• ফুটবল

বাঁকা পা, ড্রিবলিং এবং ছোট পাখি খ্যাত একজন ফুটবল জাদুকরের গল্প!

পোস্টটি ৬০০২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

অক্টোবর ২৮, ১৯৩৩, ব্রাজিলের পাও গ্রান্দে নামক এক দরিদ্র এলাকায় জন্ম তার ছেলেটিরও ছিল জন্মাগত বহু শারীরিক সমস্যা। মেরুদণ্ড সোজা নয়। ডান পা-টা ভেতরের দিকে কিঞ্চিত বাঁকানো।সমস্যা বাম পায়েও।সেটা ডান পায়ের চেয়ে ছয় সেমি ছোট এবং বাইরের দিকে বাঁকানো।অথচ এমন দুটি পায়ে কত না জোর! ইতিহাসের অন্যতম সেরা ড্রিবলার বলা হয় তাঁকে। আর ব্রাজিলিয়ানদের কাছে পেলের ঠিক পরেই ম্যানুয়েল ফ্রান্সিসকো দোস স্যান্তোস।

অপরিচিত লাগছে? ফুটবল খেলা শুরুর পর থেকেই মা-বাবার রাখা ওই নামটি হারিয়ে তিনি হয়ে যান ‘গারিঞ্চা’। ছোট্ট ডানা ওয়ালা পাখি।যে পাখি খুব সুন্দর করে গান গাইতে পারে! গারিঞ্চাকে ঠিক সেই অর্থে গায়ক বলা যাবে না।তাঁর হয়ে গানের সুর ধরত বাঁকানো অমূল্য দুটি পা।তার এই নামকরন সম্পর্কে তার বোন জানান”

"একদিন সে বাড়িতে একটা ছোট্ট পাখি নিয়ে এল। আমি তা দেখেই ওকে বললাম, দেখ, এইটা একেবারে তোমারই মত! এটা একটা গ্যারিঞ্চা।” তখন থেকেই এই নামটি তার চিরতরে থেকে গেল।অবশ্য তাকে  “এনজেল উইথ বেন্ট লেগস” এবং “ জয় অফ পিপল“ও বলা হয়। তার সম্পর্কে বিখ্যাত উরুগুইয়ান লেখক গ্যালিয়ানো বলেছিলেন,

"যখন সে মাঠে প্রবেশ করে, তখন তা একটি সার্কাসের রিং এ পরিনত হয়, বলটি হয়ে যায় পশু, এবং ম্যাচটি হয়ে যায় একটি শো! গ্যারিঞ্চা বল নামক তার পশুটিকে বশ করে, এবং দুজনে মিলে এমন সব খেলা দেখায় যে দর্শক বিমোহিত হয়ে যায়। সে এর উপর লাফায়,ছুড়ে দেয়, পেছনে ধাওয়া করে আর তা দেখে তার প্রতিপক্ষরা একে অপরের পিছে দৌড়ায়!"

পেশাদার ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন ২০ বছর বয়সে।১৯৫৩ সালে যখন ব্রাজিলের বোটাফোগোতে যোগ দিলেন ততদিনে বিয়ে করে বাবাও হয়ে গেছেন গারিঞ্চা।ক্লাব কর্তারা তো সেটা বিশ্বাসই করতে চান না।এমন একটা ছেলে পেশাদার ফুটবল খেলবে কী করে, সেটাও ভেবে পান না তাঁরা। কিন্তু অনুশীলনের প্রথম সেশনেই এমন ড্রিবলিং দেখালেন, যা দেখার পর কর্তাদের মন ভরল, তিন মাসের মধ্যে গারিঞ্চা একেবারে মূল দলে এবং অভিষেকেই হ্যাটট্রিক!

এক বছর পর বিশ্বকাপ। গারিঞ্চার নাম মোটামুটি ছড়িয়ে গেছে গোটা ব্রাজিলে।কিন্তু একই পজিশনে জুলিনহোর মতো উইঙ্গার থাকায় বিশ্বকাপের অপেক্ষা আরো চার বছর দীর্ঘায়িত হলো।তবে ঠিক আগের মৌসুমে লিগের ২৬ ম্যাচে ২২ গোল করা গারিঞ্চা সুযোগ পেলেন ৫৮ বিশ্বকাপে।কিন্তু প্রথম দুই ম্যাচ খেলা হলো না।তাঁর বিরুদ্ধে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার গুরুতর অভিযোগ! বিশ্বকাপের এক মাস আগে বোটাফোগোর হয়ে ইতালিতে খেলতে গিয়েছিলেন ফিওরেন্তিনার বিপক্ষে। সেই ম্যাচে প্রতিপক্ষের চার ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে যে গোলটি করেছিলেন, সেটি তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা গোল।পরে আরেকটি গোলও করেছিলেন।সমস্যা বেধেছিল সেই গোল নিয়েই।ওপেন নেট, টোকা দিলেই গোল। কিন্তু গারিঞ্চা গোল না করে দাঁড়িয়ে থাকলেন প্রতিপক্ষের কোনো ডিফেন্ডারের অপেক্ষায়!

