লাসিথ মালিঙ্গা: শৈশব থেকে বুড়ো হবার গল্প
পোস্টটি ৪৩০৩ বার পঠিত হয়েছেলাসিথ মালিঙ্গাকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উৎসাহ সবসময়ই বেশি ছিল। চায়ের দোকানে বসে অনেকে হয়তো শ্রীলংকার অন্য ক্রিকেটারদের চিনতো না কিন্ত ঐ বিচিত্র চুল আর আরো বেশি বিচিত্র বোলিং স্টাইল দেখলেই লাসিথ মালিঙ্গাকে চিনতে ভুল করতো না। আমি নিজেই দেখেছি মালিঙ্গা যখন বোলিংয়ে এসেছে, টিভির সামনে ১২-১৩ বছরের বাচ্চাটার চোখের আগ্রহ, দাঁত বের করা হাসি। লাসিথ মালিঙ্গা শুধু খেলেননি, দিয়েছেন আনন্দ। ২০১৯ সালের ২৬ জুলাই থেকে এই আনন্দ অনেকটাই মলিন হয়ে গেছে। কারণ এদিন সিপারামাদু লাসিথ মালিঙ্গা স্বর্ণজিৎ ওয়ানডে ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। আর শেষ ওয়ানডে খেলেন বাংলাদেশের বিপক্ষে। বাংলাদেশের শ্রীলংকা সফরে তিনটি ওয়ানডে ম্যাচের প্রথম ম্যাচেই মালিঙ্গা জানান তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের এখানেই ইতি। শ্রীলংকার প্রেমাদাসায় অনুষ্ঠিত হওয়া এই ম্যাচে মালিঙ্গার পারফর্মেন্সও ছিল দেখার মত। বোলিং করেন ৯.৪ ওভার, সাথে দুইটা মেইডেন এবং তিন উইকেট। রান দিয়েছেন মাত্র ৩৮।
লাসিথ মালিঙ্গা শুরু করেছিলেন ২০০৪ সালে। টেস্ট অভিষেকটা হয় জুলাইয়ের ১ তারিখ। আর ওয়ানডে অভিষেক হয় জুলাইয়ের ১৭ তারিখ। বিদায়টাও জুলাইতেই । টেস্ট অভিষেকটা বেশ জাঁকজমক করেই শুরু করেন। অস্ট্রেলিয়ার সাথে হওয়া তার ডেব্যু ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট এবং পরের ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়ে, ডেব্যু ম্যাচেই ৬ উইকেট নিয়ে ফেলা কম কথা নয়। সেই ম্যাচ শেষে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন মালিঙ্গা। টেস্ট ক্রিকেটটা ছেড়েছেন খুব তাড়াতাড়িই। কারণ মালিঙ্গা বেশ ইঞ্জুরি প্রবন ছিলেন। ৭ বছরে মাত্র ৩০ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। বাংলাদেশের বিপক্ষেই খেলেছেন সবচেয়ে বেশি,৭ টি টেস্ট। টেস্টে তার উইকেট সংখ্যা ১০১। ইনিংসে ৫ উইকেট আছে তিন বার। ২০১১ সালে এসে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। ওয়ানডেটা চলছিল তখনো। লাসিথ মালিঙ্গার ওয়ানডে অভিষেক হয় ২০০৪-২০০৫ এশিয়া কাপে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে,ডাম্বুলায়। সেই ম্যাচে দশ ওভার বল করে ৩৯ রান দিয়ে এক উইকেট নেন। পরের ম্যাচ ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ৯ ওভার বল করে ২৪ রান দিয়ে রাজিন সালেহ'র উইকেট নিয়ে নেন তিনি। এরপর দলের একদম পরিচিত মুখ মালিঙ্গা। নিয়মিত দশ ওভার করে বল করতেন। উইকেটও পেয়ে যাচ্ছিলেন সমান তালে।
লাসিথ মালিঙ্গা প্রথম সবার নজরে আসেন ২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। ২৮ মার্চ,২০০৭। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরপর চার বলে চার উইকেট লাভ করেন তিনি। এটি মালিঙ্গার ক্যারিয়ারে প্রথম হ্যাট্রিক। আর এর সাথে ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এক বিরল কর্মও করে ফেলেন তিনি। চার বলে চার উইকেট নেবার কোন রেকর্ড পূর্বে ছিল না কখনো। যা লাসিথ মালিঙ্গার হাত ধরেই হয়। তার বিচিত্র হেয়ার স্টাইল আর সান স্ক্রিন সাথে বিভিন্ন একসেসরিজ ব্যবহারের কারণে ২০০৭ বিশ্বকাপে বার্বাডোজ ম্যাগাজিন তাকে সেক্সিয়েস্ট ক্রিকেটার হিসেবে ট্যাগ করে। এরপর ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টুয়েন্টি ম্যাচেও মালিঙ্গা পর পর চার বলে চার উইকেট নেন। ২০০৭ সালে করা তার কির্তীই আবার দ্বিতীয়বারের মতো নিজের করে নেন তিনি। লাসিথ মালিঙ্গার ওয়ানডে ক্যারিয়ার দীর্ঘ ১৫ বছরের। এই ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি ম্যাচ খেলেছেন ২২৬ টি। বল করেছেন ১০ হাজার ৯৩৬ টি। উইকেট নিয়েছেন ৩৩৮ টি। ইনিংসে ৫ উইকেট ৮ বার। সেরা বোলিং ৩৮ রান দিয়ে ৬ উইকেট লাভ। ব্যাটিংয়ের কথায় এলে দেখা যায়, তার একটি ৫৬ রানের ইনিংস রয়েছে, যেটা তার সর্বোচ্চ। ওয়ানডেতে তার মোট রান ৫৬৭।