• ফুটবল

ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সঃ শেষটা যার শুধুই হতাশা

পোস্টটি ১৬৬৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

সেটি ১১ জন মানুষের একটি ছোট্ট দল। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ সাল। সেই ৬ বছরে খেলা ৫০ টি ম্যাচে ৪২ জয়, ৭ টি ড্র। হার মাত্র ১ টি, যে ১ টা হারই পুরো গল্পটা আগাগোড়াই পালটে দিয়েছে।

বেশ কয়েক বছর আগে, আমি একদিন বিভিন্ন জনপ্রিয় ফুটবল দলের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। অদ্ভুতভাবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, সেটি হলো, অধিকাংশ দলের ক্ষেত্রেই একটা বিষয় দেখছি, তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হার একই দলের বিপক্ষে। কিন্তু আমি ততদিনে ওই দলটার নাম কখনো শুনিনি পর্যন্ত। আমি বারবার অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম, এদেরও কি ফুটবল টিম আছে? যে দলের নাম কখনো শুনিনি, তারা এইসব বড় বড় দল কে এইভাবে নাকানি চুবানি খাইয়েছে?

সবাই এতক্ষণে হয়তো বুঝে গেছেন আমি কাদের কথা বলছি। দলটার নাম হাঙ্গেরি। যাদের সেই জেনারেশন টা সবার কাছে পরিচিত ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স নামে।

আমরা পরপর তিনটি বৈশ্বিক শিরোপাজয়ী ইনিয়েস্তা পুয়োল ক্যাসিয়াসদের স্পেন কে দেখেছি, রোনালদো রিভালদো রোনালদিনহোর ব্রাজিল, সত্তরের দশকের পেলে গারিঞ্চার ব্রাজিল, অথবা জিদান দেশম বার্থেজ থুরামের ফ্রান্স; কিন্তু ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের কথা বললে অন্য সব গুলো নাম কেমন যেন ম্লান হয়ে যায়।

দলটির মূলে ছিলেন ছয় জন। সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দানের জন্য ছিলেন ফেরেঙ্ক পুসকাস, পাশে সান্দোর ককসিস। আরো ছিলেন জোলতান জিবর, নান্দোর হিদেকুটি, জোসেফ বসজিক আর গাইয়ুলা গ্রোসিকস। এই ৬ জন এর সাথে বাকি আর ৫ জন কে নিয়েই তৈরি হয়েছিলো বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ফুটবল দল, যারা ফুটবল বিশ্বকে আধা যুগ ধরে শাসন করেছেন নিজেদের ইচ্ছেমতো। আর তাদের পিছনে ছিলেন গুস্তাভ সেবেস।

তবে এই বিধ্বংসী ইতিহাসের প্রকৃত শুরুটা হয়েছিলো ১৯৫২ সালের অলিম্পিকে। বিশ্বকাপের আগের দুই বছরের পারফর্মেন্সে এটি সবার কাছে অনুমেয়ই ছিলো যে হাঙ্গেরি চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। গ্রুপ পর্বে প্রতিপক্ষদের উড়িয়ে দিয়ে হেসে খেলেই সেমিতে আসে পুসকাসরা। সেমি তে মুখোমুখি হয় সে সময়ের অন্যতম পরাশক্তি সুইডেনের, যারা আগের অলিম্পিকেই স্বর্ণ জিতেছিলো। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে সে ম্যাচ টা কঠিন হবে বলেই মনে করা হচ্ছিলো। কিন্তু সুইডেন কে ৬-০ গোলে হারিয়ে সুন্দর করে বাড়ির পথ দেখিয়ে দিলো হাঙ্গেরি। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিলো যুগোস্লাভিয়া, তাদের ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে স্বর্ণ জিতল তারা।

সেই সময়ে ইউরোপে পাঁচবছর ব্যাপী আয়োজন করা হতো আঞ্চলিক টুর্নামেন্ট সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কাপের। যথারীতি সে টুর্নামেন্টে তৎকালীন ইউরোপিয়ান জায়ান্ট অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়াদের হারিয়ে উঠে গেল ফাইনালে। ১৯৫৩ সালের সে ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিলো ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি। ১৯৩৮ বিশ্বকাপ টা আবার ইতালি জিতেছিলো হাঙ্গেরি কে হারিয়েই। তাই একধরনের প্রতিশোধের প্রেরণাও কাজ করছিলো হাঙ্গেরিয়ানদের মনে। আর এ হাঙ্গেরি তো সে হাঙ্গেরি না। ফাইনালে পুসকাসের জোড়া গোলের সাথে হিদেকুটির একটা। ইতালি কে ৩-০ গোলে স্কোয়াশ করে এ চ্যাম্পিয়নশিপ টাও তারা নিজেদের করে নিলো।

