ক্রিকেট বনাম ফুটবল, কে এগিয়ে?
পোস্টটি ১১১৩১ বার পঠিত হয়েছেকাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার প্রিয় খেলা কি, তাহলে হয়তোবা শতকরা আশি ভাগ মানুষই উত্তর দিবে ক্রিকেট অথবা ফুটবল। বর্তমানে সন্দেহাতীত ভাবে আমাদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা এ দুটি। কিন্তু এদের মধ্যে কোনটি এগিয়ে?
দুটি খেলার মধ্যে যদি তুলনা করতে চাই, তাহলে বেশ কিছু বিষয়ে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তাহলে শুরু করা যাক।
ক্রিকেট খেলা কে বলা হয় রাজকীয় খেলা। এ খেলায় সাধারণত সাহেবি পোশাক আশাক ব্যবহার করা হয়। অন্য খেলার তুলনায় অভিজাত সরঞ্জামাদির কারণেই মূলত এ নামকরণ করা হয়েছে। আর অন্যান্য খেলার তুলনায় বলতে গেলে এ খেলায় সরঞ্জামাদি প্রচুর প্রয়োজন হয়। তাই খরচ অনেক বেশি হয়ে থাকে।
অন্যদিকে ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবলের সরঞ্জামাদি ও খরচ বেশ কমই বলা যাই। একটা ফুটবল থাকলেই সেটা নিয়ে কয়েকজন মাঠে নামা যায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো ম্যাচ পরিচালনা তেও ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবলে খরচ বেশ কম।
ক্রিকেট মূলত দীর্ঘ সময়ের খেলা। অরিজিনাল ক্রিকেট যেটা কে বলা হয়, সেই টেস্ট ম্যাচ একটির দৈর্ঘ্য পাঁচ দিন। একটানা পাঁচ দিন একটা ম্যাচ পরিচালিত হওয়ার চেয়ে বোরিং ব্যাপার খুব কমই আছে বলে আমি মনে করি। পরবর্তীতে ওয়ানডে ম্যাচ এসেছে, কিন্তু সেটাও সকালে শুরু হলে শেষ হতে সন্ধ্যা লেগে যায়। পরে টি টোয়েন্টি এসেছে, এইটার সময় অবশ্য অনেক কম। তারপরও আড়াই থেকে তিন ঘন্টা লেগে যায়। তবে টি টোয়েন্টি গুলো উত্তেজনাপূর্ন হলেও ক্রিকেটের সত্যিকারের স্বাদ এ খেলায় পাওয়া যায়না।
অপরপক্ষে ফুটবল হলো স্বল্প সময়ের টান টান উত্তেজনাপূর্ন খেলা। নব্বই মিনিটের এ খেলায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা মূহুর্ত উত্তেজনায় ঠাসা। প্রতি মুহূর্তে বদলায় খেলার রং। ফলে বিরক্তির তেমন কোনো অবকাশই থাকেনা।
দীর্ঘ সময়ের ফলে আর্থিক ভাবেও যেমন ক্রিকেট ব্যয়বহুল, তেমনি অনেক বিরক্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটা ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে গেলে দর্শকরা একদিকে যেমন বোর হয়ে যায়, তেমনি আর্থিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ সময় খেলা দেখায় তারা বিরাট একটা সময় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারেনা৷ ফলে তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ভাবেও যেমন আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়, তেমনি সার্বিকভাবে দেশও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ বিষয়টি মাথায় রেখে জাপানে একবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো।
এবার আসি জনপ্রিয়তায়। এই দিকটি যদি বিবেচনা করি, তাহলে ফুটবলের সাথে ক্রিকেট কোনোভাবে তুলনাতেই আসতে পারেনা। ফুটবলের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী। সারাবিশ্বের প্রতিটি দেশে, প্রতিটি অঞ্চলে ফুটবল খেলা তুমুল জনপ্রিয়। এ খেলার জনপ্রিয়তার সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো খেলাই পৃথিবীতে নেই।
