মাঝমাঠের এক খ্যাপাটে যুবরাজ
পোস্টটি ৬৯১৮ বার পঠিত হয়েছে২০১৫ সালে একবার তিনি মেসিকে নিয়ে একটি বিশেষ উক্তি দিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। অপ্রতিরোধ্য মেসিকে আটকানোর উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, "ম্যান মার্কিং করে মেসিকে আটকানো সম্ভব না হলে ওকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া উচিৎ।"
জেনারো গাট্টুসোর ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও কথাটা দারুণ ভাবে খাটে। সবচেয়ে খ্যাপাটে খেলোয়াড় বলেই তিনি খ্যাত। সুতরাং তার কাছে থেকে এমন অসাধারণ উক্তি আশা করাই যায়।
মিলানে তিনি রাজপুত্র, খেলতেন ডিফেন্সিভ মিড হিসেবে, খেলতে পারতেন উইংয়েও। তার ক্যারিয়ার টা পরিপূর্ণই বলা যায়। ক্যারিয়ারে সব শিরোপাই জিতেছেন। বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ কোনো শিরোপাই তার হাতের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়নি।
পুরো নাম জেনারো ইভান রিনো গাট্টুসো। জন্ম করিগলিয়ানো ক্যালাব্রো তে। স্থানীয় ক্লাব পেরুজিয়াতে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ১৯ বছর বয়সেই নজর কাড়েন তখনকার জায়ান্ট রেঞ্জার্সের কোচ ওয়াল্টার স্মিথের। তার খেলা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হন স্মিথ। আমন্ত্রণ করেন নিজের দলে। তার আমন্ত্রণে ইতালি ছাড়েন গাট্টুসো, যোগ দেন সূদুর স্কটল্যান্ডের দল রেঞ্জার্সে।
কিন্তু বছর ঘুরতেই আরেক সমস্যা দেখা দেয়। যিনি তাকে রেঞ্জার্সে নিয়ে এলেন, সেই স্মিথ ছাড়লেন ক্লাব। নতুন কোচ হিসেবে এলেন ডিক এডভোকাট। নতুন কোচের সুনজরে পড়তে পারেননি তিনি। ফলে ছাড়তে হলো ক্লাব। আবার ফিরে এলেন নিজ দেশ ইতালিতে। মাত্র চার মিলিয়ন পাউন্ডে যোগ দিলেন সেবারই সিরি আ তে প্রোমোশন পাওয়া ক্লাব সালেরনিতিনায়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত গাট্টুসো অনেক ভালো পারফর্ম করার পরও দলের রেলিগেশন এড়াতে পারেননি।
সে মৌসুমের পারফর্মেন্স দিয়ে তিনি অনেক বড় বড় ক্লাবের নজর কেড়েছিলেন। শেষে তাকে দলে ভেড়ায় এসি মিলান। ১৯৯৯ সালের সামারে আট মিলিয়ন ইউরোতে সালেরনিতিনা থেকে যোগ দেন মিলানে।
মিলানে শুরু হয় গাট্টুসোর স্বপ্নময় যাত্রা। ১৯৯৯ থেকে ২০১২, দীর্ঘ ১৩ বছর মিলানে কাটান তিনি। তার মতো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বিশ্ব ফুটবল খুব কমই দেখেছে। রোনালদো লিমার মতো স্ট্রাইকার কে প্রথম মৌসুমেই যেভাবে ধরাশায়ী করেছিলেন, তা ছিল দেখার মত। কেউই তার কাছে পার পেত না।
সেখানে তিনি ও পিরলো মিলে গড়ে তুলেছিলেন মাঝমাঠের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুন্দরতম পার্টনারশিপ। তাদের দুজনের মিউচুয়াল প্লেয়িং স্টাইল হয়ে উঠেছিলো মিলানের খেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। মিলানের তখনকার সাফল্যের পেছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছিলো এই পার্টনারশিপ।
মিলানের হয়ে ১৩ বছরে সব কিছুই জিতেছিলেন। ২০০৪ ও ২০১১, দুইবার লিগ জেতেন। এই দুইবারই সাথে সুপার কোপা ইতালিয়ানাও জেতেন। ২০০৩ এ জেতেন কোপা ইতালিয়া। আর স্বপ্নের চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন দুইবার, প্রথমবার ২০০৩ এ, তারপর আবার ২০০৭ এ। দুবারই সাথে উয়েফা সুপার কাপ, ২০০৭ এ তো ক্লাব বিশ্বকাপও জিতে নেন।
মিলানে তার পারফর্মেন্স ছিল অতুলনীয়। বিশ্বের সেরা ডিফেন্সিভ মিডে পরিণত হন তিনি। আর সমর্থকদের ভালোবাসায় সিক্ত হন। মিলান সমর্থকদের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন গাট্টুসো।
অবশেষে দীর্ঘদিনের বাঁধন ছিন্ন করে ২০১২ তে মিলান ছেড়ে সুইস ক্লাব সিয়নে নাম লেখান। ২০১৩ সাল থেকেই সেখানে প্লেয়ার কোচের ভূমিকায় আসেন। শুরু হয় তার কোচিং ক্যারিয়ার। পর্যায়ক্রমে সিয়ন থেকে পালের্মো, সেখান থেকে ক্রিটে কোচের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১৭ তে আবার ফেরেন মিলানে, এবার কোচ হিসেবে। প্রথমে কিছুদিন যুব দল কে কোচিং করান। অতঃপর নভেম্বরে মূল দলের দায়িত্ব নেন। ২০১৮ সালের এপ্রিলে মিলান তার সাথে ২০২১ সাল পর্যন্ত কন্ট্রাক্ট করে। কিন্তু ২০১৮-১৯ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হয় এসি মিলান। এতে নিজে থেকেই দায়িত্ব ছেড়ে দেন তিনি।
ইতালি জাতীয় দলেও তিনি লম্বা ক্যারিয়ার পার করেছেন। ১৯৯৫ সালে অনূর্ধ্ব-১৮ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপে ইতালি দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন, যেখানে ইতালি শেষ পর্যন্ত রানারআপ হয়। এরপর ২০০০ সালে অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপেও ইতালির হয়ে মাঠ মাতান। এবার আর পরাজয় নয়, ইতালি জেতে শিরোপা।
জাতীয় দলের হয়ে তিনি ৭৩ টি ম্যাচ খেলেন। এর মধ্যে ছিলো ২০০০ সালের সামার অলিম্পিক, ২০০২ বিশ্বকাপ, ২০০৪ ইউরো, ২০০৬ বিশ্বকাপ, ২০০৮ ইউরো, ২০০৯ কনফেডারেশন কাপ ও ২০১০ বিশ্বকাপ। ২০০৬ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইউক্রেনের বিপক্ষে অসাধারণ পারফর্ম করেন এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। সে বিশ্বকাপেও মিলানের সেই গাট্টুসো-পিরলো পার্টনারশিপ। মিলানের মতো এখানেও তাদের দুজনের অসাধারণ পার্টনারশিপে এগিয়ে যেতে থাকে দল। অবশেষে সে বিশ্বকাপের ফাইনালে ইতালি মুখোমুখি হয় জিদানের ফ্রান্সের। বহুল আলোচিত সে ম্যাচে ট্রাইবেকারে শেষ পর্যন্ত শিরোপা জয় করে ইতালি। গাট্টুসো বহু আকাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপের দেখাও পেয়ে যান। তার পারফর্মেন্স দিয়ে বিশ্বকাপের অলস্টার টিমেও জায়গা করে নেন।
এবার আসি তার ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের কথায়। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন ভদ্র ভালো মানুষ। যথেষ্ট হাসিখুশি। কিন্তু যখন তার রাগ উঠতো, মূহুর্তের মধ্যে সকল ভালো মানুষী কর্পূরের মতো উবে যেত।
প্রথম যে ঘটনা টা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে সেটি ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে, আয়াক্সের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে। দ্বিতীয়ার্ধের ইঞ্জুরি টাইমে হঠাৎ হাতের পৃষ্ঠ দ্বারা সজোরে চড় মেরে বসেন আয়াক্স স্ট্রাইকার জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের গালে। কর্মফল হিসেবে সাথে সাথেই তাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন রেফারি।
এরপর তার অনিয়ন্ত্রিত রাগ আবারও তাকে ঝামেলায় ফেলে ২০০৫ সালে। সেবার জার্মান জায়ান্ট শালকের কাছে ২-১ গোলে পরাজিত হয় মিলান। রেফারির শেষ বাঁশি বাজার পর দেখা যায় শালকের মিডফিল্ডার ক্রিশ্চিয়ান পুলসেন কে খুঁজে বের করে তার সাথে ঝামেলা পাকিয়ে বসে আছেন গাট্টুসো। পুলসেনের অপরাধ, তিনি গাট্টুসোর সতীর্থ কাকা কে প্রথমার্ধে জোরালো ভাবে মার্কিং করেছিলেন। এমনই অদ্ভুত গাট্টুসো।
২০১৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি চ্যাম্পিয়নস লিগে মিলানের ম্যাচ ছিলো টটেনহ্যাম হটস্পারের সাথে। ম্যাচের এক পর্যায়ে দেখা যায় স্পার্স কোচ জো জর্ডানের সাথে সাইডলাইনে তুমুল ঝগড়া বাধিয়েছেন গাট্টুসো। ঝগড়ার এক পর্যায়ে স্পার্স কোচ কে একদম গলা ধাক্কা দিয়ে বসেন গাট্টুসো। এমনকি সেখানে কিছুটা হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছিলো। ম্যাচ শেষে গাট্টুসো স্পার্স প্লেয়ার স্টাফ দের সাথে হ্যান্ডশেক করেন। কিন্তু জর্ডানের সাথে আবারও তার কথা কাটাকাটি আরম্ভ হয় এবং এক পর্যায়ে মাথা দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে বসেন। অনেক কষ্টে দুই দলের খেলোয়াড়েরা এসে তাদের দুজনকে আলাদা করে।
এ ব্যাপারে পরে ৩৩ বছর বয়সী গাট্টুসো বলেন, "আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি যা করেছি, তার জন্য কোনো অযুহাত দিচ্ছিনা। আমার কাজের পুরো দায়ভার আমি নিজেই নিচ্ছি।" তিনি আরও বলেন, জর্ডান তাকে উত্তেজিত করেছিলো। কিন্তু জর্ডান তাকে ঠিক কি বলেছিলো সেটি বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। বিভিন্ন নিউজপেপারে লেখে যে জো জর্ডান গাট্টুসোর সাথে বর্ণবাদী আচরণ করেন। তিনি সাইডলাইন থেকে গাট্টুসো কে "ফাকিং ইতালিয়ান বাস্টার্ড" বলে গালি দেন। তার পরদিন, উয়েফা ঘোষণা করে যে আগের দিনে জর্ডানের সাথে অখেলোয়ার সুলভ আচরণের জন্য বড় ধরণের শাস্তি পেতে যাচ্ছেন গাট্টুসো। গাট্টুসো কে সে ঘটনার পর পাঁচ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করে উয়েফা, কার্ডের জন্য এক ম্যাচ, আর জর্ডানের সাথে সেই কর্মকাণ্ডের জন্য চার ম্যাচ। ঘটনায় জড়িত থাকায় স্পার্স কোচকেও টাচলাইন ব্যান করে উয়েফা।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে সুইস সুপার লিগের একটি ম্যাচে রেফারির কাছ থেকে হলুদ কার্ড নিয়ে নেন গাট্টুসো। এরপর রেফারিকেই সেই হলুদ কার্ড প্রদর্শন করেন।
এমনই সব অদ্ভুত কাজকর্ম হরহামেশাই করতেন গাট্টুসো। ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর প্যান্ট খুলে শুধু আন্ডারওয়্যারে শুরু করেন দৌড়। অবশেষে ফিল্ড এসিস্ট্যান্ট রা এসে তাকে আটকান এবং প্যান্ট পরিয়ে নেন।
এসব কাজকর্মের জন্য বারবার আলোচিত সমালোচিত হয়েছেন জেনারো গাট্টুসো। তবে কখনোই সেসব নিয়ে মাথা ঘামাননি। নিজের যা উচিত মনে হয়েছে, সবসময় তাই করেছেন। এসব ছেলেমানুষী কাজকর্মের জন্যই হয়তোবা কারো কারো অনেক বেশী ভালোবাসা পেয়ে গেছেন, জায়গা করে নিয়েছেন হৃদয়ের মণিকোঠায়। এসবের জন্যই ফুটবল বিশ্ব হয়তো তাকে আজীবন মনে রাখবে, মাঝমাঠের এক খ্যাপাটে যুবরাজ হিসেবে।
- 0 মন্তব্য