• ক্রিকেট

রাহুল দ্রাবিড় - ক্রিকেট ব্যাকরণের এক একনিষ্ঠ ছাত্র

পোস্টটি ৩১২০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

'তাকে প্রথম পনেরো মিনিটের মধ্যে আউট করার চেষ্টা কর। সেটা যদি না পার, তাহলে বাকি উইকেটগুলো নেয়ার চেষ্টা কর।' - স্টিভ ওয়াহ।

'আপনি যদি তার সাথে মানিয়ে নিতে না পারেন, তার মানে আপনি জীবনের সাথে সংগ্রাম করছেন।' - ব্রেট লি।

স্যার ডন ব্রাডম্যান, শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিং, ব্রায়ান লারা - ক্রিকেটের সেরাদের সেরার তর্কে এই নামগুলো খুব সহজেই যে-কারো মাথায় চলে আসবে। কিছু নাম আড়ালে থেকে সেই সেরাদের সাথে প্রতিযোগিতায় থাকে। সবাই -কে সবসময় পাদপ্রদীপের আলোয় দেখা যায় না। আড়ালে -ই হয়তো সার্থকতা খুঁজে বেড়ায়! সেরকম -ই একটি নাম রাহুল শারদ দ্রাবিড়।

১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারি ভারতের মধ্য-প্রদেশে জন্ম হয় রাহুলের। ১১ জানুয়ারি সেদিন কেউ কি ভেবেছিল বাইশ গজে টেকনিকের নিখুঁত পসরা সাজিয়ে - কারো শৈশব কারো-বা কৈশোর রাঙ্গিয়ে ক্রিকেটের মহারথী হয়ে উঠবেন রাহুল? হয়তো ভেবেছিল; হয়তো নয়। তাতে কি - তিনি হয়ে উঠেন ক্রিকেটের নায়ক। ক্রিকেটের দ্য গ্রেট ওয়াল।

ক্রিকেটের তিন নাম্বার পজিশন -কে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কাজ -টাই তিনি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিন নাম্বার পজিশনে ভারতের সর্বকালের সেরা রাহুল দ্রাবিড়। স্কোরবোর্ডে কোনো রান যোগ হওয়ার আগেই সাজঘরে এক ওপেনার।এমন পরিস্থিতির মোকাবিলায় ১৮ বার তিন নাম্বার পজিশনে নেমেছেন রাহুল। আবার দলের রান এক অঙ্কের ঘর পার হওয়ার আগেই এক ওপেনারের বিদায় - দুর্গরক্ষার দায়িত্ব সামলাতে রাহুল নেমেছেন ৪৩ বার।

১৬৪ টেস্টে ৫২.৩১ অ্যাভারেজের সাথে ৩৬ টেস্ট সেঞ্চুরির পিঠে ৬৩ হাফসেঞ্চুরি। টেস্ট রান ১৩২৮৮!নিজের সাথে দেশ ছাড়িয়ে তিনি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। নিজেকে পরিচিত করেছিলেন ক্রিকেটের দ্য ওয়াল নামে। প্রতি রাতে বোলারের দুঃস্বপ্ন হয়ে একে একে খেলেছেন ৩১২৫৮ বল। যেটি টেস্ট ক্রিকেটে যেকোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ বল খেলার রেকর্ড।

টেকনিক আর টেম্পারমেন্টের নিখুঁত বিন্যাসে পিচে কাটিয়ে গেছেন ৪৪১৫২ মিনিট। যেটি পিচ নামক হিমালয়ে যেকোনো ব্যাটসম্যানের কাটানো সর্বোচ্চ সময়। আরেকটি অনন্য রেকর্ডের সাথে জড়িয়ে আছে রাহুলের নাম। টেস্ট ক্যারিয়ারে খেলা ২৮৬ ইনিংসে একবারের জন্যও শূন্য রানে আউট হন নাই দ্রাবিড়।

শুধু কি ব্যাটিং - রাজত্ব করে গেছেন স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে। তাকে মনে করা হয় সর্বকালের সেরা স্লিপ ফিল্ডার। এ মহিমায় টেস্টে রাহুলের ক্যাচ সংখ্যা ২১০ টি। যে সংখ্যাটি টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ক্যাচ নেওয়ার তালিকায় রাহুলের নামটা সবার উপরে তুলে দিয়েছে। 

টেস্ট ক্রিকেটে রাহুলের প্রথম এবং একমাত্র উইকেটটি পাকিস্তানের সাঈদ আনোয়ারের। টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ২৫ ম্যাচের মধ্যে জিতিয়েছেন ৮ টিতে। হারের যন্ত্রণা পেয়েছেন ৬ ম্যাচে, ড্র নিয়ে ফিরেছেন ১১ ম্যাচে।

ra4

কখনো-বা শচীন টেন্ডুলকার, কখনো-বা সৌরভ গাঙ্গুলি কখনো-বা ভিভিএস লক্ষ্মণের ছায়াতলে আটকা পড়ে পার্শ্বনায়ক হয়ে ছিলেন তবুও তিনি রাহুল দ্রাবিড় হয়ে উঠেছিলেন। ওভালের রাহুল দ্রাবিড়, অ্যাডিলেডের রাহুল দ্রাবিড়, লর্ডসের সবুজাভ পিচে অনবদ্য ১৪৮ এর রাহুল দ্রাবিড়।

