• ক্রিকেট

গল্পে-কল্পে ঘরোয়া ক্ল্যাসিক ০২ : ওয়ান শট লাস্ট উইকেট

পোস্টটি ১৯৪০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

নতুন বল হাতে নিয়েছেন তরুণ রবিউল। আর অনুভব করছেন আকাশসমান চাপ। একটু এদিক-সেদিক হলেই ফস্কে যাবে ম্যাচ। ওপ্রান্তে তিন স্ট্যাম্প ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা নুরুজ্জামান ভালোই যন্ত্রণা দিচ্ছেন। প্রায় তিন ঘন্টা ধরে একটু একটু করে ম্যাচটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে লড়ে যাচ্ছেন তিনি। জয় থেকে একটা শট দূরত্বে দাঁড়িয়ে বরিশাল, দরকার মাত্র ৬ রান। আর রবিউলও জানেন তাঁর শুধু একটা ভালো বল—উঁহু! ভালো বল হলে হবে না, তাঁর চাই একটা উইকেট বল। ব্যস, কেল্লাফতে! জয় থেকে মাত্র ১ উইকেট দূরত্বে রংপুর। হতে পারে যেকোনো কিছু, ঘটতে পারে যেকোনো কান্ড। হাসতে পারেন যে কেউ। এর আগে এই মৌসুমে বরিশাল বা রংপুর কেউই দেখেনি জয়ের মুখ। দু’দলই তিনটে করে ম্যাচ খেলেছে এবারের জাতীয় লীগে, কিন্তু প্রত্যেকটা ম্যাচই শেষ পর্যন্ত নিষ্প্রাণ ড্র-তে শেষ হয়েছে।

রংপুরে দ্বিতীয় দফায় মুখোমুখি হওয়ার আগে বগুড়ায় প্রথম পর্বে মুখোমুখি হয়েছিল দু’দল। হাই স্কোরিং ম্যাচটার পরিসমাপ্তি ছিল ড্র’য়ে। এবার আর সে সুযোগ নেই। শেষ দিনের এখনো এক তৃতীয়াংশ বাকি, এখনই ম্যাচের অন্তিম লগ্ন উপস্থিত দু’দলের সম্মুখে। স্নায়ুচাপ জয় করে কোন দল পারবে মৌসুমের প্রথম জয় তুলে নিতে?

*****

এবার একটু শুরুর দিকে ফেরা যাক। টস জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন বরিশাল-দলপতি কামরুল ইসলাম রাব্বি। যার সঙ্গে টস করতে নেমেছেন তিনি একসময় তাঁর সতীর্থ ও বন্ধু ছিলেন, দু’জন একই সঙ্গে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে সামলেছেন বরিশালের পেস-ইউনিট। কিন্তু সময়ের ফেরে সাজেদুল রংপুরের নেতৃত্বে আর কামরুল স্ব-ভূমি বরিশালের হয়েই লড়ছেন, এবারে এক সময়ের সতীর্থের মুখোমুখি হয়ে গেছেন। কামরুলের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর ব্যাটিং, আছেন—শাহরিয়ার নাফিস, মোসাদ্দেক হোসেনের মতো জাতীয় তারকার পাশাপাশি আল আমিনের মতো তরুণ তারকারা। সোহাগ গাজী ব্যাটিং ও বোলিং দু’দিক দিয়েই দিচ্ছেন দারুণ ভারসাম্য। অন্যদিকে সাজেদুল সামলাচ্ছেন নাইম ইসলাম, ধীমান ঘোষের মতো অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীলদের। তাঁর দলের বোলিং ইউনিট চোখে পড়ার মতো। জাতীয় দলের তারকা পেসার শুভাশীষ রায়ের সঙ্গে তরুণ রবিউল হক আছেন, আছেন তিনি নিজেও। সোহরাওয়ার্দী শুভ ও মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে স্পিন ইউনিট সামলাতে আছেন তরুণ সেনসেশন সঞ্জিত সাহা। অনেকটা যেন সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। কিন্ত টস জিতে ফিল্ডিং নিয়ে চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়ার ভার নিয়ে নিজেদের উপরই খানিকটা চাপ তৈরী করে নিল বরিশাল?

