ফুটবল দিয়েছে প্রান, ফুটবল নিয়েছে প্রান...
পোস্টটি ২০৩৫ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
কিশোর বয়স পেরিয়ে পরিনত বয়সে ফুটবলার হওয়ার পিছনের গল্পগুলো সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ হয়ে থাকে। প্যারাডাইজ লস্টের কবি জন মিল্টনের একটা উক্তি বাল্যকালের শ্রেষ্ঠ পরিচায়ক হতে পারে৷ মিল্টন সাহেব যা বলেছিলেন তার সহজ বাংলা- 'ভোর যেমন একটা দিন কেমন হবে তার পূর্বাভাস দেয়, ঠিক তেমনি বাল্যকাল একটা মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়।' মহাকবির কথা থাক, আমরা বরং ফুটবলারদের বাল্যকাল থেকে ঘুরে আসি।
দরিদ্র পীড়িত সেনেগালের বাম্বালি; অজপাড়াগাঁয়ের সাইদ পরিবর্তীকালে ইংলিশ জায়ান্ট লিভারপুলের জার্সি গায়ে জড়াবে, পাশাপাশি দেশের হয়ে বিশ্বমঞ্চে শিরোপা জিতবে- এমনটা বোধহয় কেউ কল্পনাও করেনি৷ বলতে ভুলে গেছি, কিশোর সাইদ কিন্তু পরিনত হয়েছে 'সাদিও মানে' হিসেবে। তার কথা থাক। কিশোর নেইমারের কথা বলি। সারাক্ষণ বল নিয়ে ছোটাছুটি করতো। রাস্তাঘাট কি বাজার; সর্বত্র একটা বল আছে পায়ে। আপন মনে ড্রিবল করে বেড়াচ্ছে। সময় সুযোগ পেলে ফুটবল ম্যাচ খেলছে। পরবর্তীতে সে কোন পজিশনে পৌঁছাতে পেরেছে তা সবাই জানে। জর্জ বেস্টের কথা বলা যাক; আইরিশ এই ফুটবল বেস্টের জীবন সর্বত্রই সাদামাটা ছিলো। কিশোর বয়সে ফুটবলের পোকা ছিলেন। পরবর্তীতে নামের সাথে 'কখনোও বিশ্বকাপ না খেলা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার' ট্যাগ লাগিয়েছেন। স্যামুয়েল এতো'র কথা বলা যেতে পারে, কিংবা দিদিয়ের দ্রগবা, জর্জ উইয়াহ'র কথা। ড্রাগের শহর ম্যাদেইনে এস্কোবারের বেড়ে উঠা কিংবা শরনার্থী হয়ে দেশান্তরি হওয়া পগবা'দের মতো তারকার কথা বলা যেতে পারে।
বলা যেতে পারে তাদের মতোই সহস্র সংগ্রাম করে বিশ্ব জয় করা শতশত ফুটবলারের কথা, যাদের বাল্যকাল কেটেছে দুর্বিষহ কষ্টে।
অবশ্য ব্যাতিক্রমও আছে। কাকার ব্যাপারটা পুরো উল্টো৷ ইঞ্জিনিয়ার বাবা'র আদরের পুত্র বাবার পথেই হাটতেন হয়তো। একবার পরীক্ষায় ১০০ তে ৯৭ পেয়ে তার সেকি কান্না! কেন সে ৩ মার্ক কম পাবে? বাল্যকালে তার প্রিয় খেলা ছিলো ফুটবল এবং টেনিস। দুটোতেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো বলে ক্যারিয়ার হিসেবে কোনটি বেছে নিবে সে প্রশ্ন উঠেছিলো; ভাগ্যিস! কাকা ফুটবলটাই বেছে নিয়েছিলেন। এন্থোনিও গ্রীজম্যান, আন্দ্রেয়া পিরলো, পিকে, গোৎজে- কিংবা ভ্যান পার্সি- বলকিয়া'রাও আছেন কাকার মতো ব্যতিক্রমের লিস্টে, এবং অনেকেই!
