• ফুটবল

ডিফেন্স সাম্রাজ্যে রাজত্ব- 'এল ক্যাপ্টানো', কিংবা একজন মালদিনির গল্প।

পোস্টটি ৫০৭৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবল বিশ্ব অনেক শ্রেষ্ট সন্তানকে দেখেছে। ফুটবল জন্ম দিয়েছে অনেক কিংবদন্তীর। কেউ কেউ ৫ বছর তকমা দেখিয়েছেন কেউ কেউ এক যুগ বড়জোড়।কিন্তু সমান তালে বা সুষম গতিতে কেউই পারে নি। আরে ভাই বছর বাই বছর আপ ডাউন করেছেই পারফরম্যান্স। কিন্তু এ কিংবদন্তী প্রায় ২১ বছর একই গতিতেব একই লেভেলে পারফরম্যান্স করে গেছেন। ক্যারিয়ারের শেষের দিকে এসেও ফর্মের কোন ডিপিং ছিলো না। জাস্ট এ ভেরি হাইক্লাস স্ট্রেইট লাই খুজে পাবেন তার ক্যারিয়ারের গ্রাফে।

ফুটবলে কারিশমাগুলো বাদ দিলে,বেসিকগুলো হচ্ছে পাসিং, রানিং, হেডিং, শুটিং , ইন্টারসেপটিং, কালেক্টিং, ক্রসিং, পজিশনিং, ট্যাকলিং, অফ দ্য বল মুভিং এন্ড পেস। যার কথা বলার চেষ্টা করছি তিনি কিন্তু প্রতিটাতেই পিন পারফেক্ট, ইভেন উইথ বোথ ফুটের স্ট্রেন্থেও। আবার চিন্তা করেন তো কেউ একজন ম্যারাডোনার সাথেও খেলেছে, মেসির সাথেও খেলেছে। আনফরচুনেটলি মেসির যুগে খেলেও তার মুখোমুখি হতে দেন নি ফুটবল বিধাতা। কিন্তু তিনি দু যুগেই খেলেছেন। দ্যাটস হোয়াট আই কলড এ আর্ট আফ লংগেবিটি , এ পারফেক্ট কমপ্লিট প্লেয়ার, এ পিউর লিজেন্ড।গেস হোয়াট? হি ইজ নান আদার দ্যান পাওলো সিজার মালদিনি । গ্রেটেস্ট ব্যাক অফ অল টাইম। শুধুই ব্যাক লিখলাম কারন তাকে আপনি কোন নির্দিষ্ট স্থানে সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন বলে মনে হয় না । পুরো নাম পাওলো সিজার মালদিনি, ১৯৬৮ সালের ২৬ জুন ইতালির মিলান শহরে তার জন্ম।ফুটবল খেলাটা তার রক্তের মধ্যেই ছিল, তার বাবা সিজার মালদিনি ইতালি ও এসি মিলানের সাবেক ফুটবলার।

কে সেরা লেফট ব্যাক পজিশনে? মার্সেলো,আলবা , আলাবা নাকি লুইস? কেউ কোনটাতে পার্ফেক্ট না।ট্যাকনিক্যালি বলেন, টেম্পারমেন্টলি বলেন, শ্যুটে বলেন আবার অ্যাটাক আর ডিফেন্সে এফেক্টিভনেস এ ব্যালেন্সে বলেন! কেউই সবগুলোতে সমান সফল না। অনেকে আবার রবার্তো কার্লোসকে মালদিনির সাথে তুলনা করেন! হ্যা রবার্তো কার্লোস নিসন্দেহে সর্বকালের সেরা লেফট ব্যাকদের মধ্যে অন্যতম। ট্রান্জিশনাল প্লে , ফ্রিকিক, ব্যানানা শট এগুলোতে কার্লোস ফার বেটার দ্যান মালদিনি।কিন্তু যখন খেলাটা ফুটবল তখন ট্রিকারির সাথে সাথে সিম্পলিসিটি, গেমরিডিং এবিলিটি, লিডারশিপ সাথে হেডিং, শুটিং, পজিশনিং সবগুলোর মূল্য আছে। যেখানে মালদিনি ইজ ফার বেটার দ্যন এভ্রিওয়ান এল্স।হতে পারে রবার্তো কার্লোস কিছু বিষয়ে আনমার্কেবল। কিন্তু যখন এট্রিবিউটসে হিসাব করবেন তখন দেখবেন সবকিছু ৮০ থেকে ৮৫ এর উপরে থাকবে, মালদিনির ক্ষেত্রে। আপনি সবসময় কার্লোসকে টিমে চাইবেন, কিন্তু আই ক্যান বেট আপনি যদি বলেন তাদের দুজনের মধ্যে কাকে বেছে নিবেন, তাহলে ৮০ শতাংশ মানুষই বলবে মালদিনির কথা ।

