই আবার যোগ দেন তিনি। পরের ৮ মৌসুমে ১৭৬ ম্যাচ খেলে করেন ১৯৫ গোল, জিতে নেন ২বার জার্মান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। অবসরের আগ পর্যন্ত এই ক্লাবেই কাটিয়ে দেন তিনি।
১৯৫০ বিশ্বকাপে অক্ষশক্তির দেশ হওয়ায় নিষিদ্ধ করা হলেও ১৯৫৪ বিশ্বকাপে সুইটজারল্যান্ড বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে পশ্চিম জার্মানি। এই টুর্নামেন্টে তাকে পশ্চিম জার্মানির অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়। প্রথম ম্যাচে তুরস্ককে ৪-১ গোলে হারালেও পরের ম্যাচে হাঙ্গেরির কাছে ৮-৩ গোলে বিধ্বস্ত হয় তারা। গ্রুপ পর্বে তুরস্ক ও পশ্চিম জার্মানির পয়েন্ট সমান হওয়ায় প্লে অফ ম্যাচের আয়োজন করা হয়। ঐ ম্যাচে ফ্রিটজ ওয়াল্টার টুর্নামেন্টের প্রথম গোল করেন।
সেমিফাইনালে অস্ট্রিয়াকে ৬ – ১ গোলে হারানোর পিছনে তার করা ২ গোল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফাইনাল ম্যাচে হাঙ্গেরিকে ৩ – ২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতে পশ্চিম জার্মানি।
জার্মানির প্রথম অধিনায়ক হিসেবে জিতে নেন বিশ্বকাপ, এছাড়াও তার ভাই ওটমার ওয়াল্টার এবং তিনি দুই সহোদর ভাই যারা প্রথম বিশ্বকাপ জেতার রেকর্ড গড়েন। বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে তার উপস্থিতি উৎসাহ জুগিয়েছিল প্রতিটি খেলোয়াড়কে।
১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়। ফলে ভেঙে পড়ে হাঙ্গেরির অর্থনৈতিক অবস্থা, সাথে শেষ হয়ে যায় হাঙ্গেরির ফুটবলের সোনালী যুগও। এমন সময় তাদের পাশে দাঁড়ান ফ্রিটজ ওয়াল্টার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার প্রান বাঁচানোর জন্য হাঙ্গেরির ফুটবল দলকে অর্থসাহায্য দেন তিনি। তবে হাঙ্গেরির ফুটবলের সেই সোনালী প্রজন্মকে আর কখনোই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
১৯৫৮ বিশ্বকাপে তাকে জার্মানির ‘অনারারী’ অধিনায়ক করা হয়। তিনি তার শেষ ম্যাচ খেলেন ১৯৫৮ বিশ্বকাপে সুইডেনের বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচে। ইনজুরিতে পড়ার ফলে তিনি আর ম্যাচ খেলতে পারেননি। ১৯৫৯ সালে ফুটবল থেকে অবসর গ্রহনের মাধ্যমে ইতি ঘটান তার চিরস্মরণীয় অসাধারণ ক্যারিয়ারের।
১৯৮৫ সালে তার সম্মানার্থে এফসি কাইসারস্লটার্নের হোমগ্রাউন্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ফ্রিটজ ওয়াল্টার স্টেডিয়াম’। ২০০২ সালের ১৭ই জুন জার্মানির এনকেনবাখ আলসেনবোর্নে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তার স্বপ্ন ছিল ২০০৬ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে কাইসারস্লটার্নের ফ্রিটজ ওয়াল্টার স্টেডিয়ামে, কিন্তু তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশান তাকে বিগত ৫০ বছরের ‘গোল্ডেন প্লেয়ার’ হিসেবে নির্বাচিত করেন।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য