দরিদ্র কিংবা ধনাঢ্য পরিবারের বালকদের নিয়ে এই লেখা মোটেই নয়; লেখার মূল বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। বলছিলাম বালক থেকে পরিনত ফুটবলার পিছনের গল্পগুলো অসাধারণ হয়। সেসব গল্পে কষ্ট থাকে, আবেগময় অনুরাগ থাকে; স্বপ্ন দেখার উপজীব্য বিষয় থাকে৷ থাকে রোমাঞ্চ। তবে সেসব গল্পে মুখ্য যে বিষয় থাকে, তা হচ্ছে বড় মানের ফুটবলার হওয়ার তৃপ্ত বাসনা। ফুটবলকে তারা ভালোবেসে নিয়েছে ছোটবেলাতেই। অন্তরে বেঁধেছে দৃপ্ততায়। কারণ, ফুটবল তাদের দিয়েছে প্রাণ…
ফুটবলের সাথে তাদের সখ্যতা সেই বাল্যকাল থেকেই। প্রাণের প্রিয় এই জিনিসটা থেকে লুকিয়ে থাকার কোনো পথ নেই। নিতান্ত অভাগা না হলে বাল্যকালে কিশোরেরা ঘরে বন্দি থাকে না, তারা থাকে বিস্তৃত খেলার মাঠে। প্রানে প্রান মেলানোর কি সুন্দর ব্যবস্থা করেছে প্রকৃতি; তারা ভাবে৷ তবে এই প্রকৃতি মাঝেমাঝে নিষ্টুরও বনে যায়। ফুটবলে প্রান দিয়ে, সেই প্রান-ই ফুটবলে নিয়ে নেয়! কি অদ্ভুত।
ফুটবল মাঠে সর্বপ্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮৮৯ সালে। ১৩ জানুয়ারির এক বিকেল। স্টেভেলি'র সাথে ম্যাচ খেলছে গ্রীমসবি টাউন। খেলছেন ২৬ বছর বয়েসী উইলিয়াম ক্রোপার। ম্যাচের সময় যখন ৭২ মিনিট, হঠাৎ-ই মাঠিতে লুঠিয়ে পড়লেন ক্রোপার। হার্ট এট্যাক। নিঃস্তব্ধতা গ্রাস করলো পুরো মাঠে। ক্রোপার'কে সরিয়ে নেয়া হলো সেখান থেকে। তবে ভুলে যেতে হলো আজীবনের জন্য। ক্রোপার মৃত্যুবরণ করলেন পরদিন৷
সে-থেকে শুরু। ফুটবল মাঠ এর আগে কারো প্রাণ কেড়ে নেয়নি। ১৯০০ সালের আগ পর্যন্ত কেবল ইংল্যান্ড আর স্কটল্যন্ডের ৮ ফুটবলার প্রান দিলেন ফুটবল মাঠে! ভাবা যায়? ১৮৯৬ সালে জেমস লোগানের মৃত্যু ঘটে নিউমোনিয়াজনিত কারণে, ফুটবল খেলতে খেলতে। সে বছর-ই 'জো পাওয়েল' মারা যান ক্যাটেরিং টাউনের বিপক্ষে বাহু ভেঙ্গে যাওয়ার পর প্রচুর রক্তক্ষরণে। তবে সবচেয়ে বেদনাদায়ক মৃত্যু হয় টেডি স্মিথের। ব্যাডমিনিস্টারের এই ফুটবলার ম্যাচ খেলছিলেন ইষ্টভ্যালি রোভার্সের বিপক্ষে 'গ্লুচেষ্টারশায়ার কাপ' এর সেমিফাইনালে। মাথায় একবার আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পরও খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন স্মিথ। তবে তাকে বাধ্যে করে নামিয়ে দেয়া হয়; এবং পরদিন সকালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি৷
উনবিংশ শতাব্দীতে ফুটবল মাঠে মৃত্যুবরণ করা ফুটবলারের নাম জেমস কলিন্স। কলিন্সের পরে পরবর্তী দুই দশকে আরোও ৭ ফুটবলার মৃত্যুবরণ করেন ফুটবল মাঠে। ১৯০৭ সালে লিডস সিটির 'ডেভিড "সোলজার" উইলসন' মাত্র ২৩ বছর বয়সে মাঠেই ঢলে পড়েন মৃত্যুমুখে। তার নামের মাঝখানে 'সোলজার' দেখে অদ্ভুত লাগছে না? অদ্ভুত-ই বটে। নামটা তিনি কৈশোরেই কামিয়েছিলেন বীরত্বে! ইংলিশ বংশদ্ভূত এই ছেলে কৈশোরে ক্যামেরুনের ফাস্ট ওয়াচ ব্যাটেলিয়নে যোগ দেন। এমন সাহসীকতার স্বীকৃতিস্বরুপ তার নামের মাঝখানে 'সোলজার' বা যোদ্ধা লাগানো হয়৷ তবে ডেভিড সত্যিকারের যোদ্ধার পরিচয় দেন আফ্রিকান 'বয়ের যোদ্ধে' অংশগ্রহণ করে অক্ষত হয়ে ফিরে এসে৷ ছোট্ট জীবন। তাও কত রোমাঞ্চকর দেখুন! ২৩ বছর বয়েসী ডেভিড মারাত্মক ব্যাথা গোপন করে খেলতে নেমে যেতেন। ছিলেন অসম্ভব ধূমপায়ী। বার্নলির বিপক্ষে ম্যাচে হার্ট এট্যাক করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই যোদ্ধা!
