• ক্রিকেট

নেপিয়ারে নয়া বসন্ত

পোস্টটি ৫৪২৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ক্যাপ্টেন খুব সম্ভবত একটা বাজি ধরেছিলেন। প্রতিকূল কন্ডিশনে ম্যাচ জয়ের বাজি, হয়ত নিজেরাই নিজেদের চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ার বাজি! নয়ত এমন একাদশ নিয়ে ম্যাচ খেলতে একজন মাশরাফি বিন মর্তুজা নামবেন, বিশ্বাস হবার নয়!

নেপিয়ারের উইকেট রানপ্রসূতি। ৩০০- র আশেপাশে রান না করলে বা রান তাড়া না করতে পারলে জেতা সম্ভব না, এসবই জানা কথা। কে জানে, এই ভাবনাতেই হয়তোবা একাদশে ঠাঁই মিলল ৯ ব্যাটসম্যানের, ব্যাটসম্যান মাশরাফিকে ধরলে যা দাঁড়াবে এক বেড়ে দুই অঙ্কে!

রক্ষণাত্মক কৌশল! বোলিং ডিপার্টমেন্টে অভিজ্ঞতা বলতে শুধু ক্যাপ্টেন নিজে আর কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। সাথে নয়া অলরাউন্ডার সাইফুদ্দিন ফ্রন্টলাইন পেসার হিসেবে খেলবেন, দেখতে হবে এমন পিচে মিরাজই বা কি করেন!

২ অলরাউন্ডার, ২ জেনুইন পেসার নিয়ে ৪০ ওভার করানো যাবে। বাকি ১০ ওভার ভাগ করে করবেন অকেশনাল বোলার রিয়াদ, সৌম্য কিংবা সাব্বির। ম্যাচ খেলতে নামার আগেই যখন অকেশনাল বোলার দিয়ে বল করাতে হবে নিশ্চিত হতে হয়, তখন আস্থার শতভাগ রাখতে হয় ব্যাটিং ইউনিটের উপর!

ক্যাপ্টেন টসে জিতলেন! যখন আপনি এক অনভিজ্ঞ বোলিং লাইনআপ নিয়ে খেলতে নামবেন এবং ধরেই রাখবেন অকেশনাল বোলাররাই আপনাকে রান আটকে ম্যাচ বের করবে তখন অবশ্যই টসে জিতে বোলিং ইউনিটকে ফ্রি করতে হবে, চাপহীন বোলিং করতে হবে এবং নিশ্চিত হতে হবে ১০ ব্যাটসম্যান মিলে লম্বা স্কোর তাড়া করে আপনাকে ম্যাচ জেতাবে!

তা হয়নি। ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক মাশরাফি বিন মর্তুজা 'রীতি' ভেঙে টসে জিতলেন, কিন্তু নিয়েছেন ব্যাটিং! ক্যাপ্টেন মাশরাফিকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব নয়, কখন কি করেন তাও পড়ে ফেলা সম্ভব নয়। এই যেমন মুস্তাফিজকে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন, ভারতের সাথে সিরিজ জিতিয়েছিলেন। মিরাজকে এশিয়া কাপ ফাইনালে ওপেনে পাঠিয়েছিলেন, বহুদিন পর শতরানের ওপেনিং জুটি দেখা গেছিল। মিরপুরে চার পেসার নামিয়ে দিয়েছিলেন যার বাকিটা ইতিহাস!
অবশ্যই এমনই কোন এক গেমপ্লান নিয়ে কাল মাশরাফি বিন মর্তুজা নেমেছিলেন যার পুরোটাই ভবানীর ভাঁড়ে গেছে, নিয়ে গেছেন তাঁরই খেলোয়াড়েরাই!

শুরুটা হয়েছিল দারুণ! বসন্তের শুরুতে আধকুয়াশার ভোরে তামিমের চারে শুরু হওয়া সকালটা বসন্তপল্লবের মতই নতুন ছিল, ছিল আশা জাগানিয়া! বসন্তবিলাস ওখানেই শেষ করে বোল্টের দারুণ এক সুইংয়ে তামিম যখন প্যাভিলিওনে ফিরছেন, আমাদের মত তামিম নিজেও হয়ত ভাবছিলেন এমন ডেলিভারিতে ব্যাটসম্যানের দায় সামান্যই!

