পোয়ের্তোর মৎস বিক্রেতার সুবাসিত ফুটবল রোমাঞ্চ!
পোস্টটি ২১৭৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
কলম্বিয়ার পোয়ের্তো উপকূলে ভোরের আলো তখনো দ্বিকবিদিক পৌঁছায় নি। ভোরের এই সময়টায় শহরের অন্য প্রান্তের মানুষজন যখন নিঃস্তব্ধতার চাদরে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে রইছে; পোয়ের্তো তখন স্বমহিমায় তার কর্মব্যস্ততার কথা দেশব্যাপী জানান দিচ্ছে। জেলে'রা ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করে দিয়েছে। প্রভাত থেকে গোধূলি- তাদের ব্যস্ততার অন্ত নাই।
পোয়ের্তো দুটো বিশেষ কারনে কলম্বিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর একটি। একে-তো এখানকার জেটিগুলো বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত; ইউরোপীয়ানদের কলম্বিয়ায় ঢুকার দ্বিতীয় বৃহত্তম পথ। অন্য কারনটা হলো এখানকার মৎস। দেশে মাছের মোট চাহিদার বিরাট অংশই আসে এই উপকূল থেকে। কয়েক শ্রেনীর মানুষ এখানে কাজ করে দিনরাত। কেউ জেলে, কেউ বিক্রেতা; কেউবা আবার নিতান্তই শ্রমিক৷ নিন্মবিত্তের এই মানুষেরা অক্লান্ত খেটে যায় দুমুঠো খাবার জোগাড়ের নেশায়।
পোয়ের্তোর ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশ।
সুন্দর আরেকটি দিনের সূচনা হতে চলেছে। জেলে'রা নিজ নিজ কাজে লেগে পড়েছে। কালোর্স'কে কাজে দেখতে না পেয়ে রিকো যেন খানিকটা বিস্মিত হয়ে গেলো। এমনটা কখনোই হয়নি বিগত দিনগুলোতে। রিকো ভাবলো কার্লোসের অসুখবিসুখ হয়েছে কিনা! তবে খানিক পরেই চিন্তিত হয়ে পড়লো সে। দু'দিনও আগেও তো দিব্যি ভালো ছিলো।
কার্লোস তার বাল্যকালের বন্ধু৷ তারা একই সাথে বেড়ে উঠেছে এই উপকূলীয় শহরে৷ সুখেদুঃখে একে অপরের পাশে থেকেছে। রিকোর সাথে কার্লোসের সবচেয়ে বড় যে অমিল, তা হলো রিকো কার্লোসের মতো ততোটা ধার্মিক না। ঈশ্বরে কার্লোসের অগাধ বিশ্বাস। নিয়ম মেনে উপাসনালয়ে ভীড়ে। আনমনে এসব কথা ভাবতে গিয়ে রিকো ভাবলো কার্লোস হয়তো উপাসনা করছে৷ পরক্ষনে মনে হলো- এখন নিশ্চয়ই সে উপাসনালয়ে যাওয়ার কথা না। রিকো কার্লোসের খুঁজে বের হলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে তাকে পাওয়া গেলো সমুদ্রতীরে। উদোম গায়ে বসে আছে মুর্তির মতো। সূর্যের তির্যক আলো এসে পড়ছে তার সমস্ত গা জুড়ে। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ভাবছে অন্য জিনিস। একদিন সে ফুটবলার হবে, দর্শকেরা তার নামে সম্মলিত জয়ধ্বনি গাইবে। বৃদ্ধ বাবা- মা'কে খাবার জোগাড়ের আশায় কাজ করতে হবেনা৷ আর তাকেও মাছ শিকার কিংবা বিক্রি করে অনেকগুলো জীবন চালাতে হবে ন। তাদের সুন্দর একটা বাড়ি থাকবে- গাড়ি থাকবে। ছুটিতে ইউরোপে ঘুরতে যাবে তারা…
'এখানে বসে আছো কেন কার্লোস? কি হয়েছে তোমার?'
রিকোর কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেলো কার্লোস। কি সব আজগুবি কথাবার্তা ভাবছিলো সে! নিশ্চয়ই সেগুলো রিকোর সাথে আলাপ করা যাবে না। রিকো কেন, যে কেউ-ই হাসাহাসি করবে এসব শুনে৷ তারচেয়ে বরং অন্য কিছু নিয়ে আলাপ করা যাক৷ কার্লোস বললো, 'রিকো, তুমি কি আমাকে অন্যে একটি চাকরি খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারবে?' রিকো অবাক চোখে জানতে চাইলো- কি চাকরি? আর মাছ বিক্রি করা বন্ধ করে দিবে?
