• ফুটবল

ডার টাইটানের উপকথা

পোস্টটি ৩১৫৪ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ফুটবল খেলায় দলের বাকি দশ জনের চেয়ে একজন প্রায় পুরোপুরি আলাদা। তার পরিসর ক্ষুদ্র, এমনকি পোশাকও আলাদা। তার কাজটি খুব বেশি কিছু নয়, কিন্তু অনন্য। পুরো দল যখন মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়, তখন অতন্দ্র প্রহরীর মতো তীক্ষ্ণ ভাবে দৃষ্টি রাখেন বলের দিকে। যখনই আসবে বল, তাকে সেটা আটকাতে হবে। তার দক্ষতার ওপর নির্ভর করে ম্যাচের ফলাফলের অনেকটাই।

গোলরক্ষকের কাজ টাই আসলে এমন। তাকে হতে হয় আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী এবং স্বনির্ভর। তড়িৎ সঠিক সিদ্ধান্ত, মুহুর্তে ঝাপিয়ে পড়ার মতো বিশেষ কিছু গুণ থাকতে হয় তার। আর সবকিছুর সমন্বয়েই তিনি হতে পারেন সফল।

এই কাজ টাকে কেউ কেউ নিয়ে গেছেন শিল্পের পর্যায়ে। তাদের কথা বললে প্রথমেই আসে ব্ল্যাক স্পাইডার লেভ ইয়াসিনের নাম, প্রায় সন্দেহাতীত ভাবে সর্বকালের সেরা গোলকিপার। তাছাড়া হালের জিয়ানলুইজি বুফন, ইকার ক্যাসিয়াস বা ম্যানুয়েল নয়্যার; সফলতা এসে ধরা দিয়েছে তাদের কাছে।

তবে একটা জায়গায় অলিভার কান অনন্য। এখন অবধি একমাত্র গোলকিপার হিসেবে জিতেছেন বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল।

তার পুরো নাম অলিভার রল্ফ কান। জন্মেছিলেন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির ছোট্ট শহর কার্লস্রুহে তে। ফুটবলের হাতে খড়ি শৈশবেই, বাবার কাছে। বাবা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত খেলেছিলেন শহরের ক্লাব কার্লস্রুহের এসসির হয়ে, তাই বাবার ক্লাবেই ফুটবলের প্রাথমিক জ্ঞান নিতে শুরু করেন অলিভার, সেটাও মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই!

শুরুর দিকে আউটফিল্ডেই খেলতেন। দলের মূল স্কোয়াডে জায়গা পান ১৯৮৭-৮৮ সিজনে, দলের সেকেন্ড গোলকিপার হিসেবে। অবশেষে গ্লাভস হাতে প্রথম মাঠে নামেন ১৯৮৭ সালের ২৭ নভেম্বর। কিন্তু দলের মূল গোলরক্ষক হয়ে উঠতে পারেননি তখনও। অপেক্ষা করতে হয় আরও। ততদিনে পরিশ্রম ও অনুশীলনে নিজেকে শানিত করতে থাকেন।

অবশেষে ১৯৯০ সালের দিকে এসে দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে গড়ে তোলেন নিজেকে। ১৯৯৪ সালে উয়েফা কাপের সেমি ফাইনালে উঠে গিয়েছিলো কার্লস্রুহের, আর সেটাতে অন্যতম ভূমিকা ছিলো কানের। সে মৌসুমে বুন্দেসলিগার বর্ষসেরা গোলকিপার নির্বাচিত হন।

image_search_1582899766917

সেবার কানের পারফর্মেন্স নজর কেড়েছিলো সবার। নজর এড়ায়নি জার্মানির সবচেয়ে বড় দল বায়ার্ন মিউনিখেরও। তাই দেরী না করে সেবারই গোলকিপারের জন্য তৎকালীন রেকর্ড ২.৪ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে দলে ভিড়িয়ে নেয় তারা।

