আ স্টোরি অব ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ অ্যান্ড টোটাল ফুটবল
পোস্টটি ৫৬৫৪ বার পঠিত হয়েছেটোটাল ফুটবল।
কথাটা শুনলে প্রথম যে নামগুলো আমাদের মনে আসে, তা হলো ইয়োহান ডি ক্রুইফ, রিনাস মিশেল, আয়াক্স, হল্যান্ড।
গতানুগতিক ফুটবলের ধারা পাল্টে তারা আমাদের উপহার দিয়েছিলো এক অন্য ধারার ফুটবল। মন মাতানো, চোখ ধাঁধানো সে ধারা। ফুটবল ইজ দ্য বিউটিফুল গেম, কিন্তু তারও এক বিশেষ বিউটিফুল পার্টের নামই টোটাল ফুটবল।
আর এ টোটাল ফুটবলের চমক বিশ্ব দেখেছে হল্যান্ড এর কাছেই। হ্যাঁ, গুরু রিনাস মিশেল আর তার স্নেহধন্য শিষ্য ইয়োহান ডি ক্রুইফের সেই হল্যান্ড।
টোটাল ফুটবল কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা খুব সহজ বিষয় না। তবে একদম সহজ কথায় বললে, পুরো দল একই সঙ্গে রক্ষণ ও আক্রমণ করার কাজটি সম্পন্ন করাই মূলত টোটাল ফুটবলের প্রধান বিষয়।
টোটাল ফুটবলের দর্শন টা অনেকটা সাম্যবাদের মতো। এখানে প্রতিটি খেলোয়াড় সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত পজিশনিং ফুটবলের একদম উল্টা এটি। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি খেলোয়াড় খেলে ফ্রি রোলে। ডিফেন্স থেকে অ্যাটাক, প্রতিটি পজিশনেই প্রতিটি খেলোয়াড় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ফলে এই পদ্ধতিতে খেলোয়াড়দের বিশেষ দক্ষ হয়ে উঠতে হয়। যেকোনো সময় যেকোনো অবস্থানে খেলা ও সামাল দেওয়ার মতো দক্ষতা থাকতে হয়।
সবার ফ্রি রোল ও পুরো মাঠ সামাল দেওয়ার চমৎকার ধরনের কারণে হল্যান্ড দলটির নামই হয়ে যায় ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ।
শুরুটা হয়েছিলো সত্তরের দশকের পর থেকে। ১৯৩৮ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার ৩৬ বছর পর আবারো বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে সেবার ফিরে আসে ডাচরা। ফিরে আসে ফুটবলের নতুন এক বার্তা নিয়ে।
বিশ্বকাপ ১৯৭৪। আগের বার তৃতীয় বারের মতো জুলে রিমে ট্রফি জিতে সেটি চিরতরে নিয়ে গেছে ব্রাজিলিয়ানরা। নতুন বিশ্বকাপের এটাই ছিলো প্রথম আসর।
সেবার আসর বসেছিলো পশ্চিম জার্মানিতে। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ও জার্ড মুলারদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী পশ্চিম জার্মানিই ছিলো সেবারের টপ ফেভারিট।
নব্য দর্শন নিয়ে খেলতে আসা এ দলের কেন্দ্রে অবধারিতভাবেই ছিলেন ক্রুইফ। আর তার সাথে ছিলেন ইয়োহান নিসকিন্স, রব রেনসেনব্রিঙ্ক, রেনে ফন ডি কিরকফের মতো কিছু দুর্দান্ত পারফর্মার। সব মিলিয়ে বহু বছর পর দারুণ শক্তিশালী একটা দল নিয়েই এসেছিল ডাচরা।
জার্মানির আবহাওয়াটা ছিলো ডাচ দের জন্য বেশ প্রতিকূল। তারপরেও শুরুটা হয়েছিলো দারুণ ভাবেই। অপরাজিত থেকেই গ্রুপ পর্ব শেষ করে তারা। সেইসময়ের নতুনভাবে জেগে ওঠা আর্জেন্টিনা কেও ৪-০ গোলে পরাজিত করে হল্যান্ড।আর্টিস্ট ইয়োহান ডি ক্রুইফ করেছিলেন জোড়া গোল। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন পরাক্রমশালী ব্রাজিলও রুখতে পারেনি টোটাল ফুটবলের শৈল্পিক ধারাকে। পরাজিত হয় ২-০ গোলে।
অবশেষে ফাইনালে উঠে আসে হল্যান্ড। সেখানে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী পশ্চিম জার্মানি। একে তো শক্তিশালী দল, তার সাথে হোম অ্যাডভান্টেজ। সব মিলিয়ে জার্মানিকে আটকানো ছিলো প্রায় অসম্ভব।
দুইদিকেই ছিলেন ফুটবল ইতিহাসের সব গ্রেটরা। একদিকে বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বে শক্তিশালী জার্মানি, সেসময় তার সাথে ছিলেন আরেক কিংবদন্তি গোলমেশিন জার্ড মুলার। তাদেরও ইতিহাসের সোনালী প্রজন্মই তখন মাঠ মাতিয়ে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে ক্রুইফ এবং তার টোটাল ফুটবল। সব মিলিয়ে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উত্তেজনাপূর্ণ এক ম্যাচের প্রতিক্ষায় ছিলো বিশ্ব।
রেফারির বাঁশি বাজার সাথে সাথেই সেই উত্তেজনার আমেজ শুরু হয়ে যায়। ম্যাচের প্রথমদিকেই এগিয়ে যায় ক্রুইফের দল। ক্রুইফ ফাউলের শিকার হলে হল্যান্ডকে দ্বিতীয় মিনিটেই এগিয়ে দেন ইয়োহান নিসকিন্স। যেটি এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফাইনালের দ্রুততম গোল। জার্মানিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ব্রিয়েটনারের গোলে সমতায় ফেরে তারা। অতঃপর জার্ড মুলারের গোলে ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আর গোলের দেখা পায়নি হল্যান্ড, ছোঁয়া হয়নি বিশ্বকাপ। ক্রুইফকে টেক্কা দিয়ে ট্রফি হাতে তোলেন তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।
এরপর কেটে যায় আরো চারটি বছর। সময় ঘনিয়ে আসে আরেকটি ফুটবল মহোৎসব এর। জার্মানি ছেড়ে এবার লাতিন দেশ আর্জেন্টিনায়।
আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত এ বিশ্বকাপটি ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত টুর্নামেন্ট। আর্জেন্টিনার ক্ষমতায় তখন স্বৈরশাসক। ফুটবলের মধ্যে ঢুকে পড়ে রাজনীতি ও সরকারি হস্তক্ষেপ। ফলে বিশ্বকাপ বর্জন করে ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জের কি প্লেয়ার ক্রুইফ। তাকে বাদ দিয়েই তাই আর্জেন্টিনায় যাত্রা করে হল্যান্ড দল।
গতবারের রানারআপ হিসেবে আর মাঝের বছরগুলোর পারফর্মেন্সে হল্যান্ড তখন পরাশক্তি হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে। গ্রুপ পর্বে তাদের দেখা হয় পেরু, স্কটল্যান্ড ও ইরানের সাথে। এবার ঘটে এক অঘটন। স্কটিশদের কাছে হেরে যায় ডাচরা। ফলে পেরু হয় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন, তারা রানারআপ।
তখন দ্বিতীয় রাউন্ডও ছিল রাউন্ড রবিন ফরম্যাটে। প্রথম ম্যাচে অস্ট্রিয়া কে হারানোর পর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানির বিপক্ষে আসে ২-২ গোলের ড্র। অন্য ম্যাচে অস্ট্রিয়া কে ১-০ গোলে হারায় ইতালি। শেষে সমীকরণ দাঁড়ায়, জার্মানি হেরে গেলেই ডাচদের বিশ্বকাপ ফাইনাল নিশ্চিত। অবশেষে অস্ট্রিয়া ৩-২ গোলে হারিয়ে দেয় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের, এবং তারই সাথে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে জায়গা করে নেয় রিনাস মিশেলের টোটাল ফুটবল।
আরও একটি বিশ্বকাপ ফাইনাল, আরও একবার প্রতিপক্ষ স্বাগতিকরা। জার্মানির পর এবার আর্জেন্টিনা।
১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপের রানারআপ আর্জেন্টিনার স্বপ্ন ছিলো একটি শিরোপা। গোল্ডেন জেনারেশনের হল্যান্ডেরও লক্ষ্য গতবারের ফাইনালের ব্যর্থতা ঘুচিয়ে এবার ট্রফি ঘরে তোলা।
ফেভারিট ছিলো হল্যান্ডই। হল্যান্ডের পরিপক্ক দলের সাথে আর্জেন্টিনার সে দলের তুলনা চলেনা। আর্জেন্টিনার ফাইনালে আসাটাই ছিলো নানা বিতর্কে পরিপূর্ণ। ডানিয়েল পাসারেল্লা ও মারিও কেম্পেস ছাড়া ভরসার করার মতো বলতে গেলে কেউই ছিলোনা। অপরদিকে ক্রুইফ না থাকলেও টোটাল ফুটবলের হল্যান্ড ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। ক্রুইফের কোনো অভাবই বোধ হচ্ছিলো না।
কিন্তু সে বিশ্বকাপ টা ফুটবলের সৌন্দর্যের বিশ্বকাপ ছিলোনা। দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় পরিপূর্ণ ছিলো সেবারের টুর্নামেন্ট। আর্জেন্টিনা সরকার যেকোনোভাবে আর্জেন্টিনা কে চ্যাম্পিয়ন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা লেগে থাকে হল্যান্ডের পিছনে। হল্যান্ড দলকে মাঠে নিয়ে আসতেও অনেক হয়রানি করা হয়৷ তাদের ঠিকভাবে অনুশীলনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি।
সবমিলিয়ে খেলা শুরুর আগেই হল্যান্ড দলের মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। কাজও হয় এতে। ভেঙে পড়া হল্যান্ড কে চারিদিক থেকে চেপে ধরে আর্জেন্টিনা। ৩৮ মিনিটে মারিও কেম্পেসের গোলে এগিয়ে যায় স্বাগতিকরা। তবে এত কিছুর পরও লড়াই করে গেছে হল্যান্ড। ৮২ মিনিটে নানিঙ্গা গোল করে ম্যাচে সমতা ফেরান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এবারও আর শেষ রক্ষা হয়নি। ১০৪ মিনিটে কেম্পেসের আরেকটি গোলের পর ১১৫ মিনিটে বার্তেনির গোল। আরও একবার পরাজিত হয় সুন্দর ফুটবল। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ হাতে ওঠে আর্জেন্টিনার। আর টানা দুইটা ফাইনাল খেলেও শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে ব্যর্থ হয় টোটাল ফুটবলের প্রণেতারা।
পরবর্তীতে সেই বিশ্বকাপের আরো দুর্নীতি উন্মোচিত হয়। জানা যায়, ইয়োহান ক্রুইফ কে বাড়িতে এসে হুমকি দেওয়া হয়েছিলো বিশ্বকাপ না খেলার জন্য। ফুটবলে দুর্নীতি যে কত নোংরা পর্যায়ে যেতে পারে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণই হয়ে আছে সেই টুর্নামেন্ট।
১৯৭৪ ও ১৯৭৮, দুটি বিশ্বকাপে হল্যান্ড বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে ফুটবলের সৌন্দর্য। নব্য আদর্শে উজ্জীবীত ক্রুইফের সেই হল্যান্ড এসেছিলোই সৌন্দর্যের বার্তা নিয়ে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ট্রফি হাতে না ওঠা সবচেয়ে দুর্ভাগা দলের লিস্টেই উঠে আসে তাদের নাম।
১৯৭৮ বিশ্বকাপের পর থেকেই হারিয়ে যেতে থাকে ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ। কালের গর্ভে একদমই হারিয়ে যায় সে দল। এমনই অবস্থা হয় যে পরে টানা তিনটি বিশ্বকাপে মূলপর্বেই যায়গা পায়নি হল্যান্ড।
হারিয়ে গেছে ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ। তবে টোটাল ফুটবল হারিয়ে যায়নি। টোটাল ফুটবলের সেই সৌন্দর্য বিশ্বকে উপহার দিয়েছে আয়াক্স, বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ সহ আরো অনেক দল। কিন্তু টোটাল ফুটবল, নামটির সাথে এখনো প্রথমেই আসে সেই নামগুলোই। ইয়োহান ক্রুইফ, রিনাস মিশেল অ্যান্ড দ্য টিম অব ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ।
- 0 মন্তব্য