DWEvJzGX0AAl23o

কিউই উইকেটে টিকে থাকলে রান আসবে। কিন্তু পিঞ্চ হিটিং এ বিশ্বাসী সৌম্য এতটুকুতে বিশ্বাস করতে নারাজ। যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন হুক, পুল, কাভার ড্রাইভে এমন সব শটের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন যা আক্ষরিক অর্থেই বসন্ত বন্দনা ছাড়া কিছুই নয়! কিন্তু ঐ যে, সব সেরাই যেমন বিশ্বসেরা হয় না, সব বলই স্ট্রোক মেকিং বল হয়না! বাউন্সারে সাবলীল সরকার বাউন্সারেই কাত! বসন্ত থেমে গেছে!

Liton_Das

 

বসন্ত থামার আগে আরেক বসন্তও পেরিয়েছে। শুরুর থেকেই ধুঁকতে থাকা লিটন দাস ব্যাট প্যাডের ফাকে বিরাট ফাঁক রেখে কি এক শট খেলতে গিয়ে আউট! লিটন কে নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি । পুরো টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থার হাত তার কাঁধেই রয়েছে। জিম্বাবুয়ের সাথে ওপেন করে ৩৪৯ করা কায়েস যে কারণে তামিম ফিরলে ওপেন থেকে সরে গেছেন, থেকে গেছেন লিটন। কিন্তু লিটনকে এবার নিজেই নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে সম্ভবত। পুরো ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বলার মত এক এশিয়া কাপ ফাইনাল ছাড়া কিছুই তিনি করেননি (জিম্বাবুয়ের সাথে ৮৩ রানের একটা ইনিংস আছে)। লিটন এদেশের ইয়াংস্টারদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়, টেকনিক্যালি শার্প আর দারুণ ইনিংস খেলার সামর্থ্যও রাখেন। কিন্তু পূজা করা না গেলে ফুল যে ঠাকুরঘরে থাকবে না সেটাও লিটনকে বুঝতে হবে! মেঘে মেঘে বেলা তো কম হয়নি!

কেমন খেলা উচিত সেটা কিছুটা দেখাতে গিয়েছিলেন মুশফিক। পারেননি। অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে প্লেইড অন হয়ে মুশি প্যাভিলিওনে! তবে দেখাতে চাওয়া পথ ততক্ষণে ড্রেসিং রুমে বসে দেখে ফেলেছেন মোহাম্মদ মিথুন!

Mushfiq

 

মোহাম্মদ মিথুনের শট দেখতে ভাল লাগে না, চোখে প্রশান্তি দেয় না। নড়াচড়া তে দর্শক গলে না। সেই মিথুন এমন সময়ে নামলেন যখন ৪৫ র আগে তিন উইকেট শেষ!১০০ র আগে ছয় উইকেট।  ঠিক সেখান থেকে আস্তে আস্তে দলের রান বাড়াচ্ছিলেন, সাইফুদ্দিন যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছিল। এমন পিচে লকি ফার্গুসন, ট্রেন্ট বোল্ট, মিচেল স্যান্টনার, ম্যাট হেনরি কে সামলে এমন সাবলীল ইনিংস মিথুন খেলে ফেলবেন, দুই বছর আগে মিথুন নিজেও হয়ত বিশ্বাস করতেন না! কিন্তু শুধুই যে প্রতিকূল নিউজিল্যান্ডে মিথুন রান পেয়েছেন এমন নয়, দুবাইয়ের আধুনিক ক্রিকেটের সাথে বেমানান স্লো উইকেটেও মিথুন রান পেয়েছেন, একজন আদর্শ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের মত দলের ইনিংস ভারী করেছেন.. তাও এমন এক সময়ে যখন দল ভীষণ বিপদে! এমন মোহাম্মদ মিথুনকে মিডল অর্ডারে আপনাকে কাউন্ট করতেই হবে! যা হোক, নেপিয়ারের বসন্ত যা একটু মিথুনই সকালে দিয়েছেন।

একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার খোজার শেষ হতে যাচ্ছে সম্ভবত।মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন কে যথেষ্টই সাহসী মনে হচ্ছে। জিম্বাবুয়ের সাথে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন, প্রতিকূল তাসমানপাড়েও যাওয়া আসার মিছিলে উইকেটে টিকে রান করেছেন। মিথুনীয় বসন্ততে সাইফুদ্দিনকে ভুললে চলবে না!

