• ক্রিকেট

যখন নামিবে আঁধার...

পোস্টটি ২৭৫৭ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
২০৪৪ সাল।
 
কাঁচাপাকা গোঁফ- দাঁড়ি চুলে অসম্ভব বেমানান লাগছে তাকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে টিভি সেটের সামনে বসে আছেন। খেলা চলছে৷ লাল- সবুজের দেশটা ক্রিকেটে কত পরিণত হয়েছে আজ- ভেবে ভেবে মানুষটা অবাক হয়ে যান।
 
মানুষটার বয়স ৬০ পেরিয়েছে। হাটেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বয়সের ভারে শরীরের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। তবু হৃদয়ে ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমে নি।
 
স্মরণ করতে চেষ্টা করেন পুরনো দিনগুলোর কথা। একটা সময় তিনি যখন বল হাতে দৌড়াতেন, মিরপুর কেঁপে উঠতো তার নামের স্লোগানে। ভালোবেসে মানুষ তাকে নাম দিয়েছিলো 'নড়াইল এক্সপ্রেস।' তাকে ঘিরে উন্মাদনার চূড়ান্ত ছিলো দর্শকদের মাঝে। একটু একটু করে কিভাবে যেন ১৬ কোটি মানুষের নেতায় পরিণত হয়ে গেলেন, ভেবে আজও অবাক হয়ে যান তিনি।
 
মনে পড়ে দেশের জার্সিটা গায়ে দিয়ে তার সকল পাগলামির কথা। একবার দু'বার নয়, গুনে গুনে ৭ বার সার্জারি করতে হলো পায়ে। ডাক্তারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ রেখা, খেলা ছেড়ে কৌশিক নামের প্রানবন্ত ছেলেটা বাঁচবে কি করে৷ তিনি বুকে ব্যাথা চেপে মুখে হাসি টেনে তারবার তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন। ডাক্তাররা সার্জারি করে পা ঠিক করতে পারেন ঠিক; কিন্তু পা হারানোর ভয় দেখিয়ে তো আর ক্রিকেট বিমুখ করতে পারেন না তাকে। তিনি ভাবেন, হায়! বোকা ডাক্তারেরা..
 
একটা সময় ছিলো, যখন বাংলাদেশ যেকোনো পরাশক্তির সাথে খেলছে। দর্শকরা জানে, তারা নিশ্চিত হারবে। তবু তাদেরকে সমর্থন দেয়ার বেলায় কার্পণ্য নেই একটুকুও। সে যখন ওভারের প্রথম বল করতে আসতো, গোটা স্টেডিয়াম হুংকার দিতো গর্জনে! আর উইকেট পেলে তো কথাই নেই; বাঘের গর্জন নেমে পড়তো মাঠে।
 
দেখতে দেখতে দিন কেটে যায়। মানুষটা দিনদিন এদেশের ক্রিকেটের সাথে মিশে যান ভক্তদের মণিকোঠায়। ক্রিকেটের যখন ক্রান্তিলগ্ন, তিনি দায়িত্ব নিলেন কাঁধে৷ শক্ত হাতে পার করতে থাকলেন কঠিন সময়। আশ্চর্যজনক ভাবে সে সময়টাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের 'সোনালী দিন' হিসেবে স্থান করে নিলো ইতিহাসের পাতায়!
 
রেকর্ডের ঝুলিতে নেই কোনো বিশ্বকাপ৷ কিন্তু বিশ্বকাপের মঞ্চে তার সরব উপস্থিতি বারবার উজ্জীবিত করেছে প্লেয়ারদের তা অকপটে স্বীকার করবে যে কেউ। সিনিয়র প্লেয়ার হিসেবে হোক, কাপ্তান হিসেবে হোক- দলের ভিতরে কিংবা বাইরে; তার কথা অবাধ্য হয়েছে কেউ এ কথা আমার জানা নেই। একজন যোগ্য নেতার মতোই দলের প্রয়োজনে ভয়ংকর হয়েছেন, বারুদ বানিয়েছেন অন্যেদের৷ কখনোও চুপ থেকেছেন। খারাপ সময় পার করে আবার হুংকারে জানান দিয়েছেন তার আপন মহিমা।
 
