• ফুটবল

গান, ফুটবল কিংবা মুক্তি!

পোস্টটি ২৬৯২ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

একবার এক সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, মার্লে, আপনাকে জানার সবচেয়ে উত্তম পন্থা কোনটি? বব মার্লে এই প্রশ্নের সাথে পূর্বপরিচিত। উত্তর দিতে দেরি হয় না। আকাশের দিকে মুখ তুলে উদাস হয়ে তাই পূর্বেও করা তার উক্তিটা-ই উত্তর হিসেবে বেছে নেন। মার্লে বলেন, 'আপনি যদি সত্যিই আমাকে জানতে চান, তাহলে আপনাকে আমার এবং উইলার্সের বিপক্ষে ফুটবল খেলতে হবে।' এটি তার বাস্তব রূপ এবং তার পরিচয়ের একটি অংশ। 

অথচ মার্লে ছিলেন এরচেয়েও বেশি কিছু। মার্লে কোনো প্রফেশনাল ফুটবলার ছিলেন না, যাকে চেনার জন্য তার বিরুদ্ধে ফুটবল খেলতে হবে। বৈচিত্র‍্যপূর্ণ জীবনপ্রবাহ এই মানুষটাকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। ততোদিনে তিনি জনপ্রিয় হয়ে গেছেন৷ তার সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য অনেকেই অস্থির হয়ে উঠে। বিভিন্ন সময়ে দেয়া সাক্ষাৎকারে তার মানবচরিত্রের বিশেষ একটি দিক ফুটে উঠে। আর সেটি হচ্ছে অর্থের প্রতি অনাকৃষ্টতা। বস্তি থেকে উঠে আসা যে তরুন পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপি সাড়া ফেলে প্রায় ২০ মিলিয়ন কপি গানের রেকর্ড বিক্রি করেছিলো- সে হচ্ছে বব মার্লে৷ তবে অর্থের লোভে জীবনকে কয়লা