লেফট ব্যাকে পজিশনে প্রায় ১ যুগ খেলার পর পেস কমে যাওয়ায় সেন্টার ব্যাকে কনভার্ট হন মালদিনি । এবং সেখানেও সমান সফল ছিলেন তিনি । প্রায় ২৫ বছর এসি মিলানে খেলার পর অবসর গ্রহন করেন তিনি।একজন খেলোয়াড়ের ওয়ান অফ দ্য ক্রিটিকাল এট্রিবিউটস হল অফ দ্য বল স্কিল গুলো। যেমন ,মুভমেন্ট, পজিশনিং,  মার্কিং। ডিফেন্ডারদের জন্যও অলমোস্ট ফার্স্ট প্রায়োরিটি অফ দ্য বল স্কিলগুলো। শুধুই কি ডিফেন্সের মূল স্তম্ভ! তার ক্রস,অ্যাটাকারদের সাথে ট্রান্জিশনাল প্লের কাজ করা, গতি দিয়ে লেফট ফ্ল্যাংকে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের জন্যও হুমকি ছিলো। তিনি এমনই এক খেলোয়াড় ছিলেন যেন অড শটে গোল দিয়েও প্রতিপক্ষের বুকে কাটা বিঁধে দিতেন। আর সেট পিসে তো কন্টিনিয়াস থ্রেড ছিলেন তিনি । কত সাফল্যের শিখরে পৌছিয়েছেন । চাইলেই তো ছাড়তে পারতেন। যেমনটা রাউল করেছেন ক্যারিয়ারের শেষে। কিন্তু তিনি মিলানের জার্সির মায়া ছাড়তে পারেন নি।যখন তিনি অবসরের ঘোষনা দেন তখন এসিমিলানের সব থেকে বড় রাইভাল ইন্টার মিলানের সমর্থকরা, খেলোয়াড়রা ইন্টারের মাঠে তাকে ট্রিবিউট দেয়। যেটাকে তিনি তার ফুটবল জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে অভিহিত করেছেন । এসি মিলান তার অবসরের পর তার ৩ নম্বর জার্সিটি তুলে রাখে তার সম্মাননায়।

জীবনের ২৫টা বসন্ত একই ক্লাবে কাটিয়ে দেয়া, এসি মিলানের মত ক্লাবে সমান দাপটে খেলে যাওয়া,ইতালির হয়ে ১০০ বছরের বেশি খেলা কিংবা ৫টা ইউরোপিয়ান কাপ জেতা অনেকটা এভারেস্ট সমান অর্জনের মতোই। যে খেলার শুরু করার পরেই প্রশ্ন উঠেছিল বাবার নামেই দলে চান্স পেয়েছে বলে, সে খেলোয়াড় ক্লাব ইতিহাসের সেরা, জাতীয় দলের সেরা এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার তথা খেলোয়াড় হবেন বলে ভাবেনি ফুটবল অনুরাগীরা! মালদিনি বলেই এসব সম্ভব হয়েছে। আর যেই আসুক মালদিনির যে কোয়ালিটি ছিলো, কমপ্লিট খেলোয়াড়ের যে গুণগুলো ছিলো আর কেউ অতটা পার্ফেক্ট হবে না। তাই মালদিনির প্রতিচ্ছবিও আর দেখা যাবে না।

অনেকেই হয়তো শুনে অবাক হবেন যে ছোটবেলা পাওলো মালদিনি এসি মিলান নয় বরং ইউভেন্তুসের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তার পরিবারের মিলান শহরে বসবাস ও বাবা এসি মিলানের হয়ে দীর্ঘদিন খেলার কারণে ১০ বছর বয়সে এসি মিলানের একাডেমি দলেই যোগ দেন পাওলো মালদিনি।১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই উদিনেসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে এসি মিলানের মূল দলের হয়ে সেরি-আ তে তার অভিষেক ঘটে, ঐ ম্যাচে তিনি বদলি হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন। অবশ্য ঐ মৌসুমে তিনি এই একটি ম্যাচই খেলেছিলেন। কিন্তু এর পরের মৌসুম থেকেই ক্লাবের প্রথম একাদশের নিয়মিত খেলোয়াড়ে পরিণত হন তিনি। ১৯৮০-৮১ মৌসুমে সেরি-বি জিতে প্রথম বিভাগে ফিরে আসলেও পরবর্তী মৌসুমেই জঘন্য খেলে আবারও রেলিগেশনের শিকার হয় রোজ্জুনেরিরা। অবশেষে ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে সেরি-বি জিতে আবারও সেরি -আ তে ফিরে আসে তারা।