মনে পড়ে ক্রিকেটার থেকে এমপি হওয়ার দিনগুলো। দেশের ক্রিকেটে তখন আশঙ্কা! বিভেদ রেখায় বিভক্ত তার ভক্ত'রা। অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি রাজনীতিতে তার পথচলা; অনেকেই আবার শুভকামনা জানিয়েছেন আগামির পথচলায়। অনেকে তো আবার খারাপ সময়ে তার 'ক্ষমতা'র অপব্যবহার বলে সরব হলেন। সিচ্যুয়েশনটা কিভাবে হ্যান্ডেল করলেন তা কেবল তিনিই জানেন। তবে এতটুক মনে আছে, রাজনীতিতে যোগ দিলেও ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা শিশিরকণা পরিমান কমেনি তখন।
 
অধিনায়কের কোটায় খেলেন- এমন অ্যাখ্যা তিনি শুনেছেন বহুবার। পাগল, পায়ে ৭ বার অস্ত্রোপচার করা মানুষটার কাছে তোমরা এখনো ১৪০ কি.মি স্পিডের বল আশা করো? নাকি তার নেতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ ছিলো তোমাদের? কিংবা তার খাতিরের প্লেয়ারদের ডেকে ডেকে জাতীয় দলের ক্যাপ পরিয়েছেন- এমন কিছু? কফির উষ্ণ কাপে চুমু দিতে দিতে ভাবেন তিনি।
 
আর্মব্যান্ড পরে শেষ ম্যাচটার কথা তিনি ভুলতে পারেন নি এতো সহজে! ম্যাচ শেষে যখন প্রত্যেকটা প্লেয়ারের গায়ে ছিলো তার ট্রেডমার্ক ২ নাম্বার জার্সি- গর্বে বুক ফেটে যাচ্ছিলো তার। প্লেয়াররা কাঁধে তুলে তাকে পুরো মাঠে দৌড়িয়েছে, এতোদিন যাদেরকে তিনি হাসিঠাট্টায়, কড়া মন-মেজাজে কিংবা বুদ্ধিদীপ্ত রণকৌশলে মাতিয়ে রেখেছিলেন- তিনি আজ তাদের কাঁধে। বিদায় জানানোর এতো আয়োজন! পাগলেরা জানেনা, এটাই শেষ নয়৷ আমাকে কিভাবে তোমরা ক্রিকেট থেকে বিদায় জানাতে পারো?
 
বাংলাদেশ আজ ক্রিকেটে ত্রাস করছে। বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়েছিলেন স্টেডিয়ামে। অনেকটা নির্জনে, সহধর্মিণী আর সন্তানদের নিয়ে। তারা বারবার বলছিলো- বাবা বাবা, এই দেখো কে একজন প্লেকার্ড নিয়ে এসেছে। তাতে লিখেছে 'মাশরাফি, আপনি হারিয়ে যাননি আমাদের হৃদয় থেকে'! মাশরাফি হাসেন। পাগল ছেলেরা কি সব কান্ডকারখানা করে বসে। মিডিয়ার চোখে পড়তে দেরি হয়না তার। বায়না ধরে তারা, কিছু একটা তো বলতেই হবে। কাঁপা কাঁপা গলায় মাশরাফিও কিছু একটা বলেন। অস্পষ্ট হলেও বুঝতে অসুবিধা হয়না, মাশরাফি বলছেন-
 
'বাংলাদেশ, আমি তোমাদের ভালোবাসি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সোনালী অধ্যায় বারবার ফিরে আসুক তরুণদের মাঝে।'
 
ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি৷ কফির মগটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আশ্চর্য! এই সময়ে বাংলাদেশের হয়ে হ্যাট্টিক করে ফেললো কে...