চেনা ফুটবলের অজানা যত কীর্তিকলাপ
পোস্টটি ৬৬৮৪ বার পঠিত হয়েছেতর্কাতিত ভাবে বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই খেলা নিয়ে গল্প এবং মিথের কোনো শেষ নেই। মাঠের বাইরে কত বিচিত্র ঘটনারই না সাক্ষী থেকেছে ২২ জনের এই লড়াই। কখনোও সে সবের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন ফুটবলার, কখনোও রেফারি, কখনোও বা তৃতীয় কেউ। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক ফুটবল মাঠের তেমনই কিছু অদ্ভূত ঘটনা।
২০০৬ সালের বিশ্বকাপে গ্রুপ এফ-এর খেলা চলছিল অস্ট্রেলিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে। চোরাগোপ্তা মার ও পাল্টা মারে একাধিক কার্ড দেখাতে বাধ্য হচ্ছিলেন ব্রিটিশ রেফারি গ্রাহাম পোল। ম্যাচের ৬১ এবং ৯০ মিনিটে দু’টি হলুদ কার্ড দেখেন ক্রোট ডিফেন্ডার জোসিপ সিমুনিচ। কিন্তু দু’টি হলুদ কার্ড দেখালেও লাল কার্ড দেখাতে ভুলে যান পোল। এর পর ৯৩ তম মিনিটে ফের হলুদ কার্ড দেখেন সিমুনিচ। এই অদ্ভূত ভুলের খেসারত হিসাবে আন্তর্জাতিক রেফারিং থেকে অবসর নেন পোল।
ইংলিশ ফুটবল লিগের ক্লাব টর্ক ইউনাইটেডের ম্যানেজার হিসাবে এক অভিনব রেকর্ড করেন লেরো রোজেনিয়র। ২০০৭ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্লাবের দায়িত্ব নেন টর্ক। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নেয়ার কিছু ক্ষণ পরেই বিক্রি হয়ে যায় ক্লাব। নতুন মালিক ম্যানেজার হিসাবে আর তাঁকে রাখতে চাননি। সবচেয়ে কম সময়ে কোনও ক্লাবের দায়িত্ব নিয়ে রেকর্ড গড়েন তিনি।
বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল আইরিশ ফুটবলার স্টিফন আয়ার্ল্যান্ডের। কিন্তু ২০০৭ সালের সেদিন চেক প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে খেলা ছিল আয়ার্ল্যান্ডের। তা হলে উপায়? দলকে জানিয়ে দেন, তাঁর ঠাকুমা মারা গিয়েছেন এবং সেখানে তাঁর যোগদান আবশ্যিক। পরে জানা যায়, দিব্যি বেঁচে আছেন স্টিফনের ঠাকুমা। মিথ্যা ধরা পড়ায় প্রকাশ্যে ক্ষমা চান স্টিফন। তাঁর শাস্তিও হয়।
সামান্য মজার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা গিয়েছিল লুসিয়ানো রি সেসোনির ক্ষেত্রে। মাঠ এবং মাঠের বাইরে তাঁর সেন্স অব হিউমারের জন্য পরিচিত ছিলেন লাজিওর এই মিডফিল্ডার। ১৯৭৮ সালে রোমে একটি গয়নার দোকানে ঢুকে হঠ্যাৎ চিৎকার করতে থাকেন-
“যার কাছে যা আছে দিয়ে দাও, আমি এখানে ডাকাতি করতে এসেছি।”
মুহূর্তে গর্জে ওঠে দোকানের মালিকের বন্দুক। লুটিয়ে পড়েন সেসোনি। মাটিতে পড়ে গিয়ে তিনি বলতে থাকেন যে এটা একটা মজা ছিল। তিনি একজন ফুটবলার। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যু হয় তাঁর।
মাত্র ২৩ বছর বয়সে কার্লাইল ইউনাইটেডের ফুটবলার তথা ম্যানেজার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন ইভর ব্রডিস। রেকর্ডের পক্ষে এই তথ্যটুকুই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এর পরে ক্লাবের আর্থিক অবস্থা ক্রমে খারাপ হওয়ায় এক অভিনব সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সান্ডারল্যান্ডের কাছে নিজেকেই বিক্রি করে দেন। তাঁর ট্রান্সফারের অর্থে কিছুটা হাল ফেরে কার্লাইলের।