সেই থেকে শুরু হলো বায়ার্নের জার্সিতে তার পথচলা। ক্যারিয়ারের শেষ দিন পর্যন্ত এ জার্সি পরেই মাঠ মাতিয়েছেন তিনি, গড়েছেন অসংখ্য রেকর্ড, সোনালি হরফে জায়গা করে নিয়েছেন ফুটবল ইতিহাসের পাতায়।

বায়ার্নে ফার্স্ট চয়েজ গোলকিপার হিসেবেই স্কোয়াডে জায়গা করে নেন কান। কিন্তু ইঞ্জুরির কারণে প্রায় ছয়মাসের জন্য মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়। ইঞ্জুরি থেকে ফেরার দুইমাস পরই জার্মান জাতীয় দলে তার অভিষেক ঘটে।

একবছর আগে কার্লস্রুহেরের হয়ে যে টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল থেকে ঘুরে আসতে হয়েছিলো, ১৯৯৬ এ বায়ার্নের হয়ে জেতেন সেই উয়েফা কাপ। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে জেতেন জার্মান কাপ, সাথে আবারও নির্বাচিত হন লিগের বর্ষসেরা কিপার।

১৯৯৯ এ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে নিয়ে যান দলকে। কিন্তু শুরুতে এক গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরও সে ম্যাচে ক্যাম্প ন্যু থেকে শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে হেরে ফিরে আসতে হয় ব্যাভারিয়ানদের। তবে তার পারফর্মেন্সের পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি, আইএফএফএইচএস কর্তৃক ওয়ার্ল্ড গোলকিপার অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন কান।

GettyImages-81128507

অবশেষে ২০০০-০১ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়া কে হারিয়ে আরাধ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা হাতে তোলেন। ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচও নির্বাচিত হন কান। ১-১ সমতায় খেলা শেষ হলে টাইব্রেকারে তিন টি দারুণ সেভ করেন। ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ডও জেতেন তিনি। সেবার বোকা জুনিয়র্স কে হারিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও ঘরে তোলে বায়ার্ন মিউনিখ।

অতঃপর ২০০২-০৩ সিজনে এসে আর্থিক, ব্যক্তিগত ও ইঞ্জুরি সহ বেশ কিছু সমস্যার মধ্যে পড়েন তিনি। প্রভাব পড়ে পারফর্মেন্সেও। পরের মৌসুমে ইউসিএলে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সহজ শট মিস করেন, বাদ পড়ে যায় বায়ার্ন।

পরবর্তীতে আবারও ফর্মে ফেরেন। কিন্তু ততদিনে বয়সও হয়ে গেছে বেশ। অতঃপর ২০০৭-০৮ মৌসুমেই রিটায়ার্ডের ঘোষণা দেন। অবশেষে ২০০৮ সালের ১৭ই মে শেষবারের মতো বুন্দেসলিগায় হার্থা বার্লিনের বিপক্ষে মাঠে নামেন, যেটি ছিলো লিগে তার ৫৫৭তম ম্যাচ।

বায়ার্নের জার্সিতে তার শেষ ম্যাচ ছিলো সেবছরের ২৭ মে, কোলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে, মোহনবাগানের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ। সেটিতে ০-৩ গোলে জয় পায় কানের দল।

এবার আসি জাতীয় দলের প্রসঙ্গে। জার্মান দলে প্রথম ডাক পান ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে, ব্যাকাপ হিসেবে। তবে অভিষেক হয় ১৯৯৫ এ, সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৯৬ এ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিনশিপ জয়ী জার্মান দলের স্কোয়াডেও ছিলেন কান।

১৯৯৮ বিশ্বকাপও বেঞ্চেই কাটাতে হয়। অতঃপর দলের মূল কিপার আন্দ্রেস কোপকে অবসর নিলে কান হয়ে যান ফার্স্ট চয়েস কিপার।