কামরুল ইসলাম হয়তো উড়িয়েই দেবেন সে শঙ্কা। আরে ধুর! আমাদের আছে নাফিস, মোসাদ্দেকের মতো পিউর টেস্ট স্পেশালিস্ট, আছে সোহাগ গাজীর মতো হার্ড হিটার, যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়া সমস্যা হবে না।

তাই? দেখা যাক তাহলে!

*****

উইকেটের শুরুর সুবিধা সেভাবে নিতে পারলেন না কামরুল। তাঁর পেস ইউনিট রংপুরকে চেপে ধরতে বিন্দুমাত্র কসুর রাখেনি, কিন্তু শুরুর চাপটা মোটামুটি ভালোই সামাল দিয়ে উঠলেন নাইম ইসলাম ও অভিষিক্ত রাকিন আহমেদ। তাওহিদুলের ইনিসুইঙ্গিং ডেলিভারি মেহেদী মারুফকে শুরুর দিকে ফেরালেও, সারাদিনে পেসারদের আর কোনো সাফল্য নেই। মোসাদ্দেক হোসেনের ‘নিরীহ’ অফ স্পিনে ভুল করে বসলেন মাহমুদুল, বলের লাইন মিস করে ফেললেন, ফলাফল পেলেন হাতে নাতে। লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে বিদায় নিতে হলো তাঁকে। নাইম ও রাকিন সতর্কতার সঙ্গেই খেলছিলেন, তেমন কোনো সুযোগ না দিলেও, অভিজ্ঞ মনির হোসেন ঠিকই অভিষিক্ত রাকিন আহমেদকে ঘোল খাইয়ে বোল্ড করে ছাড়লেন।

সোহাগ গাজীর বলে শাহরিয়ার নাফিসের ক্যাচে পরিণত হয়ে অপমৃত্যু ঘটল নাইম ইসলামের সম্ভাবনাময়ী ইনিংসের। সোহরাওয়ার্দী শুভ ও তানবির হায়দারের ভুল বোঝাবুঝির ফাঁকে রাউট আউট হলেন, তানবির। একটু পর তানবিরের পথ ধরলেন শুভও। আচমকা ‘আনপ্লেয়বল’ হয়ে উঠলেন গাজী, ধীমান-সাজেদুল-রবিউল ফিরলেন একে একে। শেষ পেরেক ঠুকলেন মনির, রংপুর প্রথম দিনের প্রায় এক ঘন্টা বাকি থাকতেই অলআউট। রান জমা পড়েছে মোটে ১৪৭!

*****

কামরুল কি বুঝতে পারলেন নিজের ভুলটা? স্লো উইকেটে প্রথমে ফিল্ডিং করাটা কি ভুল হয়ে গেল? চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়ার চাপ সামাল দেয়া যাবে কি? নাকি প্রথম ইনিংসে রংপুরের মাঠে এসে স্বাগতিকদেরই অল্প রানের প্যাকেট করার তৃপ্তি তাঁর চোখেমুখে?

ওদিকে সাজেদুল কি ভাবছেন? ওদের সোহাগ গাজী হলে, আমাদেরও আছে সঞ্জিত। আছে তানবির। শুভর স্লো-লেফট আর্ম অর্থোডক্স সামাল দেয়া এত সহজ নাকি? মন্থর উইকেটের ফায়দা পুরোপুরি তুলে ছাড়ব না! নিজেদের মাঠে মৌসুমের প্রথম ম্যাচ, এত সহজে ছেড়ে দেব নাকি? বাছাধন! সবে তো শুরু, দেখো এইবার আমাদের রংপুরবাসীর আতিথ্য।

*****

ইনিংসের শুরুতে শুভাশীষের পেসে রীতিমতো চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল বরিশাল। শাহরিয়ার নাফিস ও শামসুল ইসলাম ফিরলেন শুভাশীষের পেসে পরাস্ত হয়ে। আল আমিন ও রাফসান মাহমুদ বাকি ঝড় সে দিনের মতো সামাল দিলেও পরদিন আবারো পড়লেন তোপের মুখে। দু’জনই ব্যর্থ হলেন শুভাশীষের পেস নিয়ন্ত্রণে। আরেক তরুণ পেসার রবিউলও যোগ দিলেন, তিনি ফেরালেন মোসাদ্দেক হোসেনকে। সোহাগ গাজী ড্রাইভ করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন পেছনে। শুভাশীষের পূর্ণ হলো ফাইফার। ১১ বলের এক ঝড়ে বরিশাল পরিণত হলো রীতিমতো ধ্বংসস্তুপে। ৭৯/৩ থেকে স্কোর দাঁড়ালো ৭৯/৬!

