ঐ দেখা যায় শেষ চার...
পোস্টটি ২০২২ বার পঠিত হয়েছেবাংলাদেশকে শেষ চার-এ কল্পনা করতে পারেন?
বিদ্রুপের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ‘আরে ব্যাটা, বাংলাদেশ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারে এবার, আর তুই আছিস কি-না কোথাকার চার-টার নিয়ে!’ বলছেন নাকি?
না, সত্যি কথা বলে ফেলতে পারেন। বেক্কলের মতো প্রশ্ন করলে মুফতে আক্কেল-জ্ঞান জুটতেই পারে। মনে করবো না কিছু। তবে আপনার যেমন আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাস, তেমনটা আত্মবিশ্বাস অনেকের নাও থাকতে পারে। শেষ চার বাদ দিন, অনেকের আশংকা তো আফগানিস্তানের সঙ্গে মর্যাদার লড়াইয়ে আদৌ ইজ্জত বাঁচিয়ে দেশে ফেরা সম্ভব হবে কি না তাই নিয়ে!
আমার মতো মানুষের কথা অবশ্য আলাদা। পুঁচকে বাংলাদেশ কীভাবে কীভাবে যেনো প্রথম ম্যাচেই ভারতকে হারিয়ে দিল, আর তা-ই নিয়ে ‘৯৬-এর শ্রীলংকা হওয়ার স্বপ্ন খেলে আমাদের চোখে। রাসেল হবেন ভাস, মুরালী হবেন রফিক, তামিম হবেন জয়সুরিয়া আর হাবিবুল বাশার হবেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা।
হাস্যকর বলছেন?
এক কিশোরের সুখ-কল্পনায় হাস্যকর মোটেও ছিল না তা। বরং এক সত্য সুখের নিশ্চিত পরিকল্পনা।
পরেরবার তো আরো সুনিশ্চিত সম্ভাবনা। শ্রীলংকাও ঠিক ঘরের মাঠে হারিয়ে ছিল নিউজিল্যান্ডকে, বিশ্বকাপের আগে আগে। বাংলাওয়াশের সঙ্গে মিলে গেছে একদম। ঘরের মাঠে পরের পর্বে যাওয়া ঠেকায় কে? আর পরের ধাপে গেলে?
সাকিব আল হাসান মাত্রই কুড়ি পেরিয়ে ফুটছেন কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে। সেই তিনি দলের নেতা। দুষ্টুমি মাখা হাসি আর দৃপ্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন- কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারলে যেকোনো কিছুই হতে পারে। তিনটা মাত্র ম্যাচ। যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।
দূর্ভাগ্য যে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্তই যাওয়া হয়নি সেবার।
পরের বার অবশ্য ঘুচে গিয়েছিল সে দুঃখ। আর যোগান দিয়েছিল আরো বড় দুঃখের, বড় যন্ত্রণার। কি হতো সেদিন? যদি রোহিতের আউট, রিয়াদের আউট বাংলাদেশের বিপক্ষে না গিয়ে পক্ষে চলে আসতো?
দুই বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল চলে গেলে একজন ইনবক্স করেছিলেন- ভাই, আপনিই বোধহয় প্রথম কনফিডেন্টলি বলেছিলেন বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলবে।
আমি তো কত কিছুই কনফিডেন্টলি বলি। সব কী হয়? ফাইনালও খেলবে ভেবেছিলাম সেবার, হয়নি। এবার তো আর আমার বা আমাদের মতো অতি আশাবাদীদের দরকার পড়ছে না, ট্রফিজয়ের কথা বলছেন অনেকেই। সেই তালিকায় ক্রিকেটার থেকে জ্ঞানী-গুণী বোদ্ধাও কম নেই। যে স্বপ্ন নিয়ে একযুগ আগে কৈশোরের অবাস্তব কল্পনায় মেতে উঠেছিলাম, সেটাই আজ অনেকের মনে ছাপ রাখছে। অনেকেই বিশ্বাস রাখছে। সবচেয়ে বড় কথা- এখন আর তা মোটেও অবাস্তব বা কল্পনা বলে মনে হচ্ছে না। বরং নিশ্চিত সম্ভবই মনে হচ্ছে।
একযুগ আগের চারজন স্বপ্ন সারথীও আছেন। আছেন তার ক’মাস পরে দলে যুক্ত হওয়া একজনও। পঞ্চ পান্ডব আহ্লাদীপনা হলেও, এটাই সত্য যে এরকম গ্রুপভিত্তিক অভিজ্ঞতা আর কোনো দলের নেই। বাংলাদেশ যে চ্যাম্পিয়ন হতে পারে বলে একটা সম্ভাবনা চাউর হয়েছে- সেটার মূলে এই পঞ্চ পান্ডব অন্যতম অনুষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকার বেরোয়- সিনিয়র ক্রিকেটারেরও বিশ্বাস বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে। বিশ্বাসটা কেমন এক ছোঁয়াচে তাই না? কীভাবে যেন প্রাণ থেকে প্রাণে সঞ্চারিত হয়ে যায়!
এই যে বিশ্বাস, এই যে আশার রেণু- এটা হুট করে সৃষ্টি হয় না। তেমন হলে ১২ বছর আগে ঐ এক ম্যাচ দেখেই আমার মতো অনেকেই অলীক কল্পনায় মেতে উঠতেন। নির্দিষ্ট পরিকল্পনার সর্বোচ্চ প্রয়োগ, সামর্থ্যের সর্বোচ্চ বিন্দু আর নিবেদনের সর্বোচ্চ মাত্রা একসুতোয় মিললে তবেই একটা বিশাল কোনো অর্জন সম্ভব বলে বিশ্বাস সঞ্চারিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ে। সাব্বিরের লেগ স্পিনের ব্যবহার, শ্বেতহস্তীর মতো সৌম্য সরকারকে প্রায় বছর দুয়েক বয়ে চলা, আপাত অকার্যকর মনে হওয়া মিথুন, লিটনের পিঠে আস্থার থাবা... এরকম ছোটো-বড়ো আর ভালো-মন্দ মেলানো মেশানো অনেক অনেক পরিকল্পনা আর সেসবের প্রয়োগে সার্থকতা ও সততা, জাগিয়ে তুলে সাফল্যের সমূহ সম্ভাবনা। আর তখনই বদ্ধমূলে বিশ্বাসটা হয় দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর।
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রসঙ্গে আসি। ন’টা ম্যাচ থেকে মোটামুটি পাঁচটা ম্যাচ জেতা গেলে পরের পর্বে যাওয়া হয়তো সম্ভব। পাঁচটা ম্যাচ জিতলেই নিশ্চিত নয়, তবে সম্ভব। এবার আসুন, ন’টা ম্যাচ-কে তিনটা পর্যায়ে বিভক্ত করি।
২রা জুন থেকে ১১ই জুন। চার ম্যাচ। প্রথম পর্যায়।
১৭ই জুন থেকে ২৪শে জুন। তিন ম্যাচ। দ্বিতীয় পর্যায়।
২রা জুলাই থেকে ৫ই জুলাই। দুই ম্যাচ। তৃতীয় পর্যায়।
প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ দেখুন- দক্ষিন আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও শ্রীলংকা। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলংকার পেছন পায়ে হাঁটা আর বাংলাদেশের সম্মুখ আগ্রযাত্রার সমন্বয়ে বলা যায়, শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচটা বাংলাদেশের জেতা উচিৎ। আর বাকী থাকে তিন দল। তিনটাই কঠিন। এবং ইংলিশ কন্ডিশন বিবেচনায় দারুণ কঠিন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলবে কার্ডিফে। এটা বিশাল মেন্টাল এ্যাডভান্টেজ। কার্ডিফ মানেই আশরাফুলের ‘আশার ফুল’ হওয়া, কার্ডিফ মানেই সাকিব-মাহমুদুল্লার যুগল সেঞ্চুরীতে যৌথ আয়োজনের আনন্দ-আখ্যান। আসরের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দলের বিপক্ষে এই মাঠেই লড়াই করা, মানসিকভাবে কিছুটা হলেও এগিয়ে রাখবে বাংলাদেশকে। আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ সামান্য এগিয়ে থাকবে এই বিবেচনায়- বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে এই ওভালেই। আসরের প্রথম ম্যাচ না হলে দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশই এগিয়ে থাকত। পেস এ্যাটাক দুর্দান্ত হলেও দক্ষিন আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপ আসলে খানিক নড়েবড়ে। যদিও ব্যাটসম্যানের লম্বা লিস্ট একাদশে, তারপরও অন্য দলগুলোর তুলনায় খুব ভয়ংকর ব্যাটিং লাইনআপ নেই ওদের।
প্রথম পর্যায় থেকে অন্তত দুটো ম্যাচে জয় প্রয়োজন। শ্রীলংকার বিপক্ষে একটা আসলেও, অন্যটা কোন দল থেকে আসবে তা বলা কঠিন। কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আমি বলবো- বারবার কার্ডিফে আরো একটি রুপকথা হাতছানি দিয়ে ডাকছে মনে হলেও, ইংল্যান্ড কিন্তু সময়ের সবচেয়ে নির্দয় ব্যাটসম্যানদের লালন করে! ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড, এই দুই ম্যাচেই অথবা যেকোনো একটিতে জেতার সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের। আবার বুমেরাং ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। শ্রীলংকার বিপক্ষে হেরে, অন্য তিন ম্যাচ থেকে দুটোতে জয় পেয়ে গেল বাংলাদেশ। অবশ্য অত ভেবে লাভ নেই। আমরা মনে করি, এই পর্যায় থেকে দুটো জয় তুলে নিতে পারলেই কেল্লাফতে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আসা যাক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান। এখানেও দুটো জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলা যায়। উইন্ডিজ ক্রিকেট বেশ শক্ত পোক্ত। ব্যাটিং লাইনআপে দু’পেয়ে দানবের ভিড়। তারপরও সাম্প্রতিক সাক্ষাতে মানসিকভাবে এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশই। আর আফগানিস্তানের সঙ্গে খানিক ভয়ের কারণ আছে সত্যি, তবে ‘প্যানিকড’ না করলে এই ম্যাচটাও বাংলাদেশের পক্ষে থাকার কথা। বাকী ম্যাচটা জিততেও পারে, নাও পারে। কারণ, অস্ট্রেলিয়া অস্ট্রেলিয়াই। ওদের সঙ্গে লড়াইটা খুব কঠিন হবে। এমনিতেই এই বিশ্বকাপের অন্যতম ভারসাম্যপূর্ণ দল ওদের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জেতা সম্ভব, কিন্তু হারটাও স্বাভাবিক এখনো।
তৃতীয় পর্যায়ে মাত্র দুটো ম্যাচ। পাকিস্তান ও ভারত। এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে জেতা উচিৎ। টুর্নামেন্ট কীভাবে এগোবে তা আমরা এখনো জানি না, তবে যদি অবস্থাটা এমন হয় যে- ডু অর ডাই সিচুয়েশন। জিততেই হবে পাকিস্তানের সঙ্গে। তাহলে আশা রাখা যায়, বাংলাদেশ জিতবে। তাছাড়া গত ক’বছরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা পার্থক্য ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে। সেটাও থাকবে বাংলাদেশের পক্ষে। পাকিস্তান চমৎকার একটা দল। ব্যাটিং লাইনআপ দারুণ। বোলিংটাও বেশ। কিন্তু তুলনামূলক অভিজ্ঞতা, ভারসাম্য আর মানসিকতা বিবেচনায়, এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশই। ভারতের বিপক্ষে একটা ‘মেন্টাল ব্লক’-এ আটকে আছে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরের ক্লোজ কন্টেস্টগুলো সে কথাই বলে। এই ব্লকটা কাটিয়ে উঠতে পারলে ভারত অবধ্য কোনো ব্যাপার থাকবে না। বিশ্বকাপেও এই ঘটনা ঘটে যাওয়া খুব সম্ভব। সেইক্ষেত্রে একটা উড়ু উড়ু মানসিকতা সঙ্গী করেই পরের পর্বে পা রাখবে বাংলাদেশ।
আর তারপর দুটো মাত্র ম্যাচ?
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
আর সেই সাথে আরো একটা ব্যাপার বলে রাখি- বাংলাদেশ যদি বিশ্বউঠোনের ‘রাজা’ বনেই যায়, তা কিন্তু মোটেই ‘অঘটন’ হবে না। এবং চোখ কপালে উঠার মতো অবাক হওয়ার কোনো কারণও থাকবে না। আমরা সবাই জানি- বিশ্বজয়ী হতে যা যা দরকার ঠিক তা-ই তা-ই আছে দলটার।
বিশ্বজয়ী ক্রিকেটার, সুযোগ্য নেতৃত্ব, দলবদ্ধ প্রচেষ্টা, পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতা, সংঘবদ্ধ নিবেদন, স্বপ্নকে তাড়া করার একাগ্রতা, তপস্বী কোনো ঋষির মতো সাফল্যকে মুঠোয় পুরার সাধনা... আছে সব।
শুধু শেষ চার কেনো, ট্রফিটাও যে দেখতে পাচ্ছি বেশ। স্বপ্নদৃষ্টির সীমানা আরেকটু বাড়ালেই চোখে পড়ছে- দারুণ ব্যক্তিত্বের একজন অসামান্য ব্যক্তিত্বে উঁচিয়ে ধরছেন সোনারঙা একটি ট্রফি, আর তার চারপাশ ঘিরে একদঙ্গল বঙ্গসন্তান উচ্ছ্বাস নিয়ে অপেক্ষায় ঐ ট্রফিতে একটি চুমু আঁকতে, একটু পরশ বুলাতে...।
- 0 মন্তব্য