দেশের হয়ে প্রথম গোলদাতা হতে পারলেই আজীবন বিনামূল্যে বিয়ার- অভিনব এই পুরস্কার ঘোষণা করেছিল অস্ট্রিয়ার এক সংস্থা। পেনাল্টি থেকে গোল করে এই পুরস্কার জিতে নেন ইভিকা ভাসটিচ।
ক্রু আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে তখন ২-১ গোলে হারছিল টর্ক ইউনাইটেড। ম্যাচ হারলেই অবনমনের আশঙ্কা। এ দিকে খেলাও প্রায় শেষ। আচমকা টর্কের এক ফুটবলারের পায়ে কামড়ে দেয় পুলিশ কুকুর ব্রায়ান। চার মিনিট ইনজুরি টাইম পায় টর্ক। চতুর্থ মিনিটে গোল করে দলকে অবনমনের হাত থেকে বাঁচায় টর্কের পল ডবসন। ব্রায়ানকে ঘিরে উৎসব শুরু হয় টর্কে। মারা যাওয়ার পর টর্কের ক্লাবঘরে বহু দিন রাখাছিল ব্রায়ানের স্টাফড দেহ।
সমর্থকদের প্রবল বিক্ষোভ সঙ্গে নিয়ে ফিওরেন্তিনা থেকে তখন সবেমাত্র জুভেন্তাসে এসেছেন রবার্তো বাজ্জিও। ফিওরেন্তিনার বিরুদ্ধে ম্যাচে পেনাল্টি পায় জুভেন্তাস। কিন্তু পুরনো দলের বিরুদ্ধে পেনাল্টি নিতে অস্বীকার করেন বাজ্জিও। ম্যাচ হেরে যায় জুভেন্তাস। শাস্তি পান বাজ্জিও।
বিশ্বকাপ যোগ্যতা অর্জনকারী ম্যাচে এল সালভাদরের মুখোমুখি হয়েছিল হন্ডুরাস। ১৯৬৯ সালের সেই ম্যাচের কয়েক মাস আগে থেকেই সমস্যা চলছিল প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে। ম্যাচের আগের রাতে সালভাদরের ফুটবলারদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে হোটেলে ক্রমাগত ইট মারতে থাকেন হন্ডুরাস সমর্থকরা। পরের দিন ম্যাচে হেরে যায় সালভাদর। শোকে আত্মঘাতী হন এক সমর্থক। বদলা নিতে হন্ডুরাস আক্রমণ করে সালভাদর সেনা। যুদ্ধে মৃত্যু হয় ছ’হাজার মানুষের।
পেলে তখন ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অফ ফর্মে। হঠাৎ তাঁর মনে হয়, তিনি যে লাকি জার্সি পরে খেলতেন, সেটা এক ফ্যানকে দিয়েছেন। খোঁজ শুরু হল সেই ফ্যান এবং হারানো জার্সির। অবশেষে খোঁজ মিলল। সেই জার্সি পরে বেশ কয়েক দিন খেলেওছিলেন ফুটবল সম্রাট। কিন্তু পরে জানা যায়, সেই ফ্যান তাঁকে অন্য একটি জার্সি ফেরত দিয়েছিলেন।
এফএ কাপের খেলা চলছিল লিভারপুল আর আর্সেনালের মধ্যে। আচমকা একটি ১ ডলারের কয়েন এসে লাগে লিভারপুলের ডিফেন্ডার জিমি ক্যারাঘারের গায়ে। ক্ষুব্ধ ক্যারাঘার সেই কয়েন তুলে গ্যালারির দিকেই ছুড়ে মারেন। আহত দর্শক অভিযোগ জানালে ক্যারাঘারের ৪০ হাজার ডলার জরিমানা হয়। ইংল্যান্ডের জাতীয় দল থেকে সাময়িক ভাবে বাদ দেওয়া হয় তাঁকে।
২০০৮ সাল। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে থাকা রোনাল্ডো সিনিয়র তখন এসি মিলানে খেলছেন। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে যৌনকর্মীদের একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে ভিডিওর সত্যতা মেনে নেন তিনি। এর দিন কয়েক পরেই মিলান ছাড়তে হয় তাঁকে!