কামরুল ও নুরুজ্জামান প্রায় ঘন্টাখানেক দাঁতে দাঁত চাপা সংগ্রামে টিকে থাকলেন, কিন্তু হার মানতে হলো তাদেরকেও। তানবিরের স্পিনে ধোঁকা খেয়ে ফিরলেন নুরুজ্জামান। কামরুল অপরাজিত থাকলেও, ওপ্রান্তে থাকলেন না কেউই। বরিশালকেও থামতে হলো ১৪৭-এ!

*****

একি! কারো লিখে রাখা চিত্রনাট্য নাকি? দু’দলই প্রথম ইনিংসের শেষে একই স্কোর!

দ্বিতীয় ইনিংসে সাজেদুল পই পই করে সতর্ক করে দিলেন, উইকেট আহামরি কোনো কিছু নয়। দয়া করে নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে এসো না বাপু! যদি উইকেটে পড়ে থাকতে পারো, রান আসবেই। তবে হ্যাঁ, তেড়েফুঁড়ে খেলা যাবে না কিছুতেই।

ব্যাটসম্যানদের আত্মস্থ হলো সে বাণী। কেউই আর হুটহাট খেলতে যান না। চেষ্টা করেন উইকেট কাঁমড়ে পড়ে থাকতে। প্রতি উইকেটের জন্য বিস্তর খাটনির দরকার হলো অতিথি দলের। কামরুল প্রথম ইনিংসের সাফল্য দেখে আস্থা রেখেছেন তাঁর স্পিন ইউনিটে। ঘরোয়া ক্রিকেটের অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত সেনানী মনির হোসাইন, সঙ্গে সোহাগ গাজী। এই দুজন একটানা বোলিং করে যান। মাহমুদুলও হার মানতে নারাজ। পাঁচ ঘন্টারও অধিক সময় উইকেট আঁকড়ে বিনির্মাণ করেন—৬৭ রানের মহামূল্যবান ইনিংস, ১৮০ বল থেকে। যাতে খেলেছেন মাত্র দুটো চার! শুভও প্রায় তিন ঘন্টা তাঁকে সঙ্গ দেন পরম নির্ভরতায়। কিন্তু শুভর বিদায়ের পর ভেঙ্গে পড়ে রংপুর। এত দীর্ঘ সময়ের সাধনা আর কেউ রাখতে পারেন না। ধীমান ঘোষ ছোট্ট ক্যামিও খেলেন। অধিনায়ক নিজেও ২ চার ও ২ ছয়ে ‘এন্টারটেইনিং’ ২৭ রান করে অপরাজিত থাকেন।

সাড়ে তিনশো কিলোমিটারেরও অধিক দূরত্ব, ও সুবিশাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে রংপুরের আতিথ্য গ্রহন করা বরিশাল দেখতে পায়—তাদের সামনে জয়ের লক্ষ্য দাঁড়িয়েছে ২৩০! সময় পড়ে আছে অঢেল। প্রায় চার সেশন তাদের সামনে উন্মুক্ত। উইকেটজুড়ে যদি আলিশান মসনদ গাঁড়া যায়, জয় নিশ্চিত; আর রংপুর জানে—উইকেট নেয়ার বিকল্প নেই।

*****

কামরুল ইসলাম ভিন্ন কিছু ভাবলেন। ১ রানেই রাফসান ফিরে এলে মনির হোসাইনকে পাঠিয়ে দিলেন। যদি কিছু দ্রুত রান জমা পড়ে! কারণ, চতুর্থ দিনের উইকেটে ২৩০ যে পাহাড়সম স্কোর, তা কে না জানে! কাজে লাগল না সে জুয়া, মনির ফিরলেন একটু পর, ফিরলেন নাফিসও; ২২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে কাঁপছে বরিশাল। আল আমিন ও শামসুল ইসলাম আর কোনো বিপদ ঘটতে দিলেন না সেদিনের মতো। তবে রোমাঞ্চকর এক দিনের আগমণী কি শোনাতে পেরেছিলেন?