কার্লোস নিচু গলায় জানালো শুধু মাছ বিক্রি করে তার হচ্ছে না। পাশাপাশি অন্যে কিছু একটা করতে হবে৷ নয়তো খাবার জুটবেনা। কিছুক্ষণ ভেবে রিকো একটা প্রস্তাব দিলো। তার দুঃসম্পর্কের এক চাচা আছেন, শহরে বাস চালান। তাকে বলে দেখতে পারে সে। চাকরি হলো বাস কন্ডাক্টরের। কার্লোস রাজী কিনা জানতে চাইলো। কার্লোস কিছু বললো না, শুধু স্মিত হাসলো৷
সপ্তাহ খানেক পরে রিকো'কে অবাক করে দিয়ে বাস কন্ডাক্টরের পেশায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করলো কার্লোস। অবশ্য রিকো'ই ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ সেজন্য ঈশ্বরের কাছে রিকোর জন্য প্রার্থনাও করলো কার্লোস। চাকরি'টা খুব সহজ না। সপ্তাহে তিন দিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসে ডিউটি৷ অল্প ক'টা টাকা। বাকি দিনগুলোতে তার বাবা গিলবার্তোর সাথে মাছ বিক্রিতে সাহায্যে করে সে। রাতে টিভি সেটের সামনে বসলে কতকিছু দেখা যায়। তবে তার সবচেয়ে প্রিয় যে জিনিস, ফুটবল দেখার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে থাকে৷ আর ভাবে, হায় ঈশ্বর- আমি যদি বড় মানের ফুটবলার হতে পারতাম!
এটা গল্পের অন্য আরেকটি অধ্যায় রয়েছে। সে অধ্যায়ের সাথে পরিচিত করে দেয়া উচিত আপনাদের।
কার্লোস যখন খুব ছোট, তার বাবা- মা তাকে বিভিন্ন জিনিস উপহার দিতেন। বলা বাহুল্য, সেগুলো দামি ছিলো না। তাকে গাড়ি কিনে দেয়া হতো। কিন্তু তাতেও তার মন ভরতো না। তার চাই ফুটবল! বয়স তিনেক ছাড়িয়েছে কার্লোস, তার পছন্দের খেলা ফুটবল৷ স্কুলে তার মনোযোগের স্থান মাঠে। সে যত বড় হতে থাকলো, ফুটবলের প্রতি তার আকর্ষণটা বাড়তে থাকলো। একটা সময় গিলবার্তো ভাবলেন, ছেলের এতো উৎসাহ ফুটবলে; তবে তাকে ফুটবল খেলতে দেয়া হোক। কার্লোসের বয়স যখন নয়, তাকে স্থানীয় এক একাডেমিতে ভর্তি করে দেয়া হলো। একাডেমির ইন্সট্রাক্টর হলেন রাফায়েল রায়েস লক্ষ্য করলেন এই ছেলের মধ্যে কিছু একটা তো অবশ্যই রয়েছে। মাঠে সবাই যখন একা একা প্রেক্টিস করছে, সে দেখা যায় আরোও ২-৪ জনকে প্রেক্টিস করাচ্ছে! বিষয়টা নজর এড়ালো না রায়েসের। তিনি দেখলেন কার্লোসের বেশ কিছু স্কিল মুগ্ধ করার মতো, ফিনিশিং নিখুঁত। তাকে দিয়ে হবে।
সেই একাডেমিতে টানা ৭ বছর কাটিয়েছে কার্লোস। এই দিনগুলোতে সে অনেক কিছুই শিখেছে৷ তার বাবা গিলবার্তো লক্ষ্য করলেন ছেলে যথেষ্ট দায়িত্ববান হয়েছে। অভাব অনটনের সংসার তাদের৷ তবু সন্তানের জন্য সেরাটা করার প্রতিশ্রুতি দেয়ার সংকল্প করতে দ্বিধাবোধ করেন না। কার্লোস একাডেমিতে খেলার পাশাপাশি বাবা-মা'কে সাহায্যে করে মাছ বিক্রি করতে৷ পোয়ের্তোয় প্রায়ই মাছ শিকারে যায় সে। হয়তো জেনে গিয়েছে এভাবেই তার জীবন চলে যাবে। হয়তো এভাবেই চলতে শিখে গেছে।
একাডেমিতে বাকি পাঁচ-সাতজনের চেয়ে কার্লোস এগিয়ে ছিলো তার ঠান্ডা মাথার নিখুঁত ফিনিশিংয়ের জন্য। ৭ বছরের একাডেমি জীবন অবশেষে তাকে অন্য এক জীবনের জন্য আহ্বান করলো যেন। পোয়ের্তোর কোলাহলময় সান্ধ্য নগরীতে এক বার্তা এলো গিলবার্তোর পরিবারে।
কার্লোসের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছেন এতলেটিকো জুনিয়ার ক্লাবের স্কাউটেরা। তারা তাকে দলে বেড়াতে চান! কার্লোসের পরিবার যেন হতভম্ব হয়ে গেলো কয়েক মুহুর্তের জন্য।
এতলেটিকো জুনিয়ার হচ্ছে ব্যারাঙ্কুইলা প্রদেশের ক্লাব যারা কলম্বিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের লীগে খেলে থাকে। ২০০৬ সাল। কার্লোসের বয়স তখন মাত্র ২০। একুশে পেরোবার আগেই এতলেটিকো জুনিয়ার ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করলো কার্লোস!