১৯৫৩ সালের ২৫ নভেম্বর। ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, লন্ডন। সেদিন এক লক্ষাধিক লোক উপস্থিত ছিলো ইংল্যান্ড বনাম হাঙ্গেরি ম্যাচ দেখার জন্য। ইংল্যান্ড ফুটবল দল এর আগে কখনো গ্রেট ব্রিটেনের বাইরের কোনো দলের কাছে হারেনি। কিন্তু হাঙ্গেরি তো হাঙ্গেরিই। হাঙ্গেরির তুলনা শুধু হাঙ্গেরির সাথেই চলে। অতঃপর প্রথম মিনিটেই গোল। ২৭ মিনিটে স্কোরলাইন দাঁড়ালো ইংল্যান্ড ১-৪ হাঙ্গেরি। শেষ পর্যন্ত ৩-৬ গোলে হারলো অপরাজেয় ইংল্যান্ড। হিদেকুটির হ্যাট্রিক, পুসকাসের জোড়া। সাথে বসজিক করেছিলেন এক গোল। ম্যাচটি অনেকের চোখে বিংশ শতাব্দীর সেরা ম্যাচ। এই ম্যাচের আগে পর্যন্ত কখনো ইংল্যান্ডের কোনো ক্লাবে বিদেশী কোচ নিয়োগ দেওয়া হতোনা। এই ম্যাচের পর থেকেই ইংলিশদের খেলা শেখানোর জন্য বিদেশী কোচ নিয়োগ দেওয়া শুরু হলো।

কিছুদিন পর প্রতিশোধের নেশায় ইংলিশ রা আবারও মুখোমুখি হলো হাঙ্গেরির। কিন্তু হায়। এইবার পরাজয় ৭-১ গোলে, যেটি কিনা ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হার।

এরপর আসলো বিশ্বকাপ ১৯৫৪। হাঙ্গেরির গ্রুপের অন্য দল গুলো ছিলো তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিম জার্মানি। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়া হারলো ৯ গোলে। দ্বিতীয় ম্যাচ ছিলো পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে। সে ম্যাচে ৮-৩ গোলে স্কোয়াশ হলো জার্মানরা।

গ্রুপ পর্ব শেষে কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ হয়ে এল লাতিন পাওয়ার হাউজ ব্রাজিল। অ্যাটাকিং ফুটবলের দুই দলের লড়াই দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলো সারাবিশ্ব। বার্নে হওয়া সে ম্যাচে প্রথম ৭ মিনিটেই হাঙ্গেরি এগিয়ে গেল ২ গোলে। কিন্তু এরপর ঘটলো ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম কুৎসিত ঘটনা। একের পর এক ফাউল করতে লাগলেন দুই দলের খেলোয়াড়েরা। চড়, ঘুষি, লাথি কিছুই বাকি থাকলোনা। কোনোরকমে ম্যাচ শেষ হলো, হাঙ্গেরি জিতলো ৪-২ গোলে। ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমেও চললো মারামারি। এই কুৎসিত ম্যাচ টি ফুটবল ইতিহাসে "ব্যাটল অব বার্ন" নামে পরিচিত।

এরপর সেমিতে হাঙ্গেরির মুখোমুখি হলো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে হাঙ্গেরি এগিয়ে গেল ২ গোলে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়াল উরুগুয়ে। ৭৫ ও ৮৬ মিনিটের গোলে সমতায় শেষ হলো নির্ধারিত সময়। অতিরিক্ত সময়ে ১১০ ও ১২৩ মিনিটে ককসিসের দুই গোলে হাঙ্গেরি জিতলো ৪-২ গোলে।