ওদিকে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ওডিয়াই সিরিজ চলছে। এই ম্যাচে নজর দেয়ার কারণ নেই তাই। এমনিতেই এসব ম্যাচ ঘিরে আগ্রহ থাকে না খুব একটা। তবে পত্রিকাওয়ালাদের তো কিছু খবর চাই, বাংলাদেশ ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সিরিজ না থাকলে কিছুটা আলো পাওয়া যায়, এখন সেসবও সম্ভব নয়। সমস্ত আলো ইমরুল-সৌম্য-লিটন-সাইফ উদ্দীনরা কেঁড়ে নিয়েছেন।

দিনের শুরুতেই শামসুল স্লিপে ক্যাচ দিলেন। লড়াইয়ের ব্যাটনটা হাতে নিলেন মোসাদ্দেক। আল আমিন ও মোসাদ্দেক; দুই ডানহাতির ব্যাটে বরিশাল মিঁইয়ে যাওয়া সম্ভাবনাটা দেখতে পায় আবার নতুন করে। কিন্তু তানবির হায়দার হতে দিলেন না তা। তাঁর থ্রোতে রান আউট হয়ে ফিরলেন আল আমিন, মোসাদ্দেককে ফেরানো নিজের দায়িত্ব মনে করলেন অধিনায়ক সাজেদুল, ১২০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে মোটামুটি হারের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো সাড়ে তিনশো কিলোমিটার ভ্রমণ করে যাওয়া অতিথিরা।

ভিন্ন কিছু ভাবলেন সোহাগ গাজী। নুরুজ্জামানকে নিয়ে লড়তে চাইলেন। বাগরা দিলেন উঠতি ‘ছোকরা’ রবিউল। নবীন ছোকরা পেস বোলিংয়ের দারুণ প্রদর্শনী দেখিয়েছেন সকাল থেকে। সাজেদুলও খুব ভরসা করেন তাঁর এই তরুণ পেসারের উপর, অধিনায়ককে খুব একটা হতাশ করেননি তিনি।

বরিশাল-দলনায়ক টিকতে পারলেন না দলের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে। মিনিট পনেরো বাদেই ফিরলেন। জয় থেকে দূরত্ব তখনো ৬১, হাতে মোটে ২ উইকেট। কফিনের ডালাপালা সব বন্ধ। শুধু পেরেক ঠুকা বাকি, তাও মাত্র দুটো।

*****

তানভীর ইসলাম ব্যাটিং খুব একটা পারেন না। তবু দাঁতে দাঁত চেপে দলের জন্য লড়ে গেলেন, নুরুজ্জামান অপর প্রান্ত থেকে যুগিয়ে যাচ্ছেন সাহস। এই তো সাবাশ! হ্যাঁ, এইভাবে, ঠিক আছে, আরেকটু ধরে থাক ভাই। কখনো ঢেকে ঠান্ডা মাথায় বোঝান, কখনো ইশারা-ইঙ্গিত দেন, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে থামস আপ দেখান। সঞ্জিত সাহার মায়াবী-স্পিন, রবিউল-শুভাশীষের পেসের দাপট, সমস্ত সামলে প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা কাটিয়ে দেন। ওদিকে চা-বিরতির সময় হয়ে এলো প্রায়, কিন্তু ম্যাচও প্রায় শেষের প্রান্তে, আলোচনা সাপেক্ষে ম্যাচ গড়িয়ে চললো আরো খানিকটা সময়।

সাজেদুল কি করবেন, বুঝে উঠতে পারছে না। এই তানভীর যে এভাবে দাঁড়িয়ে যাবে ভাবতেই পারেননি তিনি। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আর কয়েকটা ওভার, নতুন বল নিয়ে যদি কিছু করা যায়, কোনোমতে ৮০ ওভারের কোটা শেষ করতে চান তিনি। আর এর মধ্যে যেন নুরুজ্জামান ম্যাচ শেষ করতে না পারে, নিশ্চিত করতে চান তা-ও।

কি হলো এটা? সমস্বরে আওয়াজ-আবেদন চিৎকার। হাউ’জ দ্যাট… কিংবা আওয়াজেড…। সঞ্জিত সাহার আর্মার তানভীরের প্যাডে আঘাত হেনেছে, সবাই আম্পায়ারের দিকে চেয়ে আছে। আঙ্গুল উঠে গেছে আম্পায়ারের। উল্লাসে ফেটে পড়লো রংপুর। নুরুজ্জামান বিহ্বল হয়ে তখনো ভাবছেন, লেগ বিফোর হয়েছিল কি?