১৯৮৮ সালের ৩১ মার্চ যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলার মাধ্যমে জাতীয় দলের হয়ে তার অভিষেক ঘটে। ঐ বছর পশ্চিম জার্মানিতে অনুষ্ঠিত উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ইতালির সবগুলো ম্যাচেই তিনি খেলেছিলেন। ঐ টুর্নামেন্টে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছিল ইতালি।এখন পর্যন্ত এসি মিলানই সর্বশেষ দল যারা টানা দুইবার ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল, এরপর আর কোনো দল এই কৃ্তিত্ব দেখাতে পারেনি। ঐ সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ডাচ ত্রয়ী বাস্তেন-গুলিত-রাইকার্ড থাকলেও পাওলো মালদিনি, ফ্রাঙ্কো বারোসি, আলেসান্দ্রো কোস্তাকুর্তা ও মাউরো টাসোট্টি – এই চারজনের সমন্বয়ে খুবই শক্তিশালী ডিফেন্স তৈরি করেছিল এসি মিলান। তাদের এই ডিফেন্সকে আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্স কোয়ার্টেট হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

১৯৯০ সালে নিজেদের দেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া ইতালি দলের গুরুত্বপুর্ণ সদস্য ছিলেন মালদিনি।সেমিফাইনালে তারা আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে হেরে গিয়েছিল, নির্ধারিত সময়ে খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। ঐ আসরের গ্রুপ পর্ব থেকে শুরু করে সেমিফাইনালের আগে পর্যন্ত ইতালি একটিও গোল খায়নি। পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ খেলে মালদিনি ঐ বিশ্বকাপের অল-স্টার টিমে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ঠিক ২৮ বছর আগে তার বাবা সিজার মালদিনিও ১৯৬২ বিশ্বকাপের অল-স্টার টিমে নির্বাচিত হয়েছিলেন।ইতালি ১৯৯২ এর ইউরোর বাছাইপর্ব পেরোতে ব্যর্থ হলে অ্যারিগো সাচ্চিকে জাতীয় দলের নতুন কোচ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এসি মিলানে সাচ্চির স্থলাভিষিক্ত হন ক্লাবের সাবেক খেলোয়াড় ফ্যাবিও ক্যাপেলো।

১৯৯১-৯২ মৌসুমে এসি মিলান সেরি-আ তে অপরাজিত থেকে শিরোপা জিতেছিল।যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে মালদিনি ছিলেন জাতীয় দলের সহ-অধিনায়ক। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে নিয়মিত অধিনায়ক ফ্রাঙ্কো বারোসি ইনজুরিতে পড়ে গেলে টুর্নামেন্টের পরবর্তী ম্যাচগুলোতে দলকে নেতৃত্ব দেন মালদিনি। মালদিনির নেতৃত্বে ও ফরোয়ার্ডে রবার্তো ব্যাজ্জিওর অসাধারণ নৈপুণ্যে ইতালি টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌছায়। ফাইনালে আবার প্রথম একাদশে ফিরে আসেন দলের নিয়মিত অধিনায়ক ফ্রাঙ্কো বারোসি। ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনালে অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত ফলাফল গোলশূন্য থাকায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে, টাইব্রেকারে শেষ পর্যন্ত ইতালি ম্যাচটিহেরে যায়। টুর্নামেন্টে উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের ফলে তিনি টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের অল-স্টার টিমে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঐ বিশ্বকাপের পর ফ্রাঙ্কো বারোসি আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ায় জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব পেয়ে যান মালদিনি।