এরপর এল ফাইনাল। ফুটবলের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ম্যাচ। প্রতিপক্ষ ছিলো গ্রুপ পর্বে হাঙ্গেরির কাছেই ৮-৩ গোলে বিধ্বস্ত হওয়া পশ্চিম জার্মানি। ম্যাচের শুরুতেই ৬ ও ৮ মিনিটে পুসকাস ও জিবরের গোলে ২-০ তে এগিয়ে গেলো হাঙ্গেরি। কিন্তু এরপরই পশ্চিম জার্মানি এমন কিছু ঘটালো, যা কিনা কারো কল্পনাতেও ছিলোনা। ২ মিনিট পরেই এক গোল শোধ করলো তারা। অতঃপর ১৮ মিনিটে আরেক গোল করে দল কে ফেরালো সমতায়। দ্বিতীয়ার্ধে আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়ে যেতে লাগলো হাঙ্গেরি। কিন্তু জার্মান বাধা ডিঙাতে পারছিলোনা। গোলকিপার টিউরেক অবিশ্বাস্য ৭ টি সেভ করলেন। এরপর ৮৪ মিনিটে হঠাৎ কাউন্টার এটাক থেকে বল জালে জড়িয়ে দিলেন হেলমুট রান। জার্মানি এগিয়ে গেল ৩-২ গোলে। অবিশ্বাস্য। ম্যাচ তখন প্রায় শেষ। ৮৮ মিনিটে পুসকাস করলেন আরও এক গোল। কিন্তু অফসাইডে সেটি বাতিল করে দেন রেফারি। ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজালেন রেফারি। হাঙ্গেরি হেরে গেল। আর হারলো এমন এক দলের কাছে, যারা কিনা পেশাদার ফুটবলই খেলেনা। শেষ হলো হাঙ্গেরির অপরাজিত যাত্রা। এ ম্যাচ টি পরিচিতি পেল "মিরাকল অব বার্ন" নামে।

এরপরও প্রীতি ম্যাচ গুলোতে হাঙ্গেরির অপরাজিত যাত্রা বজায় থাকলো। স্কটল্যান্ডের মাটিতে তাদের হারালো ৪-২ গোলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আগে কখনো নিজেদের মাঠে হারেনি৷ অতঃপর সেখানে গিয়ে তাদের হারালো ১-০ গোলে। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৯ ম্যাচ খেলে ১৬ টি তেই জয় পায়, ড্র হয় বাকি তিনটি ম্যাচ। এরপরও বরখাস্ত হন সেবেস। নতুন ম্যানেজার হন মার্টন বুকোভি।

কিছুদিন পরই হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লব শুরু হয়। বন্ধ হয়ে যায় ফুটবল। খেলোয়াড়েরা সবাই নিজ নিজ পরিবার নিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যান। পুসকাস, ককসিস, জিবর চলে আসেন স্পেনে। হিদেকুটি, বসজিক খেলোয়াড়ি ছেড়ে শুরু করেন কোচিং। তারা আর কখনো একত্র হননি। হাঙ্গেরিয়ান ফুটবলে নামে ধস। আজ সেই হাঙ্গেরি একদমই হারিয়ে গেছে। এখন কোনোমতে ইউরোতে খেলার সুযোগ পায়, তাও কদাচিৎ। বিশ্বকাপেও সুযোগ মেলেনা নিয়মিত। আগের সেইসব কথা ভাবলে কেমন যেন কাল্পনিক মনে হয়।

এবার আসি কিছু রেকর্ডে। হাঙ্গেরি ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত খেলা প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ৪২ জয়, ৭ টি ড্র, হার মাত্র ১ টি। জয়ের হার ৯১%। ১৯৫০ সালের জুন থেকে ১৯৫৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ৭৩ টি ম্যাচ খেলে প্রত্যেক ম্যাচে তারা কমপক্ষে একটি করে গোল করে। টানা ৪ বছর ১ মাস অপরাজিত থাকে হাঙ্গেরি, যে রেকর্ড এখনো অক্ষুণ্ন। এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ২৭ টি গোল হাঙ্গেরির। এক বিশ্বকাপে প্রতি ম্যাচে গড়ে সর্বোচ্চ (৫.৪) গোল হাঙ্গেরির। হাঙ্গেরির নামের পাশে আরও কত রেকর্ড লেখা আছে তার ইয়ত্তা নেই।

আর কখনো বিশ্ব ফুটবলে ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের মতো কোনো দল আসবে কিনা সেটা দেখার বিষয়। আজ সেই ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স নেই। তবে বেঁচে আছে তাদের রেখে যাওয়া স্মৃতি। বেঁচে থাকবে চিরকাল। আমাদের ফুটবল প্রেমীদের মনে সেসব অবদান অক্ষয় হয়ে থাকবে।

5a997e0c1d79cd45a0000009