১৯৫০ সালের আসরে ফিফা দলই খুঁজে পাচ্ছিলনা। এই বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল ব্রাজিল। ১৯৫০ এর বিশ্বকাপে খেলতে সুযোগ পেয়ে ব্রাজিল পর্যন্ত গিয়েছিল ভারত। কিন্তু খালি পায়ে খেলার আবদার তোলে ভারত! খালি পায়ে খেলার অনুমতি না পাওয়ায় ভারতের আর বিশ্বকাপ খেলা হয়নি।
১৯৭০ বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো ব্রাজিল। এ আসরে ইংল্যান্ড দলে ন্যাক্করজনক এক ঘটনা ঘটে। মদ্যপান, চুরিও অশালীন আচরণের অভিযোগে ইংল্যান্ড তারকা ববি মুরকে গ্রেপ্তার করে মেক্সিকো পুলিশ। এ ছাড়াও ১৯৭০ বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, স্পেন ও পুর্তগালের মতো বিশ্বসেরা দলগুলোর আসরে সুযোগ না পাওয়ার ঘটনা। বাছাই পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যায় এ সেরা চার দল। অন্যদিকে ১৯৭০ বিশ্বকাপ আসরে অভিষেক হয় ইসরাইলের।
১৯৮৬ বিশ্বকাপের কথা, ২য় ও শেষ বারের মতো দেশকে বিশ্বকাপ এনে দেন ম্যারাডোনা। এই বিশ্বকাপে আর একটি দলের কথা না বললেই নয়, সেই দেশটি ডেনমার্ক। নতুন ধরনের ফুটবলে তারা চমক দিয়েছিল বিশ্বকে। স্কটল্যান্ডকে ১-০ উরুগুয়েকে ৬-১ এবং পশ্চিম জার্মানীকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপের চমক হিসাবে আবিভূর্ত হয় তারা। তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেনের কাছে ১-৫ গোলে হেরে আকাশ থেকে বিলাপ করে মাটিতে পড়ে ডেনিশরা।
৯০ মিনিটের এক ম্যাচে কয়টি লালকার্ড দেখা যায়? একটি, দুইটি বা খুব খারাপ কোনো দিন হলে তিন বা চারটি পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু আর্জেন্টিনার ক্লাব ফুটবলের এক ম্যাচে রেফারি ডেমিয়েন রুবিনো মাঠের সবাইকে লাল কার্ডে দেখিয়ে ছেড়ে ছিলেন। ক্লেপোল ও ভিক্টারিয়ানোর ম্যাচে প্রথম অর্ধে মাত্র দুজনকে লাল কার্ড দেখিয়েছিলেন রেফারি। দ্বিতীয়ার্ধে যেন নরক ভেঙে পড়ল মাঠে। কে কাকে ঘুষি দিচ্ছে বা লাথি মারছে, কারও কোনো হুঁশ নেই। খেলোয়াড়, কোচ, দর্শক হাত চালাতে বাদ রাখেননি কেউই। রেফারিও বা বাদ যাবেন কেন? মাঠের সবাইকেই তাই লাল কার্ড দেখিয়ে বসলেন তিনি।
এখন নম্বর ছাড়া জার্সি কল্পনাই করা যায় না। জার্সি নম্বরই যেন এখন খেলোয়াড়ের পরিচয় বাহক। এমনকি বড় বড় ক্লাব ও জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা বিশেষ কোন নম্বরের জার্সি পরার স্বপ্নও দেখেন। অথচ, একটা সময় ছিল যখন জার্সিতে কোন নম্বর লেখা থাকতো না। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথমবারের মতো জার্সিতে নম্বর লেখা হয়েছিল।
সবচেয়ে বেশি বয়সে গোল দিয়ে রেকর্ড অক্ষুণ রেখেছেন ক্যামেরুনের রজার মিলা। ১৯৯৪ সালে তিনি যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন, তখন তার বয়স ছিল ৪২ বছর ৩৯ দিন। আর গোল করার পরে সে-কি সেলিব্রেশন! আহ, নেচে নেচে দর্শকদের বিমুগ্ধ করেছিলেন মিলা, দর্শকরাও চেয়ার ছেড়ে হাততালি দিয়ে তার গোল সেলিব্রেশনের মুহুর্তটি উপভোগ করেছিল।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য