• ফুটবল

টেনিস কিংবা ফুটবল; দ্বিধাদ্বন্দে বেড়ে উঠা এক কিশোরের বিশ্বজয়! 

পোস্টটি ৩৯৪২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ততদিনে বস্কো আইজেকসন একজন খ্যাতনামা প্রকৌশলী হয়ে উঠেছেন। ব্রাসিলিয়ায় এক প্রাথমিক স্কুল শিক্ষিকার সাথে তার স্বচ্ছল সুখের সংসার৷ তিনি নিজে ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জীবনের নানা মোড় ঘুরে তার তরী এসে ভিড়িয়েছে প্রশান্তির বন্দরে৷ বস্কো সাহেবের তরুণী স্ত্রী সিমন ডস সান্তোস তখন সন্তানসম্ভাবা। প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন দম্পতি। বস্কো সাহেব ভাবেন, আইজেকসন পরিবারে এই বুঝি আসছে প্রকৌশলী জুনিয়র! সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দারুন খুশির এক মূহুর্ত উচ্ছ্বাসে অভিভূত হলেন লেইতে দম্পতি। ১৯৮২ সালের ২২ এপ্রিলের এক সন্ধ্যা। পৃথিবী আলো করে তাদের ঘরে জন্ম নিয়েছে এক পুত্র সন্তান। আনন্দের অশ্রু ঝরিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে ভুল করলেন না বাবা। 

যেন সে এসেছিলো পৃথিবীর সমস্ত গুমোট অন্ধকারকে হারিয়ে দিতে। অবর্ননীয় উজ্জ্বল চেহারা। হিমশীতল চোখ'দুটো যেন বিশ্বজয় করবে এক নিঃশ্বাসে! সোনালী চুলগুলো তার সৌন্দর্যের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। তাকে নিয়ে সুখীর অন্ত রইলো না লেইতে পরিবারে। ভালোবেসে বাবা-মায়ের'র নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখা হলো 'রিকার্ডো আইজেকসন ডস সান্তোস লেইতে'। অবশ্য নামের পিছনের অংশ মোটামুটি সবাই-ই ব্যবহার করে থাকে এই অঞ্চলে। 

 রিকার্ডোর বাল্যকাল ছিলো সুখের। ব্রাজিলের আর পাঁচ-দশটা দরিদ্র বালকের মতো দিন কাটেনি তার৷ তাই অভাব কি জিনিস সেটা তার বোধগম্য হয় না। তাকে শহরের খ্যাতনামা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন বাবা-মা। তার স্কুলের সমস্ত কর্মকান্ডকে শুধুমাত্র এক কথায় ব্যখ্যা করা যেতে পারে। সে ছিলো 'অসম্ভব মেধাবী'। একটা উদাহরণ দেই। স্কুলে ১০ নাম্বারের মোট ১০ টি বিষয়ের পরিক্ষায় তার সর্বমোট প্রাপ্ত নাম্বার ছিলো ৯৯! শিক্ষক ইচ্ছে করেই বাকি ১ মার্ক তাকে দেন নি। ব্যাপারটা খুব আহত করলো রিকার্ডো'কে। কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে উঠলো বেচারা! কেন তাকে ১ নাম্বার কম দেয়া হলো- সে প্রশ্নের উত্তর তার জানা ছিলোনা বলেই কিনা এমন কান্ড!