২০০১ এ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে পারফর্ম করেন কান। যে ম্যাচ জার্মানির জেতার কথা, সে ম্যাচ তারা হেরে বসে ৫-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে। কিন্তু বছর টা খারাপ কাটেনি। সেবার দ্বিতীয়বারের মত আইএফএফএইচএস কর্তৃক বর্ষসেরা গোলকিপার নির্বাচিত হন কান।

image_search_1582899735341

২০০২ বিশ্বকাপ ছিলো কানের বিশ্বকাপ। সেবার জার্মান দলটা মোটামুটি দুর্বলই ছিলো বলা যায়। কিন্তু কানের নেতৃত্বে এবং কানে ভর করে ফাইনালে পৌঁছে যায় তারা। ফাইনালের আগে পর্যন্ত পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র এক গোল হজম করেন কান। অবশেষে হাতের ইঞ্জুরি নিয়ে ফাইনালে খেলতে নামেন তিনি। কিন্তু রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহোর সেই ব্রাজিলের সাথে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠেননি আর। রানার্সআপ হয় জার্মানি। টুর্নামেন্টের বেস্ট গোলকিপার হিসেবে লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড জেতেন কান। সেই সাথে ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র গোলকিপার হিসেবে সেবারই জেতেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার গোল্ডেন বল।

২০০৪ ইউরোতে জার্মানি গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে যায়। হতাশায় কান ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেন। অতঃপর ২০০৬ এ এসে নতুন কোচ ক্লিন্সম্যানের অধীনে হারান ফার্স্ট চয়েস গোলকিপারের জায়গা টাও। লেহম্যান হন ফার্স্ট কিপার, কানের জায়গা হয় বেঞ্চে। অবশেষে ২০০৬ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে সেমি ফাইনালে বাদ পড়ার পর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে শেষ বারের মতো জার্মানির জার্সিতে মাঠে নামেন কান। নিয়মিত অধিনায়ক মাইকেল বালাকের অনুপস্থিতিতে অধিনায়ক আর্মব্যান্ডও আরও একবার হাতে পড়েছিলেন। দুর্দান্ত কিছু সেভ করেন সেদিনও। অবশেষে পর্তুগালের বিপক্ষে সে ম্যাচে ৩-১ গোলে জয় পায় স্বাগতিক জার্মানি। সে ম্যাচ শেষে ঘোষণা দেন অবসরের।

ক্যারিয়ারে জিতেছেন অনেক কিছুই। ব্যাভারিয়ানদের হয়ে জিতেছেন আটটি বুন্দেসলিগা, ছয়টি পোকাল কাপ ও পাঁচটি লিগাপোকাল কাপ। জিতেছেন উয়েফা কাপ, ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ ও বহু আরাধ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ। জার্মানির জার্সিতে জিতেছেন ইউরো, তবে একটুর জন্য ছুঁয়ে দেখা হয়নি বিশ্বকাপ।

2573334_w1

সাতবার বুন্দেসলিগা বেস্ট কিপার, তিনবার আইএফএফএইচএস বেস্ট গোলকিপার, চারবার বেস্ট ইউরোপিয়ান গোলকিপার, দুইবার জার্মান ফুটবলার অব দ্য ইয়ার, ওয়ার্ল্ড কাপে গোল্ডেন বল, ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড সহ অসংখ্য ব্যক্তিগত সম্মাননা তুলেছেন হাতে, এক কথায় বিশ্বকাপ ছাড়া জিতেছেন সবকিছুই।

জার্মান এবং বিশ্ব ফুটবলে ছিলেন এক নক্ষত্র, ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা কিপার। তবে তুলনামূলক ভাবে তাকে এখনো অবমূল্যায়িতই বলা যায়। মূল্যায়ন পরে, তিনি যেসব কীর্তি রেখে গেছেন, আর কি চাই। ফুটবল ফ্যানদের কাছে অলিভার কান শুধু একটা নাম নয়, একটা আবেগ।

We miss you "Der Titan", you are our Vol-Kahn-o forever...