ব্রাউট হলান্ড - ইউরোপে নতুন এক ভাইকিং'য়ের উত্থান
পোস্টটি ৪৩৬১ বার পঠিত হয়েছেভাইকিং'দের কথা মনে আছে?? স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে জন্ম হলেও কালক্রমে সাহস, বীরত্ব আর পরাক্রমে যারা নিজেদের চিনিয়েছিলেন পুরো ইউরোপ তথা বিশ্ব ব্যাপি! শারীরিকভাবে প্রচন্ড শক্তিশালী, দীর্ঘকায় ও কষ্ট সহিষ্ণু ভাইকিং'রা ছিলো অপ্রতিরোধ্য!
সেই স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলেই জন্ম নেওয়া ১৯ বছর বয়সী আরলিং ব্রাউট হালান্ডের ইউরোপের ফুটবল মঞ্চে আগমন অনেকটাই খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর সেই ভাইকিং'দের মতোনই!
অথচ চ্যাম্পিয়নস লীগের এবারের আসর শুরুর আগে কিংবা বছরের শুরুতেও তাকে নিয়ে এত আলোচনা হয়নি! জলপথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেমন অতর্কিত এবং সফল সব হামলা চালিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো, একজন হালান্ড'ও ইউরোপের মঞ্চে হাজির হয়েছেন অতর্কিতভাবেই, কোনপ্রকার পুর্ব বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই; নিজেকে মেলে ধরছেন একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে, প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে হামলা চালাচ্ছেন কোন প্রকার অশনি সংকেত ছাড়াই! ভাইকিং হামলার সামনে দাঁড়াবার মত শক্তি ইউরোপের অন্য কোন দেশে তখন যেমন ছিলোনা, সবুজ ঘাসে ফুটবল নামক গোলকখানা পায়ে হালান্ডের আক্রমণের কোন জবাব যেনো তেমনই নেই প্রতিপক্ষের কাছে!
রেড বুল সালজবার্গ হয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগ অভিষেকের দিনেই অসাধারণ হ্যাট্রিক; খেলার ২ মিনিটের মাঝেই বুলেট গতির শটে প্রথম গোল, পরেরটা বাঁ পায়ের বুদ্ধিদীপ্ত নিখুঁত ফিনিশ, ৩৫ মিনিটের মাঝেই ফুটবলের রাজকীয় আসরে রাজকীয় অভিষেক! হঠাৎ করেই বিশ্বমিডিয়ার শিরোনামে, যেনো ভাইকিং রাজা রাগনার লথব্রোকের মতো জানান দেওয়া, সে আসছে সবকিছু নিজের করে নিতে, গোছানো রাজ্যে হামলা দিতে, নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে!
এই বছরের অ-২০ বিশ্বকাপের কথা মনে আছে?? হন্ডুরাসের বিপক্ষে ম্যাচে এক বালক একাই ৯ গোল করে ইতিহাস তৈরি করেছিলো! বালক'টা কে ছিলো জানেন তো?? আর কেউ নয় ২০১৯ যুব বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জয়ী ব্রাউট হলান্ড!
হলান্ডের ক্লাব সালজবার্গ, ২০১৯ সালের শুরুর দিনে অস্ট্রিয়ার সফলতম এই ক্লাবে যোগ দেন ১৮ বছর বয়সী এই তুর্কী! লীগে এই সিজনে নিয়মিত হয়েই ১১ ম্যাচে ১২ গোল ৪ এসিস্ট! রাজাদের লড়াইয়ের আসর চ্যাম্পিয়নস লীগেও অসাধারণ পারফরম্যান্স; ৪ ম্যাচে ৭ গোল, এখন পর্যন্ত এই সিজনে চ্যাম্পিয়নস লীগের সর্বোচ্চ; অনেকটা ভাইকিংদের মতই ক্ষ্যাপাটে আর নির্ভীক পারফরম্যান্স!
হলান্ডের আবির্ভাব যেনো নিজের গল্প লেখার জন্যেই!শারিরীক সক্ষমতা আর মাঠের ক্ষিপ্রতা ও বুদ্ধিদীপ্ত চটুলতার সংমিশ্রণ হলান্ড'কে বানিয়েছে ডিফেন্ডারদের দুর্গে হানা দেওয়ার অসাধারণ কৌশলীও রুপ! যেখানে তিনি পুরোপুরি সফল! ইতিমধ্যেই কেবল অস্ট্রিয়াই নয় ইউরোপের মঞ্চেও ডিফেন্ডারদের ভুগতে দেখা গেছে এই পাওয়ারহাউজ কে রুখতে! পুরো ইউরোপ জেনে গেছে একজন নরওয়েইন ভাইকিং তাদের জন্যে হুমকি স্বরুপ হয়ে আসছে, নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে!
