ছোটই বটে, আমাদের ছোট্ট বাংলাদেশের চেয়েও ক্ষুদ্রতর। কিন্তু তার তুলনায় আরো ক্ষুদ্র তাদের জনসমষ্টি। বসবাসের জন্য পরিবেশ টা একদমই অনুকূল নয়। পুরো স্থলভাগই আগ্নেয়গিরি আর পাহাড় দিয়ে পরিবেষ্টিত। সমতল ভূমি একদমই নেই বললেই চলে।
শুধু তাই নয়, বছরের প্রায় নয় মাসই বরফ দিয়ে ঢাকা থাকে প্রায় পুরো দ্বীপ। গ্রীষ্মকালে পরিবেশ কিছুটা অনুকূল হয়, এসময় তাপমাত্রা দশ থেকে পনের ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে উঠে আসে। এই সময়টাতেই কিছুটা প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে আসে। বিভিন্ন দেশ থেকে দর্শনার্থীদের আগমনে অনেকটাই মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
সবমিলিয়ে দেশটির আয়তন ১ লক্ষ ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার। আর এ পুরো ভূখণ্ডে বাস করে সাড়ে তিন লক্ষেরও কম মানুষ। তাদের মধ্যে আবার দুই তৃতীয়াংশ বাস করে রাজধানী রিকইয়াভিকে।
বিপদসংকুল পরিবেশ সর্বত্র, বিশেষভাবে উত্তরদিকে। এ এলাকা পুরোটাই অসংখ্য আগ্নেয়গিরি, দুর্গম বরফ পাহাড়, গ্লেসিয়ার আর লাভা স্রোতে ঢাকা।
গত শতাব্দীর শুরুর দিকেও ইউরোপের দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত ছিলো আইসল্যান্ড। সেখানকার লোকদের জীবিকার প্রধান মাধ্যম ছিলো সমুদ্রে মাছ ধরা, আর হালকা চাষাবাদ। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মাছ শিকার বাণিজ্য করণ ও পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে দ্রুতই উন্নত দেশ হয়ে উঠেছে তারা।
তবে এসব কিছু নয়, সম্প্রতি তারা সারা পৃথিবীর দৃষ্টি কেড়েছে অন্য একটি উপলক্ষ দিয়ে। তার নাম ফুটবল। যেখানে তারা গত কয়েক বছরে জন্ম দিয়েছে একের পর এক বিস্ময়।
আইসল্যান্ডের ফুটবলের গল্পটাকে কি রূপকথা বলা যায়? হয়তো। কিন্তু তাদের গল্পটা ততোটাও সহজ ছিলোনা। তাদের এ সাফল্য বহু বছরের হার না মানা কঠোর সাধনার ফসল। আজকের এ জায়গায় আসতে পাড়ি দিতে হয়েছে বহু বাধা ও অমসৃণ পথ।
আইসল্যান্ডে ফুটবলের শুরুটা বেশ দেরিতেই। তারা প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ১৯৩০ সালে, যতদিনে ইউরোপের অন্যান্য সব দেশই ফুটবলে পরিপক্বতা অর্জন করে ফেলেছে। তবে সেটাও ফিফার স্বীকৃত ম্যাচ ছিলোনা। ফিফা স্বীকৃত প্রথম ম্যাচ খেলে ১৯৪৬ সালে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান আরেক দেশ ডেনমার্কের সাথে। তারপর থেকেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে আইসল্যান্ডিকদের এগিয়ে চলা।
আইসল্যান্ডের অমসৃণ ভূমিতে সমতল খেলার মাঠ বানানো ভীষণ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। কয়েক দশক আগেও এদেশে না ছিলো কোনো ফুটবল স্টেডিয়াম, না ছিলো অনুশীলনের কোনো উপযুক্ত স্থান।
সবকিছু মিলিয়ে সাফল্য পাওয়াটা ছিলো খুব কঠিন। তাই রাতারাতি সাফল্য আসেনি। অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক বছর।
অবশেষে ২০০০ সালে দেশটির জনগণ তাদের নিজেদের অর্থায়নে রাজধানী রিকইয়াভিকে একটি ট্রেনিং গ্রাউন্ড নির্মাণের ব্যবস্থা করে। যেটিকে বলা হয় একাডেমী। এটি ফুটবলের প্রধান অবকাঠামো। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে উন্নত মাঠ।
আইসল্যান্ডে ফুটবল খেলা হয় মোট ১১টি কেন্দ্রে, যেখানে বিশেষভাবে তাপানুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। বছরের নয় মাস বরফে ঢাকা থাকায় সে সময়টাতে তারা ছাদঘেরা কেন্দ্রগুলোতে ফুটবল খেলে। এসবেরও অর্থায়ন করে থাকে জনগণ। এমনকি জাতীয় স্টেডিয়ামের আধুনিকায়নও করা হয়েছে সাধারণ জনগণের অর্থায়নে।
আইসল্যান্ড দলটা একটা ক্লাবের মতো। দেশটিতে কিছুদিন আগেও ছিলোনা কোনো পেশাদার ক্লাব। এখানকার একাডেমীতেই তৈরি হত সব খেলোয়াড়। তাই সবাই একসঙ্গে বেড়ে ওঠায় তাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা দারুণ।
কোচদের জন্যও আছে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। দেশটিতে উয়েফা লাইসেন্সধারী কোচের সংখ্যাও প্রায় ৬০০! তাদের মধ্যে উয়েফা এ লাইসেন্সধারী প্রায় ত্রিশ শতাংশ, বাকিরা সবাই বি লাইসেন্সধারী।