রিকার্ডোর বয়স তখন সাতের কোটা পেরোয়নি। তারা সাও পাওলো'তে পাড়ি জমালো। পারিবারিক স্বচ্ছলতার কারণে হোক আর যথেষ্ট আন্তরিক বাবা-মায়ের কারণে হোক- কাকা একই সাথে পড়ালেখা এবং ফুটবল' দুটোতেই একসাথে ফোকাস করতে পেরেছিলো। ফুটবলে সে কিছু একটা পেয়েছিলো; যা তাকে ভাবিয়ে তুলতো৷ চুপচাপ ছিলো বলে সে নিয়ে তেমন মাতামাতি পর্যন্ত ছিলোনা তার৷। তবে প্রতিভার সাক্ষর পেতে দেরি হলোনা কারোরই। ব্যাপারটা প্রথমেই ধরতে পেরেছিলো তার স্কুল। তারাই তাকে স্থানীয় ইয়ুথ একাডেমি 'আলফাভিল'র সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেবার রিকার্ডো স্থানীয় এক টুর্নামেন্টে আলফাভিলকে ফাইনালে তুলে। এবং এই ফাইনাল ম্যাচটিই তার জীবনের প্রথম সাফল্যের বার্তা নিয়ে এসেছিলো৷ দর্শক সারিতে সাও পাওলো ক্লাবের যুব দলের এক স্কাউট মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন ছোট্ট রিকার্ডোর খেলা; যিনি শহরের আনাচে-কানাচে চষে বেড়ান রিকার্ডোদের মতো প্রতিভার খোঁজে। তিনি তাকে সাও পাওলো'র বয়স ভিত্তিক দলে খেলার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন সেদিনই!          

ক'টা দিন না পেরোতেই রিকার্ডো তাতে সায় জানালো। স্কুল- পরিবার আর সাও পাওলোতে ফুটবল। ততদিনে তাদের পরিবারে বড় হচ্ছিলো আরেক অতিথি, রদ্রিগো। রিকার্ডোর তিন বছরের ছোট ভাই৷ ছোটভাইয়ের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে পার করছিলো রিকার্ডো। রদ্রিগো'কে ডাকা হতো ডিয়াগো নামে। ডিয়াগো ছোটবেলা থেকেই ভাতৃভক্ত। তবে সে কোনোভাবেই বড় ভাইয়ের নাম উচ্চারণ করতে পারতো না! রিকার্ডোর পারিবারিক নাম দীর্ঘকায়। রিকার্ডো আইজেকসন ডস সান্তোস লেইতে! ছোট্ট ডিয়াগো তো আর এই লম্বা নাম মুখস্থ করতে পারে না। তবুতো ভাইকে ডাকতে হবে কোনোকিছু বলে। সে ডাকতো 'কাকা' বলে! ছোটবেলা থেকেই এই নামে ডেকে আসছে সে; দিনদিন তাই এই নামটাই কমন হয়ে গেলো সবখানে। যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপি রিকার্ডো আইজেকসন লেইতে'কে মানুষ চিনে আসছে যে কাকা নামে, তার উৎপত্তি এখানেই!  

কাকা তখন ৮ বছরে পা দিয়েছে৷ নিয়মিত খেলছে সাও পাওলোর যুবদের হয়ে৷ ফুটবলের পাশাপাশি তার প্রিয় খেলা টেনিস। বাড়ির আঙ্গিনায় টেনিস খেলে তার ঘাম ঝরানো দেখে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক এই ছেলে বড় হয়ে নিশ্চয়ই ভালো টেনিস প্লেয়ার হবে৷ কিন্তু ক্যারিয়ারের প্রশ্নে বিপত্তি বাধঁলো এই টেনিস! কাকা'র বাবা সবসময়ই সন্তানদের নিজেদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতেন। কিন্তু এবেলায় তাকে হতাশ হতে হলো। 

স্বভাবতই তিনি চেয়েছিলেন সন্তান তার মতোই নামকরা ইঞ্জিনিয়ার হবে। তার মেধা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিলোনা। কিন্তু সন্তান ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কোনো সুপ্ত বাসনা মনে লালন করছে না বলেই তিনি ধরে নিলেন। তবুও কাকা'কে চাপিয়ে দিলেন না তার সিদ্ধান্ত। সন্তানকে বললেন, সে যেন তার সবচেয়ে প্রিয় খেলাটিকেই বেছে নেয়। 

কাকা'র বয়স তখন ১৫। ক্যারিয়ার হিসেবে তার সবচেয়ে প্রিয় খেলাটিকে বেছে নেয়ার প্রশ্নে সে ফুটবলকেই বেছে নিলো! এর ক'দিন পরেই  সাও পাওলো যুব দলের সাথে তার আনুষ্টানিক চুক্তি পাকাপোক্ত হয়ে গেলো। সাও পাওলোর সিনিয়র দলে অভিষেকের পূর্বে এই দলের হয়ে মোট ৩ বছর খেলেছে কাকা। এরই মধ্যে 'কোপা ডু জুভেনিল' জিতে নিলো তার দল। তার প্রফেশনাল ফুটবল ক্যারিয়ারের এতো কেবল শুরু! 