অপরপক্ষে, বিশ্বব্যাপী বিবেচনা করলে ক্রিকেটের তেমন কোনো জনপ্রিয়তা নেই বললেই চলে। সত্যিকারের পেশাদারী ক্রিকেট খেলেই বলতে গেলে মাত্র ডজন খানেক দল। এর বাইরে অন্যান্য দেশ ক্রিকেট থেকে একদম বিচ্ছিন্নই বলা যায়। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ ক্রিকেট খেলা চেনেই না। ইন ফ্যাক্ট, রাগবি, টেনিস, গল্ফ, বাস্কেটবল প্রভৃতি খেলা ক্রিকেটের চেয়ে অনেক অনেক বেশি জনপ্রিয়।
আবার ফুটবল হলো সব মৌসুমের খেলা। রোদ ঝড় বৃষ্টি ঠান্ডা গরম কোনো কিছুই এ খেলাকে থামাতে পারেনা। বছরের যেকোনো সময় এ খেলার আয়োজন করা যায়। সারা বছরই ফুটবলের জন্য অনুকূল। অপরদিকে একটু ভারী বৃষ্টি হলেই ক্রিকেট খেলা পন্ড।
ক্রিকেটের আম্পায়ার ও ফুটবলের রেফারির মতো মধ্যেও বেশ কিছু পার্থক্য আছে। ফুটবলে রেফারির প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি দৌঁড়াতে হয় একজন রেফারির। ফলে খেলায় মনোযোগে কখনো ব্যাঘাত ঘটেনা। আর তার সিদ্ধান্তও নিতে হয় অতি দ্রুত ও সঠিকভাবে। এ সিধান্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই সঠিক হয়ে থাকে।
আর ক্রিকেটে আম্পায়ার সারা খেলা জুড়ে কেবল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই দায়িত্ব পালন করেন। আবার ডিসিশন নেওয়ার ক্ষেত্রেও একাধিক আম্পায়ার জিজ্ঞাসা করে কথা বার্তা বলে আস্তে ধীরে ডিসিশন নেন। অনেক সময় থার্ড আম্পায়ারের সাহায্য নেন। ফলে প্রচুর সময় অপচয় হয়। আর দর্শক রাও আম্পায়ারের চেয়ে রেফারি এবং তার ডিসিশন কে অনেক ভালোভাবে গ্রহণ করে।
আবার, ক্রিকেটে প্রতি ওভার, উইকেট, বাউন্ডারির পর বানিজ্যিক বিরতি দেওয়া হয়। আর এ বিরতিতে বিজ্ঞাপনের জন্য বিভিন্ন কোম্পানি ও পণ্যের সাথে চুক্তি করা হয়। আবার নানারকম সরঞ্জামাদি যেমন জার্সি, ক্যাপ, ব্যাট, হেলমেট সবকিছুই বিভিন্ন কোম্পানি স্পন্সর করে থাকে। ফলে খেলার স্বাভাবিক ধারার চেয়েও ক্রিকেটে বাণিজ্য টাই প্রধান হয়ে ওঠে। মূল প্রতিপাদ্য টাই বিপন্ন হয়।
অপরপক্ষে ফুটবলে বাণিজ্যিক ধারাটা ক্রিকেটের তুলনায় খুবই কম। এখানে টানা পয়তাল্লিশ মিনিট বিরতিহীন খেলা হয়। তারপর একটা বিরতি। অতঃপর আবার পয়তাল্লিশ মিনিট বিরতিহীন খেলা। তাই বাণিজ্যিক ব্যাপারটা এখানে তেমন প্রভাব ফেলার অবকাশই পায়না এবং খেলার মূল প্রতিপাদ্য ও উদ্দেশ্য টা বজায় থাকে।
ক্রিকেটে নজর থাকে সবসময় শুধু একজনের ওপর। কোনো ব্যাটসম্যান, বোলার বা ফিল্ডার। ফলে ক্রিকেটে অন্যরা স্ক্রিনের বাইরে চলে যায়। কিন্তু ফুটবলে নজর থাকে বলের ওপর। আর প্রতি মূহুর্তেই সেই বল চলে যায় একজন থেকে অন্যজনের কাছে। ফলে পুরো খেলাটি এবং সকল খেলোয়াড় স্ক্রিনে জায়গা পায়। দর্শকরাও পুরো খেলা পর্যবেক্ষণ করে।
আবার ফুটবলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জার্সি। বিভিন্ন দেশ ও ক্লাবের জার্সি ও লোগো যেমন নির্দিষ্ট, তেমনি সবার নজরেও থাকে সবসময়। প্রত্যেকের জার্সির বিশেষ রং, হোম ও অ্যাওয়ে জার্সির ভিন্নতা প্রভৃতি ফুটবলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ক্লাসিকাল রং সে দেশের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। আবার জার্সি নম্বরও ফুটবলে বিশেষ অর্থ বহন করে। ১ নম্বর গোলকিপার, ৯ নম্বর স্ট্রাইকার, ১০ নম্বর কি প্লেয়ার.... প্রভৃতি যেন নির্ধারিত। সর্বকালের সেরারা যেমন বিখ্যাত, তেমনি বিখ্যাত তাদের জার্সি নম্বরও।
কিন্তু ক্রিকেটে জার্সির তেমন কোনো গুরুত্বই নেই৷ ক্রিকেট খেলেই কয়েকটা দেশ, তার মধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড ও আফগানিস্তানের জার্সি প্রায় একই। তেমনি মিল পাকিস্তান, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা আর আয়ারল্যান্ডের জার্সির মধ্যে। কোনো ক্লাসিকাল ভাবই নেই জার্সির মধ্যে। আবার জার্সি নম্বরেরও কোনোই গুরুত্ব নেই। কার যে কি জার্সি নাম্বার, সেটার দিকে কেউ খেয়ালই করেনা।
আবার ফুটবলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধারাভাষ্য। খেলার রং যেমন বদলায় মুহুর্তে মুহুর্তে, তেমনি বদলায় ধারাভাষ্যে। খেলায় যখন চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেই উত্তেজনা তেমনি ভাবে ছড়িয়ে যায় ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে। গোলের মুহূর্ত গুলো আরো বেশি উত্তেজনাময় হয়ে ওঠে ধারাভাষ্যকারের কথায়।
অপরদিকে ক্রিকেটে ধারাভাষ্য বলতে গেলে একদমই উত্তেজনাহীন এবং বোরিং। সব ম্যাচে সব সময় একই ছন্দে খেলার বর্ণনা ছাড়া কিছুই থাকেনা এখানে।
সত্যিকার অর্থেই ফুটবলের উত্তেজনার সাথে ক্রিকেটের উত্তেজনার তুলনা চলেনা। ফুটবলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত উত্তেজনা বজায় থাকে। আর প্রায় সবসময়ই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফুটবল ম্যাচ আনপ্রেডিক্টেবল। কারণ যে কোনো মুহুর্তেই হয়ে যেতে পারে গোল, আর তাতেই বদলে যায় খেলার পুরো চেহারা।
অপরদিকে, ক্রিকেটে উত্তেজনা ক্রিকেটের তুলনায় অনেক কম। বেশিরভাগ সময়ই ক্রিকেট প্রেডিক্টেবল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই সাধারণত বলে দেওয়া যায় যে ফলাফল কি হতে যাচ্ছে। কোনো উত্তেজনাই আসেনা। কিছু ম্যাচে অবশ্য শেষ মুহূর্তে অনেক উত্তেজনা ছড়িয়ে যায়, কিন্তু সেটাও স্বল্প সময়ের জন্য। শুরুর দিকে এসব উত্তেজনার কিছুই থাকেনা।
সর্বোপরি, খেলা হিসেবে ক্রিকেটের চেয়ে ফুটবল প্রায় সব দিক থেকেই এগিয়ে। তাই ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেট কে এগিয়ে রাখা একধরনের বোকামি ছাড়া কিছুই না। হ্যাঁ, অনেকের কাছে যেমন ফুটবল প্রিয়, তেমনি অনেকের কাছে ক্রিকেট। এইটা হবেই, এটাই ন্যাচারাল। কিন্তু ক্রিকেট প্রিয় হওয়ার অর্থ এই না যে ক্রিকেট ফুটবলের চেয়ে এগিয়ে। তারপরও প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত থাকবেই। মতামতে বৈচিত্র্য আছে বলেই মানবজাতি এত সুন্দর। তাছাড়া, বাংলাদেশ ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। তাই এই প্রেক্ষাপটে ক্রিকেট কে যে অনেক মানুষ অন্তরে লালন করবে, এটাই স্বাভাবিক বিষয়।
[It's totally personal opinion and maybe a bit one-sided. If anyone gets hurt by it, I'm extremely sorry]
- 0 মন্তব্য