MohammadSaifuddin

বাকি যা হয়েছে তা হবারই ছিল। নেপিয়ারের উইকেটে ২৩২ করার পর বোলারদের কার্যত কিছু করার থাকে না। তার ওপর সেখানে খেলতে নামা হয়েছে কোন স্পিডস্টার ছাড়া! নিউজিল্যান্ডের মাটিতে পেসাররা বরাবরই সুবিধা পায়, গতি এখানে উইকেট এনে দেয়। ক্যাপ্টেন মাশরাফির গতি ইঞ্জুরির ছোবলে বহুদিন আগেই শেষ, সাইফুদ্দিনের গতি ১৪০ পার করবে না, মুস্তাফিজের মূল শক্তিই কাটার! সেখানে একমাত্র ছিল রুবেল আর তাসকিন। তাসকিন ইঞ্জুরির আঘাতে দেশে, একমাত্র উপায় রুবেল! সেই 'যক্ষের ধন' কে কেন বেঞ্চেই বসে থাকতে হল বুঝে আসেনি। তবে আগেই তো বলেছি, ক্যাপ্টেন মাশরাফি কে পড়ে ফেলা সম্ভব নয়!

এই যে সদা আক্রমণাত্মক অধিনায়ক এত রক্ষণাত্মক কৌশল বেছে নিলেন, চাইলে এর ডালপাতা অনেক দিকে প্রসারিত করা যায়। ৬ ব্যাটসম্যানে যা হয়না, তা ৯ এও হয়না তা বলা বাহুল্য। তবুও অধিনায়ক তা করেছেন তা কি এই কারণে যে টপ অর্ডারের 'প্রতিভাবান' তরুণদের ওপর ক্যাপ্টেন যথেষ্ট আস্থাশীল ছিলেন না? কিংবা সাকিব আল হাসানকে হারানোর ধাক্কা ক্যাপ্টেন নিজেই সামলাতে পারেননি? শেষটা তো অন্তত মাশরাফি নামক যোদ্ধার হবার কথা নয়!

গল্পের অন্য পিঠও আছে। আস্থাহীন এর জায়গায় ক্যাপ্টেন কি তার বোলিং ইউনিটে যথেষ্ট আস্থাশীল ছিলেন? কে জানে!

তবে যে পিঠেই যা থাকুক, সবচেয়ে বেকায়দা অবস্থায় সম্ভবত লিটন দাস! এই সিরিজে রান না পেলে টিম ম্যানেজমেন্ট নতুন করে তাকে ভাববে তা বলার অপেক্ষা রাখছে না! নেপিয়ার ঘুরে ক্রাইস্টচার্চে যে শুধুই লিটনকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে তাও নয়, ঘুরে দাঁড়াতে হবে পুরো দলটাকেই!

একাদশে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে রুবেল হোসেন যদি ঢুকেই পড়েন তবে কার বদলে? অলরাউন্ডিং পারফর্ম্যান্সের সাইফুদ্দিন কে হয়ত বসাবে না। তাহলে করালের আঘাত হয়ত পড়তে যাচ্ছে লিটন কিংবা সাব্বিরের ওপর। বিশ্বকাপ ভাবনায় এ দুজনকে আবার বাদ দেওয়াটা কঠিন। আঘাত টা যার ওপর পড়তে পারত সেই মিথুন আবার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন আগের ম্যাচেই!

উড়তে থাকা বাংলাদেশ নেপিয়ারের নয়া বসন্ত দেখে ফেলেছে। ভ্যালেন্টাইনস ডে র দুইদিন পর ক্রাইস্টচার্চে কি দেখা যাবে তা বলতে আমাদের অপেক্ষা ছাড়া আর কিছুই করার নেই!