০১ ফেব্রুয়ারি ২০০১। সাও পাওলো শহরে ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। নির্মল বাতাসে ভেসে আসছিলো ভয়ংকর আনন্দের এক গুঞ্জন; মিথ্যে হলোনা সেটি। সাও পাওলোর সিনিয়র দলের হয়ে অভিষেক হয়ে গেলো রিকার্ডো কাকা'র! এরচেয়ে আনন্দের সংবাদ কাকার জন্য আর কিছু হতে পারেনা। বাল্যকালে তার ইচ্ছায়- বাসনায় মাত্র ২ টা জিনিস ছিলো। যার একটি ছিলো 'সাও পাওলোর হয়ে মাত্র এক ম্যাচ খেলা' আর অন্যটি ছিলো ব্রাজিল জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেয়া! আজকের এই দিনে তার প্রথম ইচ্ছাটি পূরণ হতে চলেছে৷ এরচেয়ে আনন্দের ব্যাপার আর কি হতে পারে!        

কাকা বিশ্ববাসীকে তার আবির্ভাবের ইঙ্গিত দিচ্ছিলো সাও পাওলোর সিনিয়র দলে অভিষেকের পর থেকেই৷ প্রথম মৌসুমেই ২৭ ম্যাচে ১২ গোল তার জলন্ত প্রমাণ। তবে সেটাকে ছাপিয়ে সাও পাওলো আজীবন কাকা'র ক্যারিয়ারের প্রথম মৌসুম মনে রাখবে ভিন্ন আরেকটি কারণে। ১৯৩৩ সাল থেকে শুরু হওয়া ঐতিহ্যবাহী 'টরনাইয়ো রিও- সাও পাওলো চ্যাম্পিয়নশিপ' এর আগে কখনোই জিততে পারেনি সাও পাওলো। এটা মূলত একটা কম্পিটিশন, যেখানে রিও ডি জেনেরিও এবং সাও পাওলো একে অন্যের মুখোমুখি হয়। সেবার রিওর বদলে ফাইনালে ছিলো বোটাফাগো ক্লাব। সাও পাওলো ১-০ গোলে তখন পিছিয়ে আছে। বদলি হিসেবে নামানো হয়েছে ১৮ বছর বয়েসী এক তরুণকে, যার অভিষেক হয়েছে এই মৌসুমেই। কাকা, চিনতে ভুল করেনা দর্শকরা। আর নিজেকে চেনাতেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করলেন না সেদিন। বদলি হিসেবে নেমে মাত্র ২ মিনিটের ব্যবধানে তার জোড়া গোলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নিলো কাকার ক্লাব! এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।  

সাও পাওলোতে তার পরবর্তী মৌসুম ছিলো রাজকীয় উপাখ্যানের ন্যায়। মাত্র ২২ ম্যাচে ১০ গোল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন কাকা। এ যেন ভিন্ন এক কাকা। জানান দিচ্ছেন তার অস্তিত্বের; যিনি নিকট ভবিষ্যতে রাজত্ব করতে চলেছে পুরো ইউরোপ। হলো-ও তাই। মৌসুম শেষে তাকে দলে বেড়াতে উঠেপড়ে লেগে যায় ক্লাবগুলো। তবে সবাইকে হতাশ করে দিয়ে 'দামি চিনাবাদাম' আখ্যা দিয়ে তাকে লুফে নেন এসি মিলানের কর্ণধার সিলভিও সাহেব। এজন্য খরচ করতে হয়েছিলো ৮.৫ মিলিয়ন ইউরো। আনকোনার সাথে ২-০ গোলের জয়ের ম্যাচে তার অভিষেক হলো। শীঘ্রই রুই কস্তাকে সরিয়ে ইনজাঘি- শেভচেঙ্কো- থমারসনের সাথে স্টার্টিং ইলিভেনে যোগ দিলেন কাকা৷ সে মৌসুমে ৩০ ম্যাচে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ গোল করলেন তিনি৷ তবে সেগুলো ছাপিয়ে বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ইনজাঘির টাইটেল জয়ী হেড গোলে এসিস্ট করা। 

