স্বপ্নচূড়ায় উনিশ (পর্ব-৩)
পোস্টটি ৭২০৮ বার পঠিত হয়েছে
মাশরাফির ভাবনাটা ততক্ষণে আঁচ করতে শুরু করেছেন বাকি ৪ জন। কিন্তু পুরোপুরি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। ক্যাপ্টেন মাশরাফি উইনিং কম্বিনেশনে বিশ্বাস করেন না, এ কথা চর্বিতচর্বণ! তাই সেমি-ফাইনালে ভারতকে হারানো একাদশই তিনি রেখে দেবেন এমন হতে পারে না। তাছাড়া ভারত উপমহাদেশীয় দল, আর ইংল্যান্ড খেলছে হোম গ্রাউন্ডে। দুই দলের বিপক্ষে দুই ভিন্ন ট্যাকটিক্সে দল যাবে সেটা অনুমেয়ই!
'মাশরাফি ভাই, কি সিদ্ধান্ত নিলেন?' জিজ্ঞেস করলেন রিয়াদ!
'আচ্ছা, ওপেনিং পেয়ার এ কে কে খেলবে?' তামিম জিজ্ঞেস করলেন!
মজা করার লোভ সামলাতে পারলেন না সাকিব। বলে বসলেন, 'তামিমকে বসিয়ে দিলে কেমন হয়? এক টুর্নামেন্টে মাত্র একটা সেঞ্চুরি করলে হয় নাকি?' বলেই নিজের কৌতুকে নিজেই হো হো করে হেসে উঠলেন!
'দুইবার ৯০ এ গিয়ে আউট হলাম সেটা কি কাউন্ট হয় না?' মুখটা বেশ ভারী ভারী করার চেষ্টা করলেন তামিম।কিন্তু পারলেন না। তিনিও হেসে উঠলেন।
পরিবেশ হালকা হয়ে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন ঘাড় ঘুরিয়ে তামিমের দিকে ফিরলেন। কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট, 'ওপেনিং এ তো আমরা দুইজনকে চেষ্টা করেছি। সৌম্য অথবা লিটন দুজনই অনেক বেশি ভাল করেনি আবার অনেক বেশি খারাপও করেনি। সাউদাম্পটনে দুজনকেই বিশ্রাম দেওয়া ম্যাচে শান্ত আফগানিস্তানের ৬২ করেছে। একমাত্র ম্যাচে এটাও অনেক ভাল! কিন্তু লিটন নটিংহ্যামে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৮৭ রানে আউট হয়, সৌম্য ব্রিস্টলে শ্রীলঙ্কার সাথে ৮৪ রানে। বলার মত দুজন এই দুটি ম্যাচেই খেলেছে। তাই আমাদের কিছু করতে হলে অনুমান আর পটেনশিয়ালিটি বিবেচনায়ই করতে হবে!'
হঠাৎ দরজায় টোকা। দুইবার দিয়ে থেমে গেলেন দরজার ওপাশে যিনি আছেন। মুশফিক উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। কোচ স্টিভ রোডস! ক্যাপ্টেন কোচকেও ডেকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু শুরুর থেকেই না, নিজেদের কথার পর!
'তারপর? কিছু চিন্তা করলে, ফাইটার?' স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাশরাফিকে জিজ্ঞেস করলেন কোচ!
পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করলেন মাশরাফি! সেখানে ১১ জনের নাম লেখা। সারাংশ করলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এমন-
১/ তামিম
২/ লিটন(!)
৩/ সাকিব
৪/ মুশি
৫/ রিয়াদ
৬/ মিথুন (!)
৭/ সাইফুদ্দিন(!)
৮/ মিরাজ
৯/ মাশরাফি
১০/ মুস্তাফিজ
১১/ রুবেল
কাগজটা নেড়েচেড়ে দেখছেন কোচ! কোচের হাত থেকে নিয়ে সাকিবও উল্টেপাল্টে দেখলেন।
'২,৬ আর ৭ এ বিস্ময়বোধক মার্কিং এর কারণ কি?' জানতে চাইলেন সাকিব।
মাশরাফি বলছেন, 'এই ৩ টি পজিশন নিয়ে আমি এখনও নিশ্চিত হতে পারছি না। ২ এ লিটন ভাল করলে ৬ এ মিথুনের জায়গাতে সাব্বিরকে লাগবে আমাদের। আরিফুলও হতে পারে ভাল অপশন। শেষ বিপিএল এ দুজনই দারুণ খেলেছে। আবার টপ অর্ডার কলাপ্সের চিন্তা নিলে মিথুন আসতে পারে। ৭ নং এ পেস বোলিং অলরাউন্ডার খেলাব নাকি স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি! কাল পিচ দেখে ঠিক করব।.... তারপর কোচ?আপনার দেশেই ত ফাইনাল.. পিচের ব্যাপারে কি মনে হয়?..............
