আশরাফুল কাব্যের প্রতিচ্ছবিতে প্রথম আফ্রিকা বধ
পোস্টটি ৩২৯৯ বার পঠিত হয়েছেঠিক চৌদ্দ বছর আগে আজকের এই দিনে আশরাফুলের ব্যাটে গায়ানায় 'মহাকাব্য' রচিত হয়েছিল। সেদিন পৃথিবীর এহেন মন খারাপ ছিল না। ক্যারিবীয় ঢাক-ঢোল আর বাঁশির কান ফাটানো আওয়াজের মতো - সেদিন পৃথিবীও কর্মব্যস্ততায় মুখরিত ছিল।
মোহাম্মদ আশরাফুল; একটি নাম, একটি উপাখ্যান। আপনি যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস লিখতে যান। আশরাফুলের নামটি খোদাই করতে হবে - তার একটি পুরো অধ্যায়জুড়ে। যে অধ্যায়ের শুরুতে থাকবে অবিশ্বাস্য সব বাস্তবিক গল্প। এরপর যে অধ্যায় এগোবে সেখানে মিটমিটে আলো থেকে পরিণত হবে ঘোর অমানিশায়।
কল্পলোকের সব গল্প নাকি পূর্ণতা পায়না, বাঘেদের ক্রিকেটে 'আশরাফুল গল্পটিও' পূর্ণতা পায়নি। হতাশার ঝিলিকে স্তব্ধ ঘোরে এই মুহূর্তে আপনি হয়তো ভাবছেন বিশ্বভূবনে আপনার অস্তিত্বের কথা! কিন্তু 'আজকের নায়ক' বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়েছেন আর্বিভাবে -ই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ১৭ বছর ৬১ দিনে টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি করে তিনি বনে যান টেস্ট ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরীয়ান।
পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় বাংলাদেশের সেরা বিশ্বকাপ ২০০৭। গ্রুপপর্বেই ভারতের পর বারমুডাকে হারিয়ে সুপার এইটে চলে যায় বাংলাদেশ। সুপার এইট থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি আর কি হতে পারে? আপনি বলবেন সুপার এইটে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে আরেকটি জয়ের সুবাস গায়ে মাখবো। এই তো! কিন্তু আড়াল থেকে একজন অন্য ভাবনায় ডুব দিয়েছিলেন। তিনি মোহাম্মদ আশরাফুল।
৭ এপ্রিল, ২০০৭ বিশ্বকাপে গায়ানার প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামে টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় প্রোটিয়া সেনানী গ্রায়েম স্মিথ। শন পোলক, মাখায়া এনটিনি, আন্দ্রে নেল, জ্যাক ক্যালিস, চার্ল ল্যাঙ্গাভেল্টদের নিয়ে সাজানো দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বখ্যাত বোলিং লাইনআপ। ১৯.৫ ওভারে ৬৯ রানে ৩ উইকেটের পতনের পর ক্রিজে আসেন অন্য ভাবনায় মেতে থাকা মোহাম্মদ আশরাফুল।
ক্রিজে নেমে প্রথম বলেই বাউন্ডারি মারেন আশরাফুল। সেদিন ক্যারিবীয় দীপকুঞ্জ গায়ানায় ব্যাটের তুলিতে 'মোনালিসাকে' ফুটিয়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশের 'আশার-ফুল'। শিল্পীত ইনিংসে দৃষ্টিনন্দন ১২ টি শটের পসরা সাজিয়ে ১০৪.৮১ স্ট্রাইক রেটে ৮৩ বলে ৮৭ রানের একটি আশরাফুল-শৈলি এঁকেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল।
'অ্যাশের' প্রথম চার, আন্দ্রে নেলের ইয়র্কার লেন্থের বল ফ্লিক করে লেগ স্কয়ার দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে। এর মধ্যে ২৩.৪তম ওভারে দলীয় ৮৬ রানে সাকিব আল হাসান বিদায়। উইকেটে আশরাফুলের সঙ্গী হলেন আফতাব আহমেদ। এর পরে দ্বিতীয় চার মারেন ২৯.৩ বলে। জ্যাক ক্যালিসের শর্ট বল হুক করে ফাইন লেগ দিয়ে সীমানার বাইরে। তৃতীয় চার মারেন ঠিক পরের বলেই। এবার পুল শট খেলে স্কয়ার লেগ দিয়ে আরো একটি দৃষ্টিনন্দন চার মারেন।