hi-res-185361565-ricardo-kaka-of-ac-milan-during-the-serie-a-match_crop_north

সে মৌসুমে এসি মিলান *স্কুডেট্টু*র পাশাপাশি ইউয়েফা সুপার কাপ জিতলো। কিন্তু ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ এবং সুপারকাপ ইতালিয়ানো'র রানার্সআপ থাকতে হলো। চ্যাম্পিয়নস লীগেও কোয়ার্টার থেকে বিদায় নিয়ে হলো তাদের। কিন্তু কাকার পার্ফমেন্স ছিলো অনবদ্য। সে স্বীকৃতি পেতে দেরি হলোনা যদিও৷ অভিষেক মৌসুমেই *ইতালিয়ান সিরিএ প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার* পেলেন কাকা। নমিনেশন পেলেন *ব্যালন ডি'ওর- ফিফা ওয়াল্ড প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার* এর জন্যও৷ 

মিলানে তখন সুদিন চলছিলো। তারকায় ঠাসা স্কোয়াড। গাট্টুসু- সিডর্ফ- আমব্রোসিনি- পিরলোদের মতো প্লেয়ার কাকার টিমমেট। অবশ্যই এটা তার জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিলো। ভাগ্যিস! সে সময়ে দলের আস্থার প্রতিদান দিতে পেরেছিলেন বলেই তিনি আজকের কাকা হতে পেরেছেন। পরবর্তী মৌসুম শুরু করেছিলেন *সুপারকাপ ইতালিয়ানো* জয় করেই৷ সেবার দলকে চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে তুলতে অসাধারণ ভুমিকা পালন করেছিলেন কাকা। তার দুই গোল আর পাঁচ এসিস্ট ছিলো নির্ভরতার সাক্ষর৷ লিভারপুলের বিপক্ষে সেবারের ফাইনালকে বলা হয়ে থাকে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফাইনাল ম্যাচ কামব্যাকগুলোর একটি। হাফটাইমে ৩-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও ম্যাচে ব্যাক করে লিভারপুল! এবং পেনাল্টি শ্যুটআউটে ৩-২ গোলে জিতে নেয় শিরোপা। সেবার আবারো ব্যালন ডি'র এবং ফিফা বেস্ট প্লেয়ারের জন্য মনোনীত হন কাকা। 

২০০৫-০৬ মৌসুমে কাকার পা থেকে আসে প্রথম হ্যাট্টিক। দিনদিন ভয়ংকর হচ্ছিলেন কাকা। তবে আবারোও চ্যাম্পিয়নস লীগ থেকে বাদ পড়তে হয় মিলানকে। এমনকি সিরিএ লীগ রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের৷ কিন্তু ২০০৬ সালে *CALCIOPOLI SCANDAL*-এ মিলানও দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের অর্জিত পয়েন্ট থেকে ৩০ পয়েন্ট কেটে নেয়া হয়; ফলে চতুর্থ স্থান থেকে লীগ শেষ করে থাকা। কাকা করেন ১৭ গোল। মৌসুমজুড়ে তার আগুনজ্বলা পার্ফমেন্স তাকে টানা ৩য় বারের মতো ব্যালন ডিওর এবং ফিফা বেস্ট প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ারের জন্য মনোনীত করে। কিন্তু তখনো তিনি দূরে ছিলেন। 