তবে বাসে কন্ডাকটরের চাকরি সে ছেড়ে দিলো না! কারণ, প্রথম মৌসুমে ক্লাবের হয়ে খেলার খুব বেশি সুযোগ পায়নি সে৷ বাস কন্ডাক্টরের চাকরি ছেড়ে দিলে খাবে কি! পরের বছর অবশ্য ক্লাব তাকে ব্যারাঙ্কুইলা এফসি ক্লাবে পাঠিয়ে দিলো লোনে। সেখানে একজন মৎস বিক্রেতা তার ফুটবল প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পেলো। ক্লাবের হয়ে ১ ডজন গোলও করলো সে৷ পরের বছরই ভেনিজুয়েলার একটি ক্লাব তাকে সাইন করলো ১ বছরের চুক্তিতে। সেখানেও তার ফুটবল প্রতিভার সাক্ষরতা মিললো। ফলস্বরুপ, ব্যারাঙ্কুইলা তাকে আবারো ফিরিয়ে আনলো নিজেদের ঢেরায়।
ততোদিনে কার্লোসের অভাবের সংসারে কিছুটা হলেও স্বস্তি এসেছে। খাবার জোগাড়ের নেশা এখন আর তাকে পেয়ে বসে না। রাত হলেই সে চলে যায় না মাছ ধরতে। যদিও রিকো'দের সাথে বিকেলে সমুদ্রপারে ফুটবল খেলতে পারছেনা বলে সে খানিকটা হতাশ৷ পরক্ষণেই সে ভাবে, আমাকে তো আরোও ভালো খেলতে হবে। নইলে মানুষ আমাকে চিনবে কি করে? দর্শকেরা আমার নামে জয়ধ্বনি গাইবে কিভাবে? বাবা- মা'য়ের অভাবের সংসার আমি ঠিকই গুছিয়ে দেবো। আমার বাড়ি- গাড়ি সব থাকবে৷
২০০৮ সাল।
লোনে আবারো কলম্বিয়ার দ্বিতীয় সারির ক্লাব 'ব্যারাঙ্কুইলায়' ফিরে এসেছে কার্লোস। তাকে আরোও বেশি উদ্যমী মনে হচ্ছে। মাঠে তার প্রতিভার ফুলঝুরি ফুটতে শুরু করেছে ততোদিনে। অবশ্য মাঠে তার সেরাটা দেখা গেলো সে-বছরই। ১৯ ম্যাচে ১৪ গোল করে লীগের টপ স্কোরার বনে যাওয়া কার্লোস'কে ততোদিনে অনেকেই চিনে ফেলেছে৷ পরের বছর-ই কলম্বিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব এতলেটিকো জুনিয়ার ক্লাবের হয়ে প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরু হয়ে গেলো কার্লোসের।
একজন মাছ বিক্রেতার স্বপ্ন কতটুকু বিস্তৃত থাকতে পারে? অখ্যাত থেকে রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া যতটুক সহজ, একজন মাছ বিক্রেতার সংগ্রামী জীবন এমন চোখের পলকেই বদলে যাওয়া সম্ভব না। তবে ঈশ্বরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, দায়িত্বশীল আচরন, কঠোর পরিশ্রম আর প্রতিভার সঠিক বিস্তরন ঘটাতে পেরেছিলো বলেই কার্লোস তার স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে! দামি কাপড়চোপড় কিংবা বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটানো যেখানে তার কাছে দুষ্প্রাপ্য মনে হতো; সেগুলো যেন আপনাআপনি এসে ধরা দিলো সামনের দিনগুলোতে।
২০০৯ সালে প্রফেশনাল ক্যারিয়ার শুরুর পর তিনটি বছর পার হয়ে গেছে। এতলেটিকো জুনিয়ার ক্লাবের হয়ে ততোদিনে গোলের অর্ধশতক করে ফেলেছে সে। তাকে দলে বেড়াবার জন্য অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে! বিশেষ করে 'লকোমোটিভ মস্কো' কিংবা 'শেইভো'র মতো রাশিয়ান ক্লাবগুলো। তখন বলছিলাম তাকে ততোদিনে অনেকেই চিনে ফেলেছে; হুম, অনেকেই চিনে ফেলেছে। না চিনার কারণও নেই, এতলেটিকোর মেইন টিমে জায়গা পাওয়ার পর ওই বছরই কোপা কলম্বিয়ার সর্বোচ্চ গোলদাতা হলো সে। পাশাপাশি টানা দুই বছর লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা থেকে দু'বারই ক্লাবকে জিতিয়েছে লীগ শিরোপা। তবে রাশিয়ান ক্লাবগুলোয় তার আর যাওয়া হলোনা৷