জ্যাক ক্যালিসের বলে ফ্রন্টফুটে এসে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে সীমানা ছাড়া করে চতুর্থ চার মারেন। ৩৭.৬তম ওভারে আফতাব যখন সাজঘরের পথে '৭৬ রানের' জুটিতে তখন প্রাথমিক বির্পযয় সামলে উঠেছে বাংলাদেশ।আশরাফুলের পঞ্চম চার ইনিংসের ৩৮.৪ ওভারে। চার্ল ল্যাঙ্গাভেল্টের শর্ট বলে পুল করে ফাইন লেগ দিয়ে চার মারেন আশরাফুল। ৪৩তম ওভারের প্রথম বলে ভুল-বোঝাবুঝিতে রানআউট মুশফিকুর রহিম। তখনো দলের রান দুশো পেরোয়নি। 'আশার-ফুল' হয়ে আশরাফুল টিকে আছেন।
পরের চারটি মাখায়া এনটিনির করা বলে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন আশরাফুল। ৬টি চারের সাহায্যে ৬৪ বলে ৫১ রান। সপ্তম চার মারেন ৪৩.৪ ওভারে। চিকি! যে শট পরিচিতি পেয়েছে দিলস্কুপে, সেই শট কি অবলীলায় আশরাফুল ফুটিয়ে তুলতেন। সেখানেও যেনো এক অনন্য আশরাফুলিয় সৌন্দর্য! অফ স্ট্যাম্পের বাইরে এসে এনটিনির বলে অসাধারণ এক চিকি শট খেলে ফাইন লেগে সীমানাছাড়া করেন তাতেই 'ব্যাক টু ব্যাক বাউন্ডারি'। অষ্টম চার একই ওভারের শেষ বলে এনটিনির অফ সাইডের বল কাট করে সীমানাছাড়া। মাখায়া এনটিনির ৪৪তম ওভার থেকে আসে তিনটি চার।
নবম চার মারেন ইনিংসের ৪৬.২তম ওভারে গিয়ে। ল্যাঙ্গাভেল্টের অফ সাইডে বল। হাঁটু গেড়ে পাঞ্চ করে পয়েন্টে আরেকটি দৃষ্টিনন্দন চার মারেন আশরাফুল। দশম চার মারেন ৪৬.৫ ওভারে। ল্যাঙ্গাভেল্টের করা অফ ও মিডল স্ট্যাম্পের বলকে ফুলটস বানিয়ে প্যাডল শট করে কিপার এবং শর্ট ফাইন লেগের ফিল্ডারের মাঝ দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠান। আহ্! এমন কিছু উপভোগে আপনাকে ক্রিকেটের সাগরে ডুব দিতে হবে না! আশরাফুল দেখলে চলবে। এ যেনো মনের আনন্দে প্যাডলিং করছেন ব্যাটসম্যান। যেখানে ফিল্ডারের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
আশরাফুলের একাদশতম চার ৪৭.৫ ওভারে। আরেকটি প্যাডল শট! আন্দ্রে নেলের মিডল স্ট্যাম্প বরাবর নিচু বলকে স্কুপ প্যাডল করে শর্ট ফাইন লেগে ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে চার মারেন। ক্রিকেটের ভাষায় যেটার উপাধি 'ঝুঁকিপূর্ণ শট'। কিন্তু আশরাফুল কি অবলীলায় খেলে ফেলেন এমন সব শট। এক ডজন চার পূর্ণ হয় ৪৮.৩ ওভারে। ল্যাঙ্গাভেল্টের আউট সাইড অফ স্ট্যাম্পের বলে দুর্দান্ত শট খেলে এক্সট্রা কভার দিয়ে চার মারেন। ক্রিকেটের ক্লাসিক 'কপিবুক' শট।
৫০তম ওভারের প্রথম বলেই আন্দ্রে নেলের বলে আউট হয়ে যান মোহাম্মদ আশরাফুল। ৬৪ বলে ৫১ রান করার পর শেষ ১৯ বলে করেন ৩৬ রান। রেকর্ড গড়েন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৮৭ রানের এবং সর্বোচ্চ ১২টি চারের। যে রেকর্ড অবশ্য পরে পালাবদল হয়েছে।
আশরাফুলের এই ইনিংসের ওপর ভর করেই বাংলাদেশ ২৫২ রানের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এরপর বোলারদের নৈপুণ্যে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ১৮৪ রানে অলআউট করে ৬৭ রানের জয় পান টাইগাররা। ম্যাচসেরা হন মোহাম্মদ আশরাফুল। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার এই বঙ্গে আরেকটি প্রথমে 'আশরাফুল' নামটি গাঁথা হয়ে যায়। তখন থেকে ক্রিকেট পরাশক্তিদের সমীহ আদায় করে নেওয়া শুরু করে বাংলাদেশ। ক্রিকেট-বিশ্ব অন্য এক বাংলাদেশকে দেখতে শুরু করে।
- 0 মন্তব্য