পরবর্তী মৌসুম ছিলো রিকার্ডো কাকা'র জীবনের শ্রেষ্ট মৌসুম। শেভচেঙ্কো ২০০৬-০৭ মৌসুমে চেলসিতে চলে গেলে কাকা-ই হয়ে উঠেন এসি মিলানের ফরোয়ার্ডের প্রধান অস্ত্র। সে অস্ত্রে বুদ হতে থাকলো সবাই। আন্ডারলেখটের বিপক্ষে জীবনের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লীগ হ্যাট্টিকও করে ফেললেন কাকা; সেবার ১০ গোল নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা কাকা। পাশাপাশি উচিয়ে ধরলেন চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা। 

২০০৮ সালের কথা। চারিদিকে গুঞ্জন কাকা এই মৌসুম শেষে অন্য কোনো ক্লাবে মুভ করবেন৷ ততদিনে তিনি সানসিরো বাসীর আত্মার মানুষ হয়ে গেছেন। তারা ভালোবেসে তাকে ডাকেন *প্রিন্স অব সানসিরো*।

ইতালিয়ান সরকার তাকে ইতালিয়ার নাগরিকত্বও দিয়েছে। কিন্তু তার ক্লাব ছাড়ার ব্যাপারটিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না সমর্থকেরা। তাইতো তারা বাধ্য হয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে উপস্থিত তার বাড়ির সামনে। তারা কিছুতেই তাদের প্রিয় মানুষকে ক্লাব ছাড়তে দিতে পারেনা! ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক ফুটবলে এমন ঘটনা বিরল। টাকার খেলায় ফুটবলাররা মুহুর্তে চোখ পাল্টাতে যেখানে দুবার ভাবেন না সেখানে ক্লাবের ফুটবলারের প্রতি মিলান সমর্থকদের এমন উল্লাস সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক।       

Real-Madrid-league-football-match-Kaka-Spanish-January-10-2010

রিয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সি গায়ে জড়ানো ছিলো রিকার্ডো কাকার জীবনের স্মরণীয় একটি ঘটনা। এখানে তার যত না প্রাপ্তি; তারচেয়ে বেশি আছে গ্লানি। কাকার ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে অত্যন্ত চড়া মূল্যে রিয়াল মাদ্রিদ তাকে কিনে নেয় মাদ্রিদের কাছ থেকে। সে সময়ে একজন মিডফিল্ডারের জন্য এতো পয়সা খরচ করা সহজ কথা ছিলোনা। ২০০৯ সালের ৭ আগস্ট মাদ্রিদের হয়ে অভিষেক হয় কাকার৷ এরপর সাদা জার্সিধারীদের হয়ে ৪ মৌসুমে ১২০ ম্যাচ খেলেছেন কাকা। ২৯ গোলের পাশাপাশি ৩২ এসিস্ট আছে তার ঝুলিতে। সে সমীকরণের চেয়ে বড় করে দেখা হয় মাদ্রিদে তাকে কতটা অবহেলার স্বীকার হতে হয়েছে। জোসে মরিনহো মোটামুটি তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছিলেন বেঞ্চে বসিয়ে বসিয়ে। তিক্ততার যাত্রা শেষে ২০১৩ সালে রিয়ালকে বিদায় জানান কাকা। তবে মাদ্রিদের উপর রাগ না করে বরং বলে গেছেন, *ওয়ান্স আ মাদ্রিদিস্তা, অলওয়েজ আ মাদ্রিদিস্তা*...         

বলেছিলাম কাকার জীবনের দুটো ইচ্ছার কথা। প্রথমটি পূরণ হওয়ার বছর খানেক পর দ্বিতীয় ইচ্ছাটিও পূরণ হয়।   ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে বলিভিয়ার বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে তার অভিষেক হয়ে যায়। কাকা ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন। কোস্টারিকার সাথে ৫-২ গোলে জয়ের ম্যাচে ২৫ মিনিট তার ম্যাজিক দেখেছে ফুটবল ফ্যানরা। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের কনফেডারেশন কাপের সবগুলো ম্যাচ খেলেন কাকা এবং ফাইনালে ৪-১ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারানোর ম্যাচে একটি গোলও করেন। 