অথচ কয়েকবছর আগেও কি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়েই না দিন কেটেছে হলান্ডের! নরওয়ের সেকেন্ড ডিভিশনের ক্লাব ব্রাইনি তে টানা ১৬ ম্যাচ গোলশূন্য ছিলেন এই ফরওয়ার্ড। গিয়েছিলেন জার্মানির হফেনহেইমে ট্রায়াল দিতেও, সেখানেও ছিলেন পুরোপুরি ব্যার্থ। যা ১৬ বছর বয়সী হলান্ডের ফুটবল ক্যারিয়ার কে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।
পরের বছর যোগ দেন প্রথম সারির ক্লাব মোল্ডে। যেখানে নিজের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট শুরু হয় হলান্ডের। যেখানে কোচ হিসেবে ছিলেন বর্তমান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ অলে গানার। তিনিই তার পছন্দে দ্বিতীয় সারির ক্লাব থেকে হলান্ড কে তার দলে জায়গা করে দেন। ঐ মৌসুমে দারুণ পারফর্ম করেন ১৭ বছর বয়সী হলান্ড; ৩০ ম্যাচের সিনিয়র ক্যারিয়ারে গোল করেন ১৬ টি। অলে তার সম্পর্কে বলেন - "মোল্ডে যোগ দেওয়ার পরেই আমি তার মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করি, নিজের শরীর কে কাজে লাগিয়ে আলাদা নজর দেয় ফিটনেসে, ধীরে ধীরে সে আরো শক্তিসম্পন্ন আর দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়ে উঠে। হলান্ড অসাধারণ, অনেকটা লুকাকু'র মতো!" সেই সময়েই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড স্কাউটের নজরে আসে হলান্ড! এবং তারপর থেকেই ভবিষ্যতে অল্ড ট্রাফোর্ডে যোগ দেওয়ার গুঞ্জন রয়েছে হলান্ড কে ঘিরে।
একবছর পরেই ২০১৯'র শুরুতে অস্ট্রিয়ায় পাড়ি জমান এই তরুণ। যেখানে তিনি যেনো আরো পরিণত, আরো উউচ্চাভিলাষী, আরো ক্ষিপ্র, আরো আক্রমনাত্মক!
উল্লেখ্য, হলান্ডের বাবা আল্ফ হলান্ড'ও একজন প্রফেশনাল ফুটবলার! যিনি ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার সিটি, লিডস ইউনাইটেড এবং নটিংহ্যাম ফরেস্টের একজন সফলতম ডিফেন্ডার। বাবার মতো তাই প্রিমিয়ার লীগেই খেলার স্বপ্ন দেখেন তরুণ হলান্ড। তাই তার ইচ্ছাতেই ইতালি কিংবা স্পেন থেকে কিছু লোভনীয় অফার আসলেও তা রিজেক্ট করে দেয় মোল্ড কর্তৃপক্ষ।
নরওয়ের হয়েও মাঠে নামা হয়ে গেছে হলান্ডের! অ-১৫ তে ৪ ম্যাচে ৪ গোল, অ-১৬ তে ১৭ ম্যাচে মাত্র ১ গোল! এরপরেই যেনো হলান্ডের ঘুড়ে দাঁড়ানো! অ-১৭ তে ৫ ম্যাচে ২ গোল, অ-১৮ তে ৬ ম্যাচে ৬ গোল, অ-১৯ তে ৬ ম্যাচে ৬ গোল! মাত্র ১৮ বছর বয়সেই খেলে ফেলেছেন নরওয়ের অ-২১ দল পর্যন্ত; যার ৭ ম্যাচে ১১ গোল এই গোলমেশিনের! জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ২ ম্যাচ খেললেও এখনো গোল পাননি!
ফুটবলের ট্যালেন্টের আখড়ার প্রশ্ন আসলেই উত্তর যেখানে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা কিংবা স্পেনের কোন একাডেমি; সেখানে হলান্ডের উঠে আসা সমুদ্র তীরবর্তী নরওয়ের ছোট্ট এক শহরে! যেকোন ফুটবলারের জন্যেই চ্যাম্পিয়নস লীগ অভিষেকেই হ্যাট্রিক তার ক্যারিয়ারের জন্যে আশীর্বাদ স্বরুপ, যেকোন ফুটবলারের জন্যে বিশ্বকাপের এক ম্যাচেই ৯ গোল করা অভাবনীয় অবিস্মরণীয়; যেনো বিশ্বকে নতুন এক অধ্যায়ের শুরুর জানান দেওয়া!
ভাইকিংরা যেমন নিজেদের অবিস্মরণীয় অনন্য অসাধারণ সব গল্প নিজেরাই তৈরি করে গেছেন, রাজত্ব করেছেন ইউরোপ জুড়ে; ধীরে ধীরে নিজেকে যেভাবে পরিণত করছেন হলান্ড, কে জানে হয়তোবা তেমনভাবেই একজন টিনেজার হলান্ড'র আকস্মিক আবির্ভাব'ও হয়তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের উদ্দেশ্যে নিজের রাজত্বের গল্প লেখার অভিপ্রায়েই!
- 0 মন্তব্য