রাওয়ালপিন্ডির রাহুল দ্রাবিড় - রাওয়ালপিন্ডির ভয়াবহ গরমে প্রায় ১২ ঘণ্টা ব্যাট করে করেন ২৭০ রান। ৪৯৫ বল খেলে ২৭০ রানের অতি-মানবীয় ইনিংস -টার রান পার করতে পারেনি পুরো পাকিস্তান দল মিলে। টেস্টের শেষে হিসাব কষে দেখা যায়, পাকিস্তান দুই ইনিংস মিলিয়ে ব্যাট করেছিল মাত্র ৯ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়। আর রাহুল দ্রাবিড় একা -ই ১২ ঘণ্টার বেশি ক্রিজে ছিলেন।

ইডেন গার্ডেনে ভিভিএস লক্ষ্মণের সঙ্গে বিখ্যাত পার্টনারশিপের রাহুল দ্রাবিড়। নিখুঁত কোন ইনিংস, পার্শ্বনায়ক, বিখ্যাত কোন পার্টনারশিপ রাহুলের বিচরণ ছিলো আগাগোড়া সবখানে।

টেস্ট ক্রিকেটে এতসব অর্জনে কিছুটা আড়ালে পড়ে যায় রাহুলের ওয়ানডে ক্যারিয়ার। কিন্তু সেখানেও তিনি অন্য অনেককে ছাড়িয়ে। ৩৪৪ ম্যাচে ১২ টি সেঞ্চুরি এবং ৮৩ টি হাফসেঞ্চুরির সাহায্যে ৩৯.১৬ গড়ে করেন ১০৮৮৯ রান। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তালিকায় রাহুল দ্রাবিড়ের অবস্থান দশ নম্বরে।

ফিল্ডার হিসেবে ১২৪ ক্যাচ নিয়ে ওয়ানডেতে সেরা দশে অবস্থান রাহুলের। সাথে যোগ করে নেন উইকেটরক্ষক হিসেবে আরো ৭২ টি ক্যাচ এবং ১৪ টি স্ট্যাম্পিংস। রাহুল দ্রাবিড় মানে যুদ্ধের ময়দানে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া কোন যোদ্ধা। যাকে আপনি যেকোনো লড়াইয়ে - যেকোনো মুহূর্তে সামনের কাতারে দেখতে পাবেন। ওয়ানডেতে উইকেট শিকার করেছেন ৪ টি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে দলকে ৭৯ টি ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়ে ৩৩ হারের বিপরীতে জয়ের ঠিকানায় পৌঁছিয়েছেন ৪২ টিতে।

রাহুল শিখিয়েছেন- স্টাম্পের বল ব্লক করো। বাইরের বলে ব্যাট না বাড়ানো। কোনও ঝুঁকি নয়, উইকেট মূল্যবান। আউট হওয়া যাবে না কিছুতে -ই। বোলারকে নিঙ্গড়ে শেষ করে দাও। একটু পরেই ধৈর্য হারিয়ে ভুল লাইনে বল ফেলবে। তারই ফায়দা তোল। চোখ সরবে না বল থেকে। বাইরের বল কী ভাবে ছেড়ে দিতে হয় সেই বিষয়ে যদি কোনও বই লেখা হয় রাহুল দ্রাবিড় থাকবেন সে বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে।

শুনেছিলাম সেনাপতিরা নাকি দু ধরনের হয়। একদল জিততে থাকেন - আরেকদলের কথা কারো মনে না পড়া -ই স্বাভাবিক। রাহুল ছিলেন দ্বিতীয় দলের মানুষ!

ক্রিকেটের জেন্টেলম্যান রাহুল দ্রাবিড়। তরুণ ক্রিকেটারদের পথপ্রদর্শক রাহুল দ্রাবিড়। ভারতীয় ক্রিকেটে যখন বিরাট কোহলি যুগের আর্বিভাব ঘটছে। কোহলির সেই আগ্রাসন, মাঠে প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়ার মানসিকতা। আগ্রাসী মনোভাব দিয়ে নিজের সেরাটা বের করে আনার যে যুগ বিরাটকে দিয়ে শুরু হয়েছিল।

ভারতের তরুণ ক্রিকেটাররা হুবহু বিরাটকে সেভাবে অনুসরণ করতে লাগলেন। তার আগ্রাসন তার দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার মানসিকতা। সে সময়টাতে ভারতের তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করার সুবাদে সেসব খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয় রাহুল দ্রাবিড়ের। তখন এক সেমিনারে রাহুল তাই ভারতের তরুণ খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্য বলেন -

"সবারক্ষেত্রে সবকিছু একই রকম হয় না। সবার সেরাটাও একই আঙ্গিকে বেরিয়ে আসে না। তোমরা বিরাটের মানসিকতা নয় বরং তার খেলাটাকে অনুসরণ করো"।

ra3

শেষ করবো ক্যারিয়ারের বিদায়বেলায় রাহুল দ্রাবিড়ের একটা উক্তি দিয়ে -

"ক্রিকেটের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি যুক্তিসঙ্গতভাবে সহজ ছিল: এটি ছিল দলকে সবকিছু দেওয়ার, এটি ছিল মর্যাদার সাথে খেলার, এবং এটি ছিল খেলার চেতনা সমুন্নত রাখার বিষয়ে। আমি আশা করি আমি এর কিছু করতে পেরেছি"।