93779622_635952953619266_358093542549094400_n

২০০৬ বিশ্বকাপে কাকা নিজেকে প্রমান করতে পারেননি সেভাবে। তার পা থেকে একটিমাত্র গোল আসে; ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সে ম্যাচে ম্যান অব দ্যা ম্যাচও হন কাকা। তবে ব্রাজিল ফ্রান্সের সাথে হেরে বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। ২০০৯ কনফেডারেশন কাপে তার ভয়ংকর রুপ দেখা যায় কিছুটা হলেও। ব্রাজিলের হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কনফেডারেশন কাপ জিতে নেন কাকা; পাশাপাশি তার ভুমিকার স্বীকৃতিস্বরুপ জিতে নেন গোল্ডেন বল। ২০১০ বিশ্বকাপ ছিলো পুরো ব্রাজিল দলের জন্য আরেকটি ব্যর্থতার অধ্যায়। কাকার প্রশ্নবিদ্ধ লাল কার্ড, কোনো গোল না পাওয়া এবং নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হেরে বিদায় নেয়া সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। কাকা সে আসরে ৩টি এসিস্ট করেন। এরপর থেকেই কাকা ব্রাজিল দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন...         

কাকা এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফ্যান- এই বিষয়ে যদি আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়; আমি বলবো এই দুটোর পিছনে রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ এবং এসি মিলান ফুটবল ক্লাব। ব্রাজিলের শতশত ফুটবলার আছেন যারা কখনোও হাইলাইটেড হন না, কিন্তু তাদের প্রতিভা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবেনা। কিন্তু কাকার নাম বিশেষভাবে স্মরণ হবে না। কারণ তাদের পূর্বপুরুষেরা এবং উত্তরসূরীরা সবসময়ই সেরার তকমা নিতে বেঁচে থাকেন। একটা জেনারেশনের ফুটবল ফ্যানদের রাতের ঘুম হারাম করার জন্য এই কাকা; একটা জেনারেশনকে ফুটবলের প্রেমে বাধ্যে করার কারিগর এই কাকা; কাকা নাম আমাদের দেশের রিয়াল মাদ্রিদ এবং এসি মিলান ফ্যান কমিউনিটির জন্য যুগে যুগে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এদেশের লাখো লাখো তরুনের ভালোবাসার মানুষ; লাখো লাখো তরুনীকে ফুটবলের সাথে সাথে তাকে ভালোবাসতে বাধ্যে করেছেন কাকা! কাকা নেই, কাকা থাকবেনা একদিন- তবুও কাকার প্রতি ভালোবাসা কখনোই অম্লান হবে না বলেই আমি মনে করি। কারণ, কাকার তুলনা কাকা-ই….     

এই যাকে নিয়ে হাজার শব্দের আর্টিকেল লেখা হচ্ছে, সেই রিকার্ডো কাকা'র জীবন থেমে গিয়েছিলো এক সুইমিংপুল দুর্ঘটনায়। জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন কাকা। 'স্পাইনাল ফ্রেকচার' তার শরীর প্যারালাইজড করে দিতে পারতো। এটা ছিলো তার ক্যারিয়ার, জীবন এবং বেঁচে থাকার সন্ধিক্ষণে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রাজেডি। যদিও কাকা পুরোপুরি সেরে উঠেন এই দুর্ঘটনা থেকে। এই ঘটনার পর থেকেই তার আয়ের একটা অংশ নিয়মিত দান করেন তিনি।    

ক্যারিয়ারের শেষ দিকটায় এসে আমেরিকান ফুটবলের জন্য কাজ করে গেছেন কাকা। এমএলএস লীগে ওরলান্ডো সিটি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন অনেকদিন। ২০১৭ সালে ফুটবল থেকে পুরোপুরি অবসরে চলে যান কাকা। তবে ফুটবলীয় বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে কখনোই দূরে পাওয়া যায়না তাকে। ফিফার দূত হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ইউনিসেফের খাদ্যে প্রোগ্রামের অন্যতম দূত হিসেবে কাজ করছেন কাকা। রিকার্ডো কাকা'র প্রতি ভালোবাসা রইলো।  

© আহমদ আতিকুজ্জামান।