পেলে ম্যারাডোনার দু:খঃ কিংবা কোপা আমেরিকা।
পোস্টটি ৭৭৭৫ বার পঠিত হয়েছেফুটবল যদি একটি পৃথিবী হয়, তবে এর একটি অক্ষ ম্যারাডোনা, আরেকটি পেলে। এই দুজনই স্বীয় ক্যারিশমায় রঙিন করেছেন এই খেলাটিকে। দর্শকদের ভাসিয়েছেন আনন্দ-বিনোদনের সাগরে। ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘মুকুট’ বিশ্বকাপ জিতেছেন দুজনই। পেলে জিতেছেন তিনবার, ম্যারাডোনা একবার। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বকাপের পর যে প্রতিযোগিতাগুলোকে ‘দর্শক-প্রিয়’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেই কোপা আমেরিকায় ব্যর্থ এঁরা দুজনই।
অসাধারণ ফুটবল- শৈলিতে সমগ্র পৃথিবীকে মন্ত্রমুগ্ধ করে, ফুটবলের সম্ভব-অসম্ভব বহু গৌরব নিজেদের করে নিয়েও একটি আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার শিরোপা হাত দিয়ে ছুঁতে না পারার এই ব্যাপারটি পোড়ায় তাঁদের অনেক ভক্ত-অনুরাগীদের। কোপা আমেরিকা তাই চিরদিনের জন্য বিষাদ-বিধূঁর এক বিষয়ই হয়ে আছে ফুটবলের এই দুই দিকপালের জন্য। ফুটবল ইতিহাসের এই দুই কিংবদন্তি ফুটবলার কিন্তু আসলেই দুই মেরুর। এই দুজনের ফুটবল-শৈলীর গল্প ছাপিয়ে এখন পৃথিবী মুখর তাঁদের ‘দ্বন্দ্বে’র বিষয়ে। সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে, দ্বন্দ্বটা এ নিয়েই। অনেক ফুটবল-বোদ্ধাই একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিন বিশ্বকাপ জেতা পেলেকে অভিহিত করেন সর্বকালের সেরা হিসেবে। কিন্তু একটি বিশ্বকাপ জিতে ম্যারাডোনা তা মেনে নিতে নারাজ। এমনকি ‘অন্যতম’ সেরাতেও আপত্তি এই ম্যারাডোনার। পেলে-বিরোধীরা বলেন, ম্যারাডোনা নিজেও নিজেকে ‘সর্বকালের সেরা’ হিসেবে অভিহিত করতে পিছপা হন না। ম্যারাডোনার এই ‘দাবি’ পেলে মেনে নিয়েছেন- এমন প্রমাণ কিন্তু নেই বললেই চলে। তবে এটা ঠিক, পেলে-ম্যারাডোনার মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু ফুটবল-রোমাঞ্চের উৎস হিসেবে কিন্তু দুজনেই দুজনকে বেঁধেছেন একই সুতোয়।
নিরপেক্ষ, ফুটবল রোমান্টিকদের মতে, এঁরা দুজনেই সেরা। অবশ্যই দুটি ভিন্ন সময়ের। সর্বকালের সেরার বিষয়টি না হয় অমীমাংসিতই রইল। কোপা অবশ্যই ‘দুঃখগাথা’ এই দুজনের জন্য। এই দুজনকে কোপার কথা জিজ্ঞেস করলে হয়তো অস্ফুট স্বরে আক্ষেপের নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে তাঁদের ভেতর থেকে। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে ১৪ বছর রাজত্ব করেছেন ফুটবল-সম্রাট পেলে। এই সময়ে তিনি কোপা আমেরিকা খেলেছেন মাত্র একটি। সাফল্য পাননি। সে দিক দিয়ে কোপা আমেরিকা প্রতিযোগিতার ‘দুঃখে’র সঙ্গে ম্যারাডোনার নামটিই উচ্চারিত হয় করুণ সুরে। ১৯৭৭-১৯৯৪, আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে এই ১৭ বছরে ম্যারাডোনা খেলেছেন তিনটি কোপা প্রতিযোগিতা—১৯৭৯,১৯৮৭ ও ১৯৮৯ সালে। খেলা হয়নি ১৯৮৩,১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালের কোপা। ১৯৮৩ সালে খেলোয়াড়ি কারণে বাদ পড়েছিলেন। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে খেলতে পারেননি কোকেন- কেলেঙ্কারিতে মাঠের বাইরে থেকে।