ডিফেন্ডার এলেন, গ্যারিঞ্চা তাকে কাটিয়ে প্রায় মাটিতে ফেলে দিলেন এবং গোল করলেন।বিশ্বকাপে ব্রাজিল কোচ এর শাস্তি হিসেবেই দুই ম্যাচ বসিয়ে রাখেন গারিঞ্চাকে।তৃতীয় ম্যাচে পেলের সঙ্গে অভিষেক রাশিয়ার বিপক্ষে।জানা যায় ফেভারিট রাশিয়া শুরু থেকেই আক্রমনের পরিকল্পনা করে।কিন্তু ম্যাচের কিক অফ হওয়া মাত্র বল নিয়ে রাশিয়ার গোল মুখে ছুটতে থাকেন গ্যারিঞ্চা।সবাইকে কাটিয়ে নিলেন শট কিন্তু তা বাড়ে লাগল।পরপরই পেলের শট এবং আবার তা বাড়ে লাগে।ফলাফল,ভয়ে ঘামতে থাকেন সর্বকালের সেরা গোলকিপার লেভ ইয়াসিন।পর মুহুর্তেই ভাভার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল।

মাত্র ৩ মিনিটে করা গোলটিকে “ ইতিহাসের সেরা তিন মিনিট বলা হয়। “ম্যাচটা ২-০ ব্যবধানে জিতল ব্রাজিল।অসাধারণ ফুটবল উপহার দিলেন পেলে-গারিঞ্চা দুজনই।কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসকে মাত্র ১-০ গোলে হারালেও প্রতিপক্ষের ফুল ব্যাক মেল হপকিনস গারিঞ্চার খেলা দেখে তাঁকে ‘ বাঁকা পায়ের জাদুকর‘ উপাধি দিয়ে দিলেন।সেদিন হপকিনসকে কাটিয়ে যখন গোলবারের দিকে গ্যারিঞ্চা এগুচ্ছিলেন তখন হপকিনস তার মুভমেন্টকে বুঝতে না পেরে মাটিতে পরে গিয়েছিলেন।সুইডেনের বিপক্ষে ফাইনালে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ২-১ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়ন হলো ব্রাজিল।দুটি গোল ভাভা করলেও সেগুলোর উৎস ছিলেন গারিঞ্চাই।সেবার সেরা ফুটবলারের পুরস্কার উঠেছিল গারিঞ্চার হাতেই। ৬২-র বিশ্বকাপে ইনজুরির কারণে প্রথম দুই ম্যাচের পর থেকে পেলেহীন ব্রাজিল।এ অবস্থায় বাড়তি দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করলেন গারিঞ্চা।বলতে গেলে একাই চ্যাম্পিয়ন করলেন ব্রাজিলকে।নিজে গোল করলেন, অন্যদের দিয়েও করালেন।ফাইনালে তো সুইডেনকে পেলেকে সঙ্গী করে ৫-২ গোলে উড়িয়ে দিলেন।ম্যাচ শেষে যখন সবাই উল্লাস করছিল তখন বল পায়ে হতচকিত্ গ্যারিঞ্চা সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন” ম্যাচ কি শেষ? ” সেই সুবাদে আবার সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি গোল্ডেন বল পেলেন গারিঞ্চা।ইংলিশ মিডিয়া তাকে নিয়ে মন্তব্য করে-

"স্যার স্টানলি ম্যাথুস, টম ফিনলে এবং একজন জাদুকর তিনজন মিলে সৃষ্টি গ্যারিঞ্চা"

বিশ্বকাপের পরের আসরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় ব্রাজিল। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতে আসর শুরু করলেও হাঙ্গেরির কাছে ৩-১ গোলের হারে সব শেষ।ওই ম্যাচটাই ব্রাজিলের হয়ে শেষ ম্যাচ গারিঞ্চার এবং প্রথম হারও! এর আগে তিনি যে ১২ বছর খেলেছেন সেই সময়টায় কোনো ম্যাচই হারেনি ব্রাজিল। তাকে নিজ দলে ভেরাতে চেয়েছিল অনেক দলই এর মধ্যে, ১৯৫৪ তে জুভেন্টাস,১৯৫৯ তে রিয়াল মাদ্রিদ এবং ১৯৬৩ তে ইন্টার মিলান এবং এসি মিলান উল্লেখ যোগ্য।

এমন বর্ণময় একজন ফুটবলারের জীবনের শেষ অধ্যায়টা মোটেও সুশ্রী ছিল না।তাঁর বাবা মদ খেতে খেতে লিভারটাই পচিয়ে ফেলেছিলেন। ক্যান্সারে মারা যান তিনি। একই পরিণতি গারিঞ্চারও। ৪৯ বছর বয়সে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই ব্রাজিলিয়ান। চরম আসক্তি ছিল নারীর প্রতি, যা বলার অযোগ্য।জনা তিনেক নারী তাঁর স্ত্রীর মর্যাদা পেলেও এমন অনেকেই ছিলেন যাদের সেই স্বীকৃতি দেননি গারিঞ্চা।তবে সন্তানদের ঠিকই স্বীকৃতি দিয়েছেন। কমপক্ষে ১৪ সন্তানের জনক ১৯৮৩ সালে যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তখন তাঁর এক বেলা খাবার জোটে তো অন্য বেলা উপোস!

তাকে নিয়ে পরবর্তীতে বেশকটি সিনেমাও নির্মিত হয়েছে।পেলের মতে, গ্যারিঞ্চা না থাকলে আমি কখনও তিনটি বিশ্বকাপ জিততাম না! ধন্যবাদ গ্যারিঞ্চা, তোমাকে ছাড়া ব্রাজিল ফুটবল কিছুই না। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ ছোট পাখি। 

© আহমদ আতিকুজ্জামান।