ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম দুর্ভাগা এক ফুটবলার!
পোস্টটি ২৩৬০ বার পঠিত হয়েছে৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা মানুষটি বাঁ পায়ে যেমন খেলতেন, ঠিক তেমনি চলত তার ডান পাও।ছিলেন একজন ধারাবাহিক গোল স্কোরার, তার ট্যাকল ছিল পার্ফেক্ট, সাথে এরিয়েলে ছিলেন বিপক্ষ দলের জন্য হুমকি। মুল কথা, মিডফিল্ডের ফুল প্যাকেজ। তাকে আপনি চাইলে এটাকিং মিডফিল্ডে খেলাতে পারেন, সেন্টার তার ন্যাচারাল পজিশন আবার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডেও অসাধারণ। সবচেয়ে বড় কথা তিনি আজীবন খেলে গেছেন দলের জন্য, যখন যেভাবে প্রয়োজন সার্ভিস দিয়েছেন।
" One day your child will play for German national football team"
ইঞ্জিনিয়ার বাবা ক্যারিন আর মা স্ট্যাফানকে কনভিন্স করার জন্য জামার্ন লিগের দ্বিতীয় সারির দল কেমনিৎজারের কোচদের এ একটি বাক্যই যথেষ্ট ছিলো। মাত্র ৬ বছর বয়স থেকেই তাকে নজরে রেখেছে বলে তারা হয়তো বুঝতে পেরেছিলো এ ছেলেটাই একদিন মিডফিল্ডের রাজা হয়ে যাবে, এ ছেলেটাই একদিন হয়ে উঠবে জার্মানির মানুষের স্বপ্নের সারথী। শিষ্যের প্রতি তাদের এতটাই আস্থা ছিলো যে তাকে তারা প্রতিটি প্র্যাক্টিস ম্যাচেই নিজেদের জুনিয়র ক্লাবে অধিনায়ক হিসেবে খেলাতেন, এমনকি প্রতিটি ম্যাচের ট্যাকটিক্স নির্ধারণের জন্য তার পরামর্শও নেয়া হতো আর সেগুলোকে বেশ গুরুত্বও দেয়া হতো।। বলছিলাম জার্মানির মধ্যমাঠের সেনাপতি মাইকেল বালাকের কথা।
অন্যান্য ইতিহাস খ্যাত ফুটবলারদের মতো তার প্রাক ফুটবল ক্যারিয়ারে তেমন কোন করুণ চিত্রের আবহ পাওয়া যায় না। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে থেকে বড় হয়েছেন বলে প্রায় সব চাহিদারই যোগান করতে পেরেছিলেন। বাবা ক্যারিন ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার, তবে প্রথাগত বাবাদের মতন ছেলেকে তিনি সেদিকে যাওয়ার জন্য তেমন কোন চাপ দেন নি ।পরবর্তীতে বালাক নিজেও স্বীকার করেছিলেন, যদি ফুটবলার না হতে পারতেন, তবে বাবার কোন চাপ না থাকা সত্ত্বেও তিনি একজন ইঞ্জিরিয়ার ই হতেন । ১৯৭৬ সালে সেক্সোনি রাষ্ট্রের গোরলিৎজ শহরে জন্ম হয় মাইকেল বালাকের। ক্যারিয়ার শুরু করার প্রত্যয় নিয়ে তিনি মাত্র ৬ বছরে জার্মানির দ্বিতীয় বিভাগের দল কেমিৎজারে যোগদান করেন। তার যে গুণটি সেখানকার কোচদেরকে মুগ্ধ করে, তা হলো তার দুই পায়ের অসাধারণ ফুটওয়ার্ক।
১৯ বছর বয়সেই কেমিৎতাজের সাথে যখন প্রথম প্রফেশনাল কন্ট্রাক্ট করেন, তার আগেই তার গায়ে লেগে গিয়েছিলো “ছোট কাইজার” তকমা। আরএ তকমাটা কে দিয়েছিলেন? ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডিফেন্ডার ফ্রেঞ্চ ব্যাকেনবাওয়ার ! ভাবা যায়? একজন আদর্শ লিডার, যিনি ক্যারিয়ারের শুরুর লগ্নেই খ্যাতি পেয়েছিলেন 'ছোট কাইজার (রাজা)' নামে, যিনি দলের ড্রেসিংরুমকে সদা হাস্যোজ্বল রাখতেন, তাকে মানুষের ভালো না লেগে কিভাবে পারে? শুধু মাত্র বিপক্ষ দলের প্লেয়ার বলে? নাকি তার খেলায় হিংসা করে? ছিলেন একজন মিডফিল্ডার তবুও জাতীয় দলের হয়ে ৯৮ ম্যাচে তার গোল ৪২ টি।
আবার বায়ার্ন মিউনিখ এর হয়ে ১০৭ ম্যাচ খেলে গোল ৪৪ টি। ২০০১-০২ সিজনে লিভারকুসেনের হয়ে জিততে পারতেন ট্রেবল। কিন্তু ভাগ্যের কাছেই হারতে হয় বালাককে। লীগ জিততে শেষ ম্যাচে মাত্র এক পয়েন্টের দরকার ছিল, কিন্তু বালাকের আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পরা লেভারকুসেন সেই ম্যাচে ২-০ তে হারে। চ্যাম্পিয়নস লীগ হারে মাদ্রিদের কাছে আর ডিভিবি পোকালে ফাইনাল ম্যাচে হেরে রানার্স আপ হতে হতে হয় শালকের কাছে। ২০০২ বিশ্বকাপে জার্মানরা যেন নতুন রুপকথা লিখতে যাচ্ছিল। সাধারণ গড়পড়তা দল নিয়ে ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল গোলবারের অলিভার কান আর মিডফিল্ডে তরুণ বালাকের জন্যই। দুর্ভাগ্য যে নিশ্চিত গোল বাঁচাতে ট্যাকল করতে গিয়ে হলুদ কার্ড পান বালাক। তখন ১৯৯০ বিশ্বকাপের পল গ্যাসকোয়েন এর দ্বিতীয় পর্ব দেখবেন ভেবেছিলেন হয়ত অনেকই। অনেকটা একই কারণে কার্ড পেয়ে ফাইনালে খেলতে পারবেন না জেনে ভেঙ্গে পরা গ্যাসকোয়েন দলকে ফাইনালে নিতে পারেন নি, হেরে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু মাইকেল বালাক হারেন নি। বরং দলের হয়ে উইনিং গোল করে নিয়ে যান ফাইনালে।