ম্যারাডোনার দুঃখটা আরও বাড়িয়ে দেয় এই ব্যাপার—একানব্বই, তিরানব্বইয়ে কোপার শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টিনা।
পেলে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে। পরের বছর তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে ব্রাজিল প্রথমবারের মতো জিতে নিয়েছিল বিশ্বকাপ। পরের বছর আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত কোপায় হট ফেবারিট থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিল শিরোপা জিততে পারেনি। সেবার ৮ গোল করে শীর্ষ গোলদাতার আসনেও বসেছিলেন তিনি। দলকে এনে দিতে পারেননি কাঙ্ক্ষিত শিরোপা। গ্রুপের শেষ ম্যাচে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জয়ের দরকার হলেও পেলের গোলে কোনোমতে ১-১ গোলের ড্র করে শিরোপা বঞ্চিত হয় ব্রাজিল। রানার্সআপ হয়েই ব্রাজিলকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ১৯৫৯ সালে ইকুয়েডরে আরেকটি কোপা প্রতিযোগিতা হলেও সেখানে খেলেননি পেলে। এই সময় হয়তো লাতিন আমেরিকার মহাদেশীয় এই প্রতিযোগিতাটি কোনো কারণে গুরুত্ব হারিয়েছিল ব্রাজিলীয়দের কাছে। নয়তো পরপর দুটি কোপায় কেন পেলে খেলবেন না!
১৯৫৯ সালের পর ১৯৬৩ সালেও কোপা থেকে পেলেকে দূরেই রেখেছিল ব্রাজিলীয় টিম ম্যানেজমেন্ট। ১৯৬৭ সালের কোপা থেকে ব্রাজিলই তো নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়া পেলের তাই আর কোপার শিরোপা ধরে দেখা হয়নি। ব্যাপারটি জীবন সায়াহ্নে এসে নিশ্চয়ই পোড়ায় ‘কালো মানিক’কে!
ম্যারাডোনা তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে কোপা- শিরোপার সবচেয়ে কাছে পৌঁছেছিলেন ১৯৮৭ সালে। ছিয়াশির বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনাকে তিনি তুলে দিয়েছিলেন প্রতিযোগিতাটির সেমিফাইনালে। গ্রুপ পর্বে দুটো গোলও পেয়েছিলেন। ছিলেন দারুণ ফর্মে। কিন্তু সেমিতে উরুগুয়ের কাছে হেরে কোপা-স্বপ্নের সমাধি হয় ম্যারোডানার। ৮৯ সালে তাঁর ফর্ম ছিল তথৈবচ। একেবারেই ভালো খেলতে পারেননি। দল সেমিতে উঠলেও সেবার কখনোই মনে হয়নি আর্জেন্টিনা শিরোপা জিততে পারে। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে আর্জেন্টিনার কোপা জয়ে ম্যারাডোনার অবদান রাখতে না পারা ছিল বেদনাময় এক অধ্যায়। মাদকে জড়িয়ে ম্যারাডোনা তখন বিতর্কের কেন্দ্রে। একের পর এক বিতর্কিত ঘটনায় হুমকির মুখে তখন তাঁর খেলোয়াড়ী সত্ত্বাই।
পেলে-ম্যারাডোনার এই কোপা-দুঃখকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় ? আসলে এসবের কোনো ব্যাখ্যা হয় না। বিষয়টিকে বিধাতার অদ্ভুত খেয়ালগুলোর একটি হিসেবেই না হয় ধরে নেওয়া যাক।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য