মালদিনির নেতৃত্বে ইতালি ২০০০ সালের ইউরোতে রানার-আপ হয়। পাওলো মালদিনি, আলেসান্দ্রো নেস্তা ও ফ্যাবিও ক্যানাভারোর সমন্বয়ে ইতালি ঐ টুর্নামেন্টে খুবই শক্তিশালী ডিফেন্স গড়ে তুলেছিল। ২০০২ বিশ্বকাপের আগে আগে মালদিনি ঘোষণা দেন যে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ঐ বিশ্বকাপ খেলে তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে নিবেন। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে ইতালি স্বাগতিক কোরিয়ার কাছে ২-১ গোলে হেরে বিদায় নেয়।২০০১ সালে মালদিনির এক সময়কার ক্লাব সতীর্থ কার্লো আনচেলত্তিকে এসি মিলানের নতুন কোচ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।২০০২-০৩ মৌসুমে মালদিনির নেতৃত্বে এসি মিলান উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ইতালিয়ান কাপ জিতে। ঐ মৌসুমে ক্লাবে নতুন যোগ দেওয়া আলেসান্দ্রো নেস্তার সাথে মালদিনি ডিফেন্সে দারুণ জুটি গড়ে তুলেছিলেন। ঐ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ইউভেন্তুসকে এসি মিলান টাইব্রেকারে হারায়,মালদিনি ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন।অধিনায়ক হিসেবে এটাই ছিল মালদিনির প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা, ঠিক ৪০ বছর আগে তার বাবা সিজার মালদিনির নেতৃত্বেও এসি মিলান ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল। এসি মিলানের হয়ে দারুণ পারফরম্যান্সের জন্য তিনি ২০০৩ সালে ব্যালন ডি’অর পুরস্কারে তৃতীয় সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন।২০০৩-০৪ মৌসুমে মালদিনি রোজ্জুনেরিদের হয়ে সপ্তমবারের মতো সেরি-আ জিতেন।

২০০৮-০৯ মৌসুম শেষ করে তিনি সব ধরণের ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে নেন। দুই যুগ ধরে এসি মিলানের রক্ষণ আগলে রাখা মালদিনি তার ক্লাবের হয়ে সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে রেকর্ড ৯০২ ম্যাচ খেলেছেন। ২৪ বছরের অবিশ্বাস্য এই ক্যারিয়ারে রোজ্জুনেরিদের হয়ে তার উল্লেখ্যযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে ৭টি সেরি-আ, ১টি ইতালিয়ান কাপ, ৫টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ৩টি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। সান সিরোর এই ক্লাবের হয়ে তিনি ৫ বার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার পাশাপাশি আরও তিনবার রানার-আপ হয়েছেন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ইউরোপিয়ান কাপ বা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলার রেকর্ড যৌথভাবে মালদিনি ও রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি ফ্রান্সিসকো জেন্টোর দখলে,  দুজনই আটটি করে ফাইনাল খেলেছেন। এসি মিলানের বর্তমান ও ভবিষ্যতের খেলোয়াড়দের সামনে তিনি রেখে গেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এসি মিলানের ব্রাজিলিয়ান তারকা কাকা যেমন বলেছিলেন,

“আমি পাওলো মালদিনির মতো ইতিহাস লিখতে চাই, তিনি আমার রোল মডেল।”

২০০৫ সালেই এসি মিলান ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল যে ক্লাবের প্রতীকে পরিণত হওয়া মালদিনির অবসরের পর তার ব্যবহৃত তিন নম্বর জার্সিটাও অবসরে চলে যাবে, পরবর্তীতে ক্লাবের আর কাউকে তার ৩ নম্বর জার্সি দেওয়া হবে না। তবে মালদিনির দুই ছেলের কেউ যদি ভবিষ্যতে এসি মিলানের হয়ে খেলেন এবং তাদের কেউ ঐ তিন নম্বর জার্সিটা চাইলে শুধুমাত্র তাদেরকেই মালদিনির এই বিখ্যাত জার্সি নাম্বারটা দেওয়া হবে। মালদিনির দুই ছেলে ক্রিস্টিয়ান ও ড্যানিয়েল বর্তমানে এসি মিলানের একাডেমি দলের হয়ে খেলছেন। যদিও মালদিনি ২০০২ সালেই জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন, তারপরও ২০০৯ সালে ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশন তার সম্মানে একটা বিদায়ী ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা নেয় যাতে মালদিনিকে শেষবারের মতো জাতীয় দলের হয়ে মাঠে দেখা যায়। ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশন ঠিক করে যে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ইতালির ঐ প্রীতি ম্যাচটাই হবে আজ্জুরিদের জার্সি গায়ে মালদিনির বিদায়ী ম্যাচ।কিন্তু মালদিনি বিনয়ের সাথে সেই প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ্জুরিদের চারটি বিশ্বকাপ ও তিনটি ইউরোতে প্রতিনিধিত্ব করা মালদিনি জাতীয় দলের হয়ে মোট ১২৬ ম্যাচ খেলেছেন। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে তার অবসর নেওয়ার সময় এটাই ছিল ইতালির হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড। এছাড়াও ইতালিকে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়ার রেকর্ডটাও তার দখলে, মোট ৭৪টি ম্যাচে তিনি আজ্জুরিদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মালদিনির বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের একমাত্র অপ্রাপ্তি হচ্ছে জাতীয় দলের হয়ে তার কোনো শিরোপা জেতা হয়নি। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ও ২০০০ সালের ইউরোতে ইতালি শিরোপা জয়ের খুব কাছ কাছি চলে গিয়েছিল, কিন্তু দুইবারই একটুর জন্য শিরোপা জেতা হয়নি।