এরই মধ্যে কলম্বিয়া জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয়ে গেলো কার্লোসের। ২০১০ সালের আগষ্টে বলিভিয়ার বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করার ম্যাচে একমাত্র গোলটাও এসেছে তার পা থেকে। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ২৩ জনের স্কোয়াডে ছিলো সে। যদিও মাত্র একটি ম্যাচেই তাকে দেখা গিয়েছিলো। ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ২-১ গোলের হারার ম্যাচে। পরের বছর কোপার জন্যও তাকে দলে নেয়া হয়। তবে দূর্ভাগ্যবশত সেবারও সে জ্বলে উঠতে পারেনি। ২০১৮ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে তারা রাখা হয়েছিলো। ৫ ম্যাচে মাত্র ১৮ মিনিট খেলার সুযোগ পেয়েছিলো সে। যদিও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রাউন্ড অব সিক্সটিনের স্টেজে পেনাল্টি মিস করে দলকে নিয়ে বিদায় নেয় বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে!
প্রতিটি ফুটবলারের-ই স্বপ্ন থাকে ইউরোপে খেলার। কার্লোসেরও ছিলো। তবে খেলার না, ছুটিতে ইউরোপে ঘুরার! ২০১২ সালে কার্লোসকে আর ধরে রাখতে পারলো না এতলেটিকো জুনিয়ার। বেলজিয়ান 'ক্লাব ব্রাগের' সাথে ৩ বছরে দেড় মিলিয়ন ইউরোর চুক্তিপত্রে সাক্ষর করে অবাক হয়ে গেলো কার্লোস! পোয়ের্তোর যে ছেলে সমুদ্রতীরে রিকো, আঞ্জেলো, গুরেইরো'দের সাথে অর্ধনগ্ন হয়ে ফুটবল খেলতো, সে কিনা যাচ্ছে ইউরোপে খেলতে! আর এতো পরিমান অর্থ! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় কার্লোসের৷ ঈশ্বরকে অতি সন্তর্পণে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করে না সে।
এতক্ষন কার্লোস নামে যার গল্পের অবতারণা করছিলাম, তাকে নিশ্চয়ই আপনারা চিনে থাকবেন। যদিও সে কোনো গ্রেট ফুটবলার নয়, কারো সমকক্ষ হিসেবেও দাঁড় করাতে পারেনি নিজেকে। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো ফুটবলারও সে নয়। ২৩ বছর বয়সে মেসি যখন বিশ্বের শ্রেষ্ট ফুটবলারের মর্যাদা পেয়ে গেছে, কার্লোস সে বয়সে পোয়ের্তোয় মাছ বিক্রি করেছে, বাসের হেল্পার হিসেবে কাজ করেছে। এদিক দিয়ে তাকে চেনা কষ্টকর হয়ে যাবে। ২০১৫ কোপা আমেরিকার কথা মনে আছে আপনাদের? ব্রাজিলের বিপক্ষে ১-০ গোলে জয়ের ম্যাচে নেইমারকে ধাক্কা মেরে মাঠিতে ফেলে দিয়ে লাল কার্ড এবং ২ ম্যাচের জন্য যে নিষিদ্ধ হয়েছিলো তার কথা মনে আছে? জ্বি, আমি তার কথাই বলছি। গল্পটা কার্লোস আর্থুরো বাক্কা আহুমাদা'র!