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনটি হ্যাট্রিক করবার রেকর্ড মালিঙ্গার দখলে। ২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথম হ্যাট্রিক সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে। দ্বিতীয় হ্যাট্রিক ২০১১ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে। এবং সর্বশেষ হ্যাট্রিকটিও ২০১১ সালে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ওয়ানডেতে এখনো নবম উইকেটে সর্বোচ্চ জুটি লাসিথ মালিঙ্গা এবং এঞ্জেলো ম্যাথিউসের। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৩৬ রানের জুটি করেছিলেন সেদিন এ দুজন। মালিঙ্গার ক্রিকেটের হাতেখড়িটা শুরু হয় খুব নান্দনিকভাবে। রথগামা এলাকায় শৈশব কাটে মালিঙ্গার, সেখানেই ১১ বছর বয়স থেকেই ক্রিকেটের সাথে জড়িয়ে যান কোনভাবে। দেবপাথিরাজা কলেজে তার শিক্ষাজীবন শুরু হলেও, বন্ধুদের নিয়ে নদীর ধারে ব্যাট আর বল নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। তখন টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতেন এবং তখন থেকেই মালিঙ্গার এই অদ্ভুত বোলিং একশনের শুরু। তার বিশেষ ধরণের এই একশনের কারণে তাকে সলিঙ্গা মালিঙ্গা নামে ডাকা হতো। এরপরে গলেতে চলে যান মালিঙ্গা, সেখানে বিদ্যালোকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানে পড়াশোনাকালীন সময়ে তৎকালীন শ্রীলংকান পেসার চম্পকা রামানায়েকের নজর কাড়েন। চম্পকা তাকে গালে ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেবার জন্য পরামর্শ দেয়। মূলত এভাবেই লাসিথ মালিঙ্গার ক্রিকেটে আসা।
এরপর আর থেমে থাকতে হয় নি। ১৫ টি বছর শ্রীলংকার জাতীয় দলকে সার্ভিস দিয়ে এসেছেন, মাঝখানে ইঞ্জুরি থাকলেও খেলা চলছিলো মালিঙ্গার। মালিঙ্গা ওয়ানডেতে খুব বেশি অধিনায়কত্ব করতে পারেননি। কিন্ত টি-টুয়েন্টিতে অধিনায়কত্বের সুযোগ কাজে লাগান ভালোভাবেই। ২০১৪ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে দিনেশ চান্দিমালকে সরিয়ে টুর্নামেন্টের মাঝখানেই মালিঙ্গার কাছে ক্যাপ্টেন্সি তুলে দেয় শ্রীলংকান বোর্ড। এরপর লাসিথ মালিঙ্গার নেতৃত্বে শ্রীলংকা দল টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে নেয়। এরকম ২০১৪ সালের পর বিভিন্ন সময় তিনি শ্রীলংকা টি-টুয়েন্টি দলের ক্যাপ্টেন্সি করেছেন এবং বর্তমানেও করে যাচ্ছেন। ক্যারিয়ার শেষে শ্রীলংকা ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পারি জমানোর ইচ্ছা রয়েছে মালিঙ্গার। সেখানেই কোথাও ক্রিকেট কোচিং করাবেন এরকমটাই ভাবনা।
ওয়ানডে থেকে বিদায় বেলায় মালিঙ্গা জানান, "I feel it's the right time for me to retire from ODIs.I have been playing for the last 15 years for Sri Lanka and this is the right time to move on."
আমাদের শৈশবের যেসব ক্রিকেটার ছিল, তাদের মধ্যে লাসিথ মালিঙ্গা ছিলেন অন্যতম। মালিঙ্গার ডান বাহুতে যে ট্যাটু আছে, সেখানে তার টেস্ট ডেব্যুর তারিখ খোদাই করা। আবার তার শরীরে ২০০৭ সালে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে চার বলে চার উইকেট পাবার তারিখটা লেখা রয়েছে। তার উপস্থিতি, তার হাতের বলটাকে কিছুটা শ্রদ্ধা করে রানআপ নেওয়া, উইকেট মিস হয়ে গেলে এক বিব্রত হাসি, ৯৯ নাম্বার জার্সি আর ঐ জটা চুলে গোল হ্যাট। যারা এতদিন তার খেলা দেখে এসেছেন, তারা কিছুটা হলেও এসব মিস করবেন, অনুভব করবেন। ২০২০ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়েই যেহেতু ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন, ভালো কিছু করে কিছুটা আনন্দ পাবার অধিকার তার আছে বৈকি। ভালো থাকবেন প্রিয় শৈশব।
- 0 মন্তব্য