মিরাজের সামনে দিয়ে তামিম লিটন, সৌম্য আর নাজমুলকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছে। সাকিব সৈকতকে খুজতে বলেছিলেন। খোজা হয়ে গেছে। একটু পরই ৩ জন বসবে। তার আগে মিরাজ একবার নিজের রুমে গেলেন। সাইফুদ্দিন আর মিরাজ দুজনই এক রুমে থাকে। সাইফুদ্দিন রুমে নেই। মাশরাফির সাথে বেরিয়েছে। আয়নার দিকে চোখ পড়ল মিরাজের! জেসন রয়কে আটকানোর চিন্তাটা মগজে গেড়ে বসেছে। ইংল্যান্ডের সাথে নিজেদের গ্রুপ পর্বের ম্যাচটার কথা মনে করতে পারছে মিরাজ।বহু স্মৃতির কার্ডিফে সে ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল। ইংল্যান্ডের টোটাল দাঁড়িয়েছিল ৩৪২ এ! জেসন রয় একা করেছিলেন ১৩২।ম্যাচটা ওখানেই শেষ হয়ে যায়। ফাইনাল জিততে হলে তাই জেসন রয় কে ফেরাতেই হবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। টিম-মিটিং এর কথা মনে পড়ছে মিরাজের। স্মৃতিতে ভেসে আসছে ইংল্যান্ড ইন্ডিয়া ম্যাচ! সে ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল ভারত! কুলদ্বীপ কে দিয়ে বোলিং ওপেন করিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন কোহলি। প্রথম বলেই অফ স্ট্যাম্পের বাইরের স্কিড করা ডেলিভারিতে ধোনির হাতে ক্যাচ দিয়েছিলেন, বলা ভাল দিতে বাধ্য হয়েছিলেন জেসন! মিরাজও কি তেমন কিছু করবে? জেসন কি বারবার একই ফাঁদে পা দেবে? নাকি নিজের স্বাভাবিক একুরেট বোলিং টাই করবে মিরাজ?
প্রকৃতি চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে কখনও কখনও সূক্ষ্ম রেখা টেনে দেয়, কখনও কখনও মিলিয়ে দেয় আবার কখনও কখনও একে ওপরের ওপর লেপ্টেও দেয়! বিশ্বকাপ ফাইনালে দলের এত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে যাবে, মিরাজ নিজেও কি এতটা ভাবতে পেরেছিল?
কিছুক্ষণ পর। সাকিব , মিরাজ আর সৈকত একসাথে বসে আছে। সময় বেশি নেই। দ্রুতই টিম বাস ছাড়বে।তার আগে ঝটিকা এক আলোচনা করে ফেলতে হবে।
‘আমরা মিরাজকে দিয়ে বোলিং ওপেন করাব,’ বললেন সাকিব। সৈকত বেশ অস্বস্তিতে আছে। টিম সিলেকশনে এখনও তার একাদশ নিশ্চিত হয়নি।বিশ্বকাপটা তার জন্যে ভাল যাচ্ছে।লন্ডনে পাকিস্তানের সাথে ৫২ রানের একটা ইনিংস খেলেছে সে, এই লন্ডনেই নিউজিল্যান্ডের সাথে উইকেট গেঁড়ে বসা টম ল্যাথামকে ফিরিয়েছে। আসলে লম্বা সূচির এই বিশ্বকাপে দলের কোর-গ্রুপকে ঠিক রেখে সবাইকেই অদল-বদল করে খেলিয়েছেন অধিনায়ক, ‘আমাদের গেম প্লান এর প্রাইমারি স্টেপ বোলিং নিলে দ্রুতই জেসন রয় কে ফেরানো। মিডল অর্ডারে মরগানকে ফেরানোর জন্যে রুবেল ভাল কাজে দেবে। কিন্তু এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সবথেকে ইফেক্টিভ ম্যাচ উইনার জেসন। মিরাজের কাজটাই হবে দ্রুত জেসনকে ফেরানো’।
মানুষ চাইলেও অনেক সময় চাওয়াকে পাওয়াতে রূপান্তরিত করতে পারে না।এমনও হয়, স্রষ্টাই হয়ত রূপান্তর করতে দেন না। আজও আকাশ মেঘলা, লর্ডসের আকাশে মেঘের উঁকিঝুঁকি। ক্রিকেটদেবতা মেঘদেবের সাথে জোরাজুরি খাটাতে পছন্দ করেন বলেই কিনা কে জানে, শাস্ত্রে আছে মেঘলা কন্ডিশনে পেস বোলিং টা নাকি দারুণ জমে।
বাইরে তাকিয়ে সেই মেঘলা দিনের একলা বাস্তবতাই হয়ত দেখছিল মিরাজ।কিন্তু সাকিব তাতে বাঁধ সাধলেন, ‘মেঘ দেখে করিসনে ভয়, আড়ালে তার স্কিল হাসে’।
সাকিবের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না মিরাজ । মিরাজের কাঁধে হাত রাখলেন সাকিব, ‘স্পিন বোলিং এক জাদু মিরাজ ।বল করতে জানলে যেকোন পিচেই ফাইভ-ফার পাবি।দরকার শুধুই সাহস আর আত্মবিশ্বাস।তুই যদি ভাবিস তুই পারবি, তাহলে তোকে রুখতে পারবে না কেউই’ বলে সৈকতের দিকে ফিরলেন সাকিব, ‘তারপর.............
টিম বাস ছেড়ে যাচ্ছে! দুই দিন ধরে দুই দল এই হোটেলে আছে। এর ওর সাথে দেখা হচ্ছে। বাটলারের সাথে কখনও রিয়াদকে খুনশুটি করতে দেখা যায়, কখনও দেখা যায় সাকিব আর হেলসকে একসাথে গল্প করতে। ক্রিকেটের ফ্রাঞ্চাইজিভিত্তিক লীগগুলো ক্রিকেটের স্পিরিটকে খানিকটা বাধাগ্রস্ত করলেও, বিশ্বব্যাপী প্লেয়ারদের একত্রিত করেছে এ কথা নি:সঙ্কোচে স্বীকার করতে হবে বৈকি!
ভ্রুম.... করে বাস ছাড়ল! সবারই হার্টবিট কাপছে। মাশরাফি আর রোডস সামনের সারিতে বসেছেন। ঠিক পেছনেই সাকিব আর রিয়াদ! আলগোছে কি কিভাবে ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরা যায় সেই পরিকল্পনাই করছে ওরা? (চলবে)
- 0 মন্তব্য