২০১২-১৩ মৌসুমে বেলজিয়ান ক্লাবটির হয়ে তার আগুনঝরা পার্ফমেন্স দেখা গেলো। লীগের শীর্ষ গোলদাতা হিসেবে সেবার কার্লোস বাক্কা, 'প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার' এর জন্য মনোনীত হলো এবং সপ্তাহখানেক পর এওয়ার্ডটা জিতেও নিলো! এক টুইটার বার্তায় শুভাকাঙ্ক্ষীদের ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে বললো- বিশেষ করে এই পুরষ্কারটা কলম্বিয়া বাসীর জন্য!
২০১৩ সালে কার্লোস বাক্কা পাড়ি জমালো স্পেনিশ ক্লাব সেভিয়া'য়। ৫ বছরের চুক্তিতে ৭ মিলিয়ন ইউরোতে তাকে দলে ভেড়ায় সেভিয়া। ২০১৪ সালে মার্কা কার্লোস বাক্কা'কে লা-লীগায় মৌসুমের সেরা সাইনিং হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সে বছর নেইমার- ডি'মারিয়াদের পিছনে ফেলে মৌসুমের সেরা দক্ষিন আমেরিকান ফুটবলারের তকমাটাও জিতে নেন কার্লোস বাক্কা! পোয়ের্তোর উপকূল থেকে উঠে আসা এক ফুটবলার স্পেনিশ ক্লাবের হয়ে টানা দুই মৌসুমে ইউরোপা লীগ জয় করে ফেললো!
২০১৫ সালের জুলাইয়ে 'বাই আউট ক্লজ'র ৩০ মিলিয়ন পরিশোধ করে তাকে দলে ভেড়ানোর ঘোষণা দিলো ইতালিয়ান জায়ান্ট এসি মিলান। প্রথম মৌসুমে নিজেকে কিছুটা প্রমান করতে পারলেও পরের মৌসুমেই নিঃপ্রভ হয়ে পড়েন কার্লোস বাক্কা। ফলে দুই মৌসুমে মিলানের হয়ে ৭০ ম্যাচ খেলে ক্লাবকে বিদায় জানাতে হয়ে বাক্কার৷
২০১৭ সালে এসে আরেক স্পেনিশ ক্লাব ভিয়ারিয়াল ঘোষনা দেয় বাক্কাকে এক বছরের লোনে দেড় মিলিয়নে দলে যুক্ত করার। পাশাপাশি তারা চুক্তিতে তাকে কেনা অপশনও রাখে তারা৷ চারদিন পরই এক লীগ ম্যাচে তার অভিষেক হয়ে যায়। অবশেষে পরবর্তী মৌসুমে তাকে কিনে ফেলে ভিয়ারিয়াল।
পোয়ের্তোতে আপনি কার্লোস নামের কাউকে খুঁজ করলে তারা মোটেও চিনবেনা। কার্লোস বাক্কা বললেও না চেনার ভান করে বলবে, কোন কার্লোস বাক্কা? তবে প্রথমেই যদি জিজ্ঞেস করেন 'দ্যা উইগ' এর বাড়িতে কোনদিকে? তারা সোজাসুজি আপনাকে তার বাড়িতে নিয়ে পৌঁছে দিবে। উইগ মানে হলো পরচুলা। ছোটবেলায় কার্লোসের চুল ছিলো মাথাভর্তি, আর তাতেই কিনা এ অদ্ভুত নাম!
শুরুতেই বলেছি কার্লোস বাক্কা প্রচন্ড ধার্মিক। একবার সে রোমা'তে খেলতে চেয়েছিলো, কারণ
সে পোপের কাছাকাছি থাকতে পারবে বলে! তার ফুটবল আইডল ব্রাজিলিয়ান রোনাল্ডো ফেনোমেনন। ৮ বছরের বিবাহিত সুখের সংসারে দুই পুত্র সন্তান রয়েছে বাক্কা'র।
© আহমদ আতিকুজ্জামান
- 0 মন্তব্য