শুধুমাত্র উনবিংশ শতাব্দী কেড়ে নেয় ৫৫ জন ফুটবলারের তাজা জীবন। যাদের রক্তে ছিলো ফুটবল, ফুটবল যাদের প্রান দিয়েছিলো। তাদের বেশিরভাগই মৃত্যুবরন করেছেন হার্ট এট্যাকে, অনেকেই টিটেনাসে আবার অনেকেই মাথায় মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে। শুধুমাত্র জার্মান ফুটবলার 'এক্সেল জুপ্টনার' এবং রোমানিয়ান মাইকেল ক্লাইন মৃত্যুবরণ করেন ট্রেইনিং গ্রাউন্ডে; বাকিদের বড় অংশই অনফিল্ডে৷ কয়েকজন অবশ্য ট্রিটমেন্ট চলাকালীন অবস্থায়। তবে দুঃখজনক মৃত্য ঘটে রোমানিয়ান ফুটবলার স্টিফান ভ্রাবাইরু'র। খেলা চলাকালীন অবস্থায় গোলবার তার মাথায় পড়লে মারাত্নক আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি এবং মাঠেই মৃত্যুবরণ করেন ২৬ বছর বয়েসী এই ফুটবলার।
বিংশ শতাব্দীতে মৃত্যুবরণকারী প্রথম ফুটবলার ১৮ বছর বয়সী ডেনিয়েল অরবিয়েনু। মাঠে আঘাত পেয়ে নেমে যাওয়ার পর ৪ টা হসপিটালে তার ডায়াগনস্টিক করানো হয়; কিন্তু ভাগ্যের লিখন, ৪ বারই ভুল চিকিৎসা দেয়া হয় তাকে। অতপর মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় তাকে। ডেনিয়েলের পর পুরো শতাব্দীতে ১০৬ জন ফুটবলারের মৃত্যু ঘটেছে। সর্বশেষ এই মার্চের ৮ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন নাইজেরিয়ান ফুটবলার 'সিনেমে মার্টিন্স'। মাত্র ২০ বছর বয়েসী এই ফুটবলার লীগ ম্যাচ চলাকালীন সময়ে মৃত্যু পথযাত্রীদের কাতারে শামিল হন। এ শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি বয়সে ফুটবল মাঠে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০০৩ সালে। মালেশিয়ায় একটি চ্যারিটি ম্যাচে অংশ নেয়া ৫৫ বছর বয়েসী 'আলি বাকার' হার্ট এট্যাকে আক্রান্ত হয়ে মাঠেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ০৭ নভেম্বর ২০১৯ সালে ব্রাজিল অনুর্ধ্ব-১৭ দলের ফুটবলার রেনান হ্যানরিক সান্তোস 'কার্ডিয়াক এরেস্ট' অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। এ শতাব্দীর সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ফুটবল মাঠে মৃত্যুবরণকারী'দের লিস্টে তার নাম থাকবে সর্বপ্রথমে।
মৃত্যুবরণকারী ফুটবলারদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন একদম নতুন, অখ্যাত। তবে ব্যাতিক্রমও ছিলেন কয়েকজন। যারা ফুটবল বিশ্ব চিনতো ভালোভাবেই। তাদেরই একজন মার্ক ভিভিয়ে ফো; ২৮ বছর বয়সী ক্যামেরুনীয় এই তারকা কনফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার সাথে খেলছিলেন। ৭২ মিনিটে মাঠিতে পড়ে গেলে মেডিক্যাল স্টাফরা দেখতে পায় তিনি হার্ট এট্যাক করেছেন। ৪৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে চেষ্টা চালিয়েও মার্কের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারেননি ডাক্তারেরা। অতপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয় তাকে। মার্ক ম্যানচেস্টার সিটি, ওলিম্পিক লিওনের মতো ক্লাবে খেলেছেন। স্পেনিশ ক্লাব এস্পানিওলের ক্যাপ্টেন 'ড্যানিয়েল জার্ক' তখন প্রি-সিজনে ক্লাবের সাথে ট্রেইনিং করছিলেন ইতালিতে। ট্রেইনিংয়েই কার্ডিয়াক এরেস্টে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর বছর দু'য়েক পূর্বে একইভাবে মারা যান সেভিয়ার ২২ বছর বয়েসী ডিফেন্ডার এন্থোনিও পাকুয়েতা। গতবছর প্রাণ হারান নিউক্যাসেলের ৩০ বছর বয়সী আইভরিকোস্ট তারকা চিয়েক টিওটি।
লেখাটি শেষ করতে চাই বিশ্বজুড়ে মহামারী আকার ধারণ করা কোভিড-১৯: করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ইউরোপের সর্বকনিষ্ঠ ব্যাক্তি, স্পেনিশ কোচ ফ্রান্সিসকো গার্সিয়াকে স্মরণ করে। এবং লেখাটি উৎসর্গ করতে চাই করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণকারী সোমালিয়ান কিংবদন্তি ফুটবলার 'আব্দুল কাদির মোহাম্মদ ফারাহ'কে। ফুটবল মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে, ফুটবলের কারণে প্রত্যাশিত কিংবা অপ্রত্যাশিত কোনো মৃত্যুই আমি চাই না। ফুটবল যাদের প্রান দিয়েছে, তাদের প্রান নিয়ে নিক তাও কামনা করিনা। ফুটবলারদের মৃত্যুতে ফুটবল যেন ম্লান- বর্ণহীন হয়ে যায় তাও চাই না। ফুটবল দীর্ঘজীবী হোক।
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য