সেই দিনই জার্মানির কোচ রুডি ভোলার নাকি তাকে "ঈশ্বরের লীলা " বলে শান্তনা দিয়েছিলেন। আশার বাণী শুনিয়েছিলেন যে, ভবিষ্যতে এই ত্যাগের জন্য ঈশ্বর তাকে ভালো কিছু উপহার দেবেন। কিন্তু ঈশ্বরের কি মহিমা কে জানে? ২০০৮ সালে সেই ২০০২ সালেরই পুনরাবৃত্তি। চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনালে চেলসি বনাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষে ম্যাচ পেনাল্টিতে। কিন্তু পেনাল্টি কিকের সময় দুর্ভাগ্য জনিত জন টেরি স্লিপ করেন, গোল মিস হয়। রানার্স আপ হয়ে বিদায় নেয় চেলসি, আবারও দ্বিতীয় হয়ে বিদায় নেয় বালাক। আবার সেই বছরেই ইউরো ০৮ এ জার্মানিকে গোল করে, গোল করিয়ে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু দ্বিতীয় হবার পালা যে তার তখনো শেষ হয়নি, তরেসের গোলে স্পেনের কাছে হেরে যায় জার্মানি। আবারো বালাকের স্বপ্ন ভঙ্গ, বড় আসরের ট্রফি তার অধরাই থেকে যায়।
বালাকের শেষটা অনেকটা দুঃখজনক, এফ এ কাপের ফাইনালে প্রিন্স বোয়েটেং এর করা ট্যাকল তার ক্যারিয়ারই শেষ করে দেয়। যেখানে ১০ বিশ্বকাপে দলের ক্যাপ্টেন হওয়ার কথা ছিল তার সেখানে দর্শক হয়ে দেখলেন তরুন জার্মানির তৃতীয় হওয়া। পরে কোচ ইউয়াখিম ল্যো তাকে জাতীয় দলের হয়ে দুটি ফেয়ার ওয়েল ম্যাচ খেলে ১০০ টি ম্যাচ পূর্ণ করার জন্য আহবান জানালেও বালাক তা গ্রহণ করেনি। হয়ত দরকার ছিল না তার কোন ফেয়ারওয়েল ম্যাচের। কারণ বালাক নিজেও জানেন, এমন অনেকেই আছেন যাদের জন্য বালাক অনেক কিছু, আর তারা তাকে এমনিই মনে রাখবে তাদের অন্তরে।
আর যাদের জন্য বালাক একজন আনফুলফিল্ড পার্সন, আজীবন দ্বিতীয় হওয়া লুজার, তারা তাকে কখনোয় ভালো ভাববে না। জাতীয় দলের হয়ে যদি মাইকেল বালাকের পারফরমেন্সের দিকে নজর দেন, তবে হিংসাই হতে পারে আপনার। তবে অর্জনের খাতা খুলে বসলে হয়তো আক্ষেপই হতে পারে আপনার, তেমন কিছুই যে নেই সেই খাতায়। প্রতিটিবারই শেষ পর্যায়ে এসে ধরা খেতে হয় তার দলকে, ২০০২ বিশ্বকাপের এর ফাইনাল, ২০০৬ এর বিশ্বকাপ সেমি, ২০০৮ এর ইউরোর ফাইনাল – একটিতেও জার্মানি সাফল্য পান নি।
তার উপর ছিলো ঘন ঘন ইনজুরির তাড়া, দলে তার জায়গাও তখন আরেকজনের দখলে, লামের হাতে উঠে গেলো ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড! তাতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই জাতীয় দল থেকে অবসর নেন ও কয়েক বছর পরে ২০১২ সালে ফুটবল ক্যারিয়ারের সোনালি অধ্যায়টা কে থামিয়ে দেন মাইকেল বালাক! বিশ্বকাপটা হয়তো জয় করতে পারেন নি জার্মানির ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মিডফিল্ডার, কিন্তু তা তো মানুষের মন থেকে বালাকের জাদুকরী মুহুর্তগুলাে মুছে দিতে সক্ষম নয়! আর এজন্যই ক্যারিয়ার শেষে বলেছেন-
"Titles are sometimes overrated. Of course Lothar Matthäus is always going to be associated with the 1990 World Cup. But does everyone immediately remember what titles Günter Netzer, Johan Cruyff or Luís Figo won? Or do they also think about how those players played their football and how they led their teams? I hope that people will remember me as a special footballer."
ফুটবল মাঠে আর দেখা যাবে মাইকেল বালাক কে। কিন্তু না, বালাক কখনোই হারিয়ে যাবে না ট্রু ফুটবল ফ্যানদের মন থেকে। ফুটবল যতদিন আছে, ততদিন হয়ত মিডফিল্ডের সম্রাটদের সাম্রাজ্যে বালাকের নামটা উজ্জল হয়ে থাকবে।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য