• ফুটবল

যুদ্ধবিজয়ী বাঙ্গালী ফুটবল তারকা : জামাল ভূইয়া

পোস্টটি ৬৭৯৯ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

দুর্বৃত্ত'দের গোলাগুলি চলছে । এমন সময় ১৭ বছরের এক কিশোর এসে পড়লেন ওই স্থানে । না, তিনি তামিল ছবির নায়কের মত সব বাঁধা'কে অতিক্রম করে গুলি না খেয়েই সব দুর্বৃত্তদের বাতাসে উড়িয়ে দিলেন না। তিনি বাংলা ছবির নায়কদের মত ৪- ৪টা গুলি খাওয়ার পরেও বেঁচে আছেন!

মৃত্যু-দুয়ার থেকে ফিরে আসা কিশোরের যেন ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিলো, সে বেঁচে আছে! অবশ্য, তিনি সেজন্যে সৃষ্টিকর্তা পরম করুণাময়ের কাছে সর্বদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলেন না। কৃতজ্ঞতা আমাদের বাঙ্গালী'দেরও করা উচিত। সেদিনের ঘটনায় কিশোর'টি হারিয়ে গেলে আজ হয়তো বিশ্ব মঞ্চে আমাদের একজন যোগ্য প্রতিনিধি হারাতাম।

বাবার কাজের সূত্রে জন্ম ডেনমার্কে। সেখানে কেটে গেছে শৈশব, কৈশোর। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিলো ছেলে আইনজীবি কিংবা ডাক্তার হবে। কিন্তু শৈশব মনেই স্থির করে নিয়েছিলেন ফুটবলার হবেন। হয়েও গিয়েছেন ফুটবলার। তবে বাংলাদেশের মত একটা শেষ সারির ফুটবল ন্যাশানের হয়ে।

হয়ত খেলতে পারতেন ডেনমার্কের মত একটা মোটামুটি বিশ্বমানের দলের হয়ে। খেলতে পারতেন ইউরোপের বড় কোনো ফুটবল টিমে। কোপেনহেগেনের মত দলে অনুর্ধ্ব ১৯ লেভেলে খেলেছিলেন। হতে পারতো আরো বড় কোন জায়ান্ট ক্লাবে খেলার সৌভাগ্য হয়ত। কিন্তু তার শরীরে যে ছিলো বাঙালির রক্ত।

বাংলাদেশী জার্সি গায়ে খেলার স্বপ্ন তাই ছাড়তে পারেন নি। তো, ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে এসে চান্স পেলেন কিভাবে? জহুরী সাইফুল বারী টিটু তাকে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের হয়ে খেলা কি এত সহজেই হয়ে গেছে? নাহ, প্রথম ট্রেনিং সেশনে বারবার হাঁপিয়ে যাচ্ছিলেন। বারবার পানি খেয়েও তৃষ্ণা মেটাতে পারছিলেন না। কোচিং স্টাফরা দেখে তাকে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন । এ ছেলে কিভাবে ফুটবল খেলবে!

অন্যরাও তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করেছিলেন। আসলেই ভাই ইউরোপিয়ান আবহাওয়া থেকে বাংলা আবহাওয়া'য় এসে থাকা কি অতই সহজ। শুধু কি তাই, অসুবিধা হচ্ছিলো খেতেও । এত মসলাযুক্ত খাবার পেটে সইছিলো না । তারপরো তো দেশের জার্সি গায়ে খেলার স্বপ্ন এসবকে মানিয়ে নিয়ে গেছে। বলছিলাম আমাদের জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূইয়ার কথা।

একদিন শুনেছিলেন, তাকে নিয়ে সমালোচনার কথা। এরপর থেকেই তিনি আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এবং দেখুন স্বপ্ন যখন অটুট, তখন ঈশ্বরও ঠিক আপনার পিছনে। প্রথমবারের মতো খেলতে নেমেই বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। জাতীয় দলে খেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনে। যে পজিশনের ফুটবলার'রা বরাবরেই আড়ালে থেকে যায়। তার কাঁধে থাকে বারবারেই প্রতিপক্ষের মধ্যমনি হয়ে থাকা খেলোয়াড়টিকে চুপ রাখার দায়িত্ব। আর এ দায়িত্বে জামাল ভূইয়া বরাবরের মতই সফল।

মাসচেরানোর মত স্লাইডিং ট্যাকেলে বারবার প্রতিপক্ষের আক্রমন রুখে দেয়া, আবার আলোনসোর মত লং পাসে ডিফেন্সের সাথে এটাকের যোগসূত্র তৈরি করা দুটোতেই সমান সফল। ডিফেন্সকে ছায়া প্রদান করাই মূলত তার কাজ। তার সাথে খুব ভালোভাবে বলকেও আর্কেস্ট্রেট করেন । দলের প্রতিটি আক্রমন শুরু হয় তার পা থেকেই।

স্ট্রাইকারদের বলের জোগান দিতে হবে? প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিতে হবে? আক্রমণভাগ ও ডিফেন্সের মধ্যে সমন্বয় দরকার? পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে হবে? দেশের তরে নিজেকে উজাড় করে দিতে হবে?
চিন্তা কী, জামাল ভুঁইয়া আছেন না!