ওভারের প্রথম বল। এখনো জয়ের জন্য ৭ রান চাই। তাওহিদুলকে ঘিরে ধরে ছাতার মতো সবাই। তাওহিদুল ঝুঁকি নিতে চেয়েও নিতে পারেন না। নুরুজ্জামানে আস্থা রাখতে চান। সীমানা দড়ির ওপ্রান্ত থেকে সতীর্থ ও বন্ধুরা সাহস ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছে তাঁকে। তিনি পণ করেন, ঠেকিয়ে দেবেন সঞ্জিতকে, আউট হবেন না। কিছুতেই না।

পরের ওভারে আরো চার বল খেলতে হলো তাঁকে। কোনো বিপদ ঘটতে দিলেন না তিনি। ওরা নতুন বল নিচ্ছে। মাত্র এক শট দূরত্বে দাঁড়িয়ে। এই ইনিংসে নুরুজ্জামানের একটা ‘ছক্কা’ আছে, তেমন করেই আরেকটা হলেই, ব্যস, কেল্লাফতে!

*****

ঠিক ৮০ ওভার পেরোনোর পর তাঁর অধিনায়ক চেয়ে নিয়েছেন চকচকে নতুন বল। যেন অপেক্ষায় ছিলেন ৮০ ওভার পেরোনোর। তরুণ রবিউলের কাঁধে হাত রেখে বলে দিলেন, কিছুতেই উল্টা-পাল্টা কিছু করা যাবে না। কোনোমতেই ‘এক্সট্রা’ রান দেয়া যাবে না। প্রতিটি রানই মূল্যবান। স্কোরে জমা হবে প্রত্যেকটি রান। খুব সতর্ক থাকা লাগবে। নুরুজ্জামান যেকোনো সময় বল উড়িয়ে দিতে পারে গ্যালারী-পানে, হাফভলি দেয়া যাবে না, ফুলটস কোনোমতেই না। ওদের মাত্র একটা উইকেট। এক উইকেট! এক বলের ব্যাপার, চাপটা ওদের উপরই। সুতরাং ঠান্ডা মাথায় ব্যাটসম্যান রীড করো, বল রাখো গুডলেংথে।

বললেই কি হয়? বল ছোঁড়ার মুহূর্তে স্নায়ু বাগড়া দিলেই তো একটা ‘ললিপপ’ গিয়ে পড়বে নুরুজ্জামানের সামনে। তিনি কি আস্ত ছেড়ে দেবেন তা? প্রথম বলটা থেকে কোনো বিপদ হলো না। নুরুজ্জামানের ইচ্ছে হচ্ছে এক শটেই এসপার-ওসপার করে ফেলেন। এত চাপ নিতে পারছেন না তিনি। সবাই চেয়ে আছে তাঁর দিকে। পরের বলটা রাখলেন রবিউল, খেললেন নুরুজ্জামান।

আরে! কি হলো এটা? বল যে হাওয়ায় ভাসছে!  নুরুজ্জামান ভুল করলেও, ফরহাদ হোসেন ভুল করলেন না একদম। ক্যাচটা ফস্কাতে দিলেন না, লুফে নিলেন প্রথম সুযোগেই। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন নুরুজ্জামান। মাঠের বাইরে থেকে আক্ষেপ আর হতাশার বেদনাময় অনুভূতি ভেসে আসছে বরিশাল শিবির থেকে। রংপুর শিবির তখন আনন্দে উন্মাতাল। রবিউল আছেন উৎসবের কেন্দ্রে। কি বোলিংটাই না উপহার দিলেন! কেউ জড়িয়ে ধরছেন, কেউ কোলে তুলে নিচ্ছেন তাঁকে, কেউ মেলাচ্ছেন কাঁধে কাঁধ।

স্নায়ুর উঠা-নামা সমস্ত পেরিয়ে রংপুর পেল ৫ রানের অবিশ্বাস্য ও রোমাঞ্চকর এক জয়। ক্রিকেট কখনো কখনো গল্পের মতো মনে হয়। হয় না?

____________________

বরিশাল বিভাগ বনাম রংপুর বিভাগ

শেরে বাংলা ন্যাশনাল স্টেডিয়াম, মিরপুর; ২২শে অক্টোবর-২৫শে অক্টোবর, ২০১৮

জাতীয় ক্রিকেট লীগ ২০১৮-২০১৯

ম্যাচসেরা—রবিউল হক (রংপুর)

ফলাফল—রংপুর ৫ রানে জয়ী।