পুরো ক্যারিয়াড়জুড়েই মালদিনি অসাধারণ কৌশল, কড়া মার্কিং, স্লাইডিং ট্যাকলের জন্য খুব বিখ্যাত ছিলেন। ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময়ই লেফট ব্যাক হিসেবে খেলা মালদিনি দৌড়ে খুব দ্রুত উপরে উঠার ব্যাপারেও ছিলেন ভীষণ পারদর্শী। তবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের মার্কিং এর ব্যাপারে তার পজিশনিং এতোটাই ভালো ছিল যে তাকে খুব কমই ট্যাকল করতে হতো। ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে সব মিলিয়ে ১০০০ এরও বেশি ম্যাচ খেলা মালদিনি তার পুরো ক্যারিয়ারে লাল কার্ড দেখেছিলেন মাত্র একবার! তার পজিশনিং এতোটাই নিখুঁত ছিল যে পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিনি গড়ে প্রতি ২ ম্যাচে একটি করে ট্যাকল করতেন। এসি মিলানের বিপক্ষে ১৯৯৫ সালের উয়েফা সুপার কাপে খেলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আর্সেনালের সাবেক ফুটবলার পল মারসন বলেছিলেন,

“ঐ ম্যাচে মালদিনি আমাকে মার্ক করছিলো এবং এই জন্য পুরো ম্যাচে আমি একবারও বলে লাথি মারতে পারিনি। সে এক কথায় অবিশ্বাস্য খেলেছিল।পুরো ক্যারিয়ারে যত জন খেলোয়াড়ের মুখোমুখি হয়েছি তাদের মধ্যে মালদিনিই সেরা।”

ডিফেন্সে খেলার কারণে ব্যালন ডি’অর বা ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও তার কখনো জেতা হয়নি। তিনবারের ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় রোনালদো মালদিনিকে সেরা ডিফেন্ডারের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি এটাও বলেছেন যে মালদিনি ব্যালন ডি’অর বা ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার না জেতা সেরা খেলোয়াড়। রোনালদোর মতে, মালদিনির মতো একজন কিংবদন্তি ফুটবলারের একাধিকবার ব্যালন ডি’অর বা ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতা উচিত ছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সেরি-আ তে ইউভেন্তুসের হয়ে খেলা ফরাসি ফুটবল কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান এসি মিলানের বিপক্ষে ম্যাচগুলোতে মাঠের অপর প্রান্তে খেলতেন শুধুমাত্র মালদিনির কড়া মার্কিং এড়িয়ে চলার জন্য। দীর্ঘদিন ধরে এসি মিলান ও ইতালি জাতীয় দলের হয়ে অসাধারণ খেলে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া মালদিনি শুধু নিজ দলের অনুসারীদেরই ভালোবাসার পাত্র ছিলেন না, বরং প্রতিপক্ষদেরও মন জয় করে নিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে যেমন সান সিরোতে ক্যারিয়ারের শেষ মিলান ডার্বি খেলার সময় ইন্টার মিলানের সমর্থকরা প্রতিদ্বন্দ্বীতা ভুলে মালদিনির জন্য গ্যালারিতে ব্যানার নিয়ে এসেছিল।ইতালিয়ান ফুটবলে তার অবদান সম্পর্কে আজ্জুরিদের কিংবদন্তি ফুটবলার লুইগি রিভা যেমন বলেছিলেন,

“পাওলো মালদিনি হচ্ছে আমাদের ফুটবলের প্রতীক। আশা করি ভবিষ্যতেও সে যেন ফুটবলের সাথে নানাভাবে জড়িত থাকে এবং এ জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় সব ধরণের ব্যবস্থাই নেওয়া উচিত।”

পাওলো মালদিনিকে হয়তো আর কখনো এসি মিলান বা ইতালির জার্সি গায়ে খেলতে দেখা যাবে না, কিন্তু ফুটবল মাঠে তার অসাধারণ নৈপুণ্য, নেতৃত্বগুণ ও দলের প্রতি বিশ্বস্ততার জন্য ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 

© আহমদ আতিকুজ্জামান।