সবকিছুই করা হয়েছিলো। এখন শুধু সাফল্য আসার পালা। অবশেষে সাফল্য এলো, অবসান হলো বরফদ্বীপবাসীদের সকল অপেক্ষার।
২০১৪ বিশ্বকাপে খেলার অনেকটা কাছে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু প্লে-অফে ক্রোয়েশিয়া কে টপকাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয় সেবার।
অবশেষে ২০১৬ সালে আর তাদের আটকে রাখতে পারেনি কোনো বাধা। বাছাইপর্বে শক্তিশালী নেদারল্যান্ডস কে হটিয়ে জায়গা করে নেয় উয়েফা ইউরোতে। বাকি গল্পটা তো সবারই জানা। প্রথমবারেই বাজিমাত। গ্রুপ পর্বেই হারায় পর্তুগাল কে, যারা কিনা পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো। অতঃপর রাউন্ড অব সিক্সটিনে হারায় আরেক জায়ান্ট ইংল্যান্ড কে, যাদের ফুটবল কে আদর্শ ধরেই আইসল্যান্ডের এ পর্যন্ত আসা। অবশেষে কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক ফ্রান্সের কাছে পরাজিত হয়ে সেবারের মতো বিদায় নিতে হয়।
কিন্তু তারা ততদিনে জয় করতে শিখে গেছে। এবার তাদের ঠেকায় কে? এরপর পৃথিবীর সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে জায়গা করে নেয় ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে। শুধু জায়গা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেখানে আটকিয়ে দিয়েছে শিরোপার অন্যতম দাবীদার লিও মেসির আর্জেন্টিনা কে।
২০১২ তেও র্যাঙ্কিং এ আইসল্যান্ডের অবস্থান ছিলো ১৩০ এর ওপরে। সেখান থেকে ২০১৮ তে তারা উঠে আসে ১৮ তে। এটাকে কঠোর সাধনা ছাড়া আর কি বলা যায়!
তাদের জনসংখ্যা মাত্র তিন লক্ষ। তাই ফুটবলার পাওয়াটাই তো দুষ্কর। একবার গ্যারি লিনেকার মজা করে বলেছিলেন, 'আইসল্যান্ডে অত ফুটবলারই নেই, যতগুলো আগ্নেয়গিরি আছে।'
দেশটিতে সব মিলিয়ে নিবন্ধিত খেলোয়াড় আছে প্রায় বাইশ হাজার। তবে তাদের প্রায় কেউই পেশাদার না, এমনকি জাতীয় দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় অপেশাদার। কিন্তু তাদের মধ্যে দৃঢ় মনোবল আছে, আছে আত্মপ্রত্যয়। আছে দেশের জন্য কিছু করে দেখানোর তাড়না। এটি তাদের সকল বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়।
খণ্ডকালীন ফুটবল খেললেও জীবিকার জন্য প্রায় সবাই নির্ভর করেন অন্য পেশার ওপর। তাদের গোলকিপার হ্যানেস হ্যালডোরাসন মূলত একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। আবার সাবেক কোচ হেইমার হালগ্রিমসন পেশাগতভাবে ছিলেন দন্তচিকিৎসক। ক্লিনিক থেকে ছুটি নিয়ে ইউরো তে দলকে ফ্রান্সে নিয়ে এসেছিলেন।
এখন অনেকটাই পরিপক্ব হয়ে উঠেছে দল। সময় এসেছে আরেকটি ইউরোর। এইটাতেও খেলার সম্ভাবনা বেশ প্রবল। কিছুদিন পর প্লে অফ। তার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে তারা থাকছে নাকি না।
সম্প্রতি আইসল্যান্ডের ফুটবলের উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। লিগ এবং ক্লাব সুগঠিত করা হয়েছে। এখন দেশটিতে পাঁচটি স্তরে লিগ অনুষ্ঠিত হয়। সবমিলিয়ে ছোট বড় ৭৯ টি ক্লাব রয়েছে সেখানে।
শুধু ছেলেদের নয়, মেয়েদের ফুটবল নিয়েও কাজ করছে আইসল্যান্ড। তাদের বেশ শক্তিশালী একটা নারী দলও আছে। যদিও তারা এখনও বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি। কিন্তু তারা ইতিমধ্যে তিনটি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে ফেলেছে। এর মধ্যে ১৯৯৫ ও ২০১৩ সালে তারা কোয়ার্টার ফাইনালও খেলেছে।
সবশেষে আইসল্যান্ডের আরেকটি বিশেষ দিকের কথা বলে শেষ করি। সেটি হলো তাদের উদযাপন। গত ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে ইংলিশদের বিদায় করে মাথার ওপর দুই হাত তুলে ছন্দে ছন্দে তালি বাজিয়ে এক অদ্ভুত উদযাপন করে তাদের খেলোয়াড় ও দর্শকরা। বিশ্বজুড়ে যেটি পরিচিতি পেয়ে গেছে "ভাইকিং ক্ল্যাপস" নামে। এখনো ২০১৬ ইউরোর যদি বিশেষ কিছু মুহুর্তের কথা ভাবা হয়, তাহলে প্রথমেই মনে ভেসে ওঠে সেই ভয়ংকর সুন্দর ভাইকিং ক্ল্যাপস এর কথা।
আরো এগিয়ে যাক আইসল্যান্ড, চলতে থাকুক তাদের অগ্রযাত্রা। বিশ্বমঞ্চে আবারও ফিরে আসুক তারা। মনে শিহরণ জাগানো ভাইকিং ক্ল্যাপস যে বিশ্ববাসী আবার দেখতে চায়, দেখতে চায় বারবার।