সাবেক বাংলাদেশ কোচ লোডভাক ডি ক্রুইফ তো তাকে, রয় কিনের মত লিজেন্ডারি খেলোয়াড় এর সাথে তুলনা করেছেন । শ্রীলংকান কোচ তাকে দক্ষিন এশিয়ার সেরা মিডফিল্ডার বলে ফেলেছেন। ডি ক্রুইফ এও বলেছেন যে, তাকে এশিয়ার সেরা মিডফিল্ডার বানাবেন । আজ তিনি এত কিছু পারি দিয়ে দেশের গর্ব, পুরো দেশ তাকে নিয়ে মাতামাতি করছে । ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা কিংবা জার্মানির হয়ে খেললে হয়তো পুরো বিশ্ব তাকে কাঁধে তুলে নাচতেন বা ইউরোপের কোন ক্লাবে খেললে হয়ত তার মাসিক বেতন দিয়েই পুরো বাংলাদেশ জাতীয় দল চলতে পারতো। সুযোগও পেয়েছিলেন । কিন্তু মাটির প্রতি টান এত লোভনীয় কিছু করা থেকে তাকে দেশে টেনে এনেছে।

বাংলাদেশি ফুটবল ভক্তরা তাকে ‘বাংলার মাশচেরানো’ ডাকলেও লুকা মদ্রিচ আর টনি ক্রুসের ভক্ত আমাদের জামাল ভুঁইয়া। আর রোল মডেল হিসেবে মানেন ডেনিশ ফুটবলার মাইকেল লাউড্রপকে।

আর সবার মতো গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাননি জামাল। এখনো তো ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজে নিজেই পড়াশোনা করেছেন আইটিতে! এ তো গেল ছাত্র জামালের কথা। এবার শুনুন ‘শিক্ষক’ জামালের কথা। ডেনমার্কের একটি হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস ও ইংরেজি বিষয়ে পড়ান বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার জামাল ভুঁইয়া।

কিন্তু এসব মুদ্রার এপিঠ। ওপিঠে লেখা, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার খেলেছেন ডেনমার্কের শীর্ষস্থানীয় লিগে! পারফরম্যান্সের গ্রাফ ওঠানামা করেছে প্রায়ই, তাই কখনো খেলেছেন কোপেনহেগেনে প্রথম বিভাগের দলে, কখনো বা দ্বিতীয় কিংবা চতুর্থ বিভাগের দলে। মাঝখানে ফিলিপাইনেও খেলেছেন। সেই জামাল এখন অসম্ভব রকম পরিণত, আরও বেশি পেশাদার। কী সেই পালাবদলের মন্ত্র, যাকে ধ্যান-জ্ঞান করেই জামালের এই পরিবর্তন? চোখ বুজেই উত্তরটি দেওয়া যায়, লাল-সবুজের জার্সি গায়ে চড়ানোর দৃঢ়প্রতিজ্ঞা!

এইতো বেশিদিন আগে নয়, একমাত্র বাঙ্গালী হিসেবে লা-লীগার আমন্ত্রনে দুবাইয়ের স্টুডিওতে বার্সালোনা বনাম এইবারের ম্যাচের ধারাভাষ্য দিয়ে এসেছেন জামাল ভূইয়া। দেশ'কে প্রতিনিধিত্ব করার এমন সুযোগ ক'জন-ই বা পায়!

ক্লাব পর্যায়ে জামাল ভূইয়াঃ

ক্লাব ফুটবলে জামালের হাতেখড়ি ডেনমার্কের ক্লাব কোপেনহেগেন। খেলেছেন তাদের অনুর্ধ-১৯ দলে। সেখান থেকে আরেক ডেনিস ক্লাব হ্যালারাপ আইকে'তে। এখানে ৩ মৌসুম খেলে পাড়ি জমালেন নিজ দেশ বাংলাদেশে। ২০১২ সালের ১ জুলাই তারিখে তার সাথে চুক্তি পাকাপোক্ত করে আবাহনী ফুটবল লিমিটেড। তবে আবাহনী'তে তার যাত্রা বেশিদিন টিকলো না। '১৩/১৪ মৌসুমে আবারো ফিরে গেলেন ডেনমার্কে। এবার তৃতীয় সারির ক্লাব 'বল্ডকোবেন আবার্থা'র ডাকে। পরের মৌসুমেই ফ্রি ট্রান্সফারে 'এভেডোর আইএফ' এর জার্সি গায়ে দিলেন জামাল।

পরের মৌসুমে তাকে আবারো বাংলাদেশের লীগে দেখা গেলো। তবে এবার 'শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব' এর জার্সিতে৷ তখন শেখ জামালের জয়জয়কার অবস্থা। যদিও পরের মৌসুমে তাকে ছেড়ে দেয় ক্লাবটি। নাম লেখান 'শেখ রাসেল কেসি' ক্লাবে। অবশ্য এবারো তাকে বেশিদিন একই পোষাকে দেখা গেলোনা। পরের দলবদলে নাম লেখালেন নব্য পরাশক্তি হিসেবে আসা 'সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবে'। ১ জুলাই ২০১৬ থেকে ১ অক্টোবর ২০১৯! সাইফের হয়ে জামালের পথচলা তবে কি শেষ? সর্বশেষ তিনি লোনে যোগ দিয়েছেন চিটাগং আবাহনী'তে।

জাতীয় দলের হয়ে জামাল ভূইয়াঃ

ডেনমার্কে যখন থাকতেন, তখন থেকেই লাল সবুজ জার্সিটা গায়ে চড়ানোর ইচ্ছাটা অন্তরে লালন করতেন জামাল। ২০১১ সালে ট্রায়াল দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। খাপ খাওয়াতে পারেননি বাংলাদেশি আবহাওয়ার সাথে। ২০১৩ সালে আবার এসেছিলেন তিনি। ট্রায়ালে সবার মন জয় করে জায়গা করে নিয়েছিলেন জাতীয় দলে।

সেই বছর বাংলাদেশের তৎকালীন ডাচ কোচ ডি ক্রুইফের হাত ধরেই জাতীয় দলে অভিষেক হয় তাঁর। ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট আসে তার জীবনের সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। প্রথমবারের নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন জামাল ভূঁইয়া। তিনিই প্রথম বিদেশে জন্ম নেওয়া ক্রীড়াবিদ, যিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশের।

২০১৮ সালে এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দলের অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয় অভিজ্ঞ জামাল ভূঁইয়ার নাম। ততদিনে বাংলাদেশের কোচের চেয়ারটি টম সেইন্টফিটের পর অ্যান্ড্রু অর্ডের হাত থেকে এসেছে ব্রিটিশম্যান জেমি ডের কাছে। এই কোচের রয়েছে আর্সেনালের যুবদলে খেলার অভিজ্ঞতা। এশিয়ান গেমসের প্রথম ম্যাচে আর্মব্যান্ড হাতে নিয়ে মাঠে নামেন জামাল ভূঁইয়া।

জাতীয় দলের লাল- সবুজ জার্সি গায়ে খেলা হয়েছে মাত্র ৩৫ ম্যাচ। পাশাপাশি অনুর্ধ-২৩ দলের হয়ে ৪টি ম্যাচ। সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছেন এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন কাতারের বিপক্ষে। হারলেও অসাধারণ খেলেছে বাংলাদেশ, উজ্জ্বল ছিলেন জামাল ভূইয়া। বিশ্বমঞ্চে লাল- সবুজের এমন একজন প্রতিনিধিত্বকারীকে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই গর্বিত। তার হাত ধরেই বাংলার ফুটবল অনেকদূর এগিয়ে যাবে- এই শুভকামনাই থাকবে সবসময়।

বর্তমান বাংলাদেশে ফুটবল দলে তিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুটবলার৷ হয়তো অনেকেরই। ভূল বললাম, শুধু বাংলাদেশে না- বিশ্ব ফুটবলেও তিনি আমার পছন্দের ফুটবলারদের তালিকায় থাকবেন। তিনি তো এখন আর দেশের তারকা না- পরিচয়টা তারচেয়ে অনেক বেশি। গ্লোবাল স্টার বললেও কম হবেনা। তারচেয়ে বড় কথা- জামালের মতো মানুষেরা সবকিছুর উর্ধ্বে দেশকে দেখেন, ভাবেন- কাজ করেন৷ এমন মানসিকতা-ই বা ক'জনের আছে। জামাল ভূইয়া'কে যুদ্ধবিজয়ী বাঙ্গালী ফুটবল তারকা বলা'টা কি তবে বেশি হয়ে যাবে?

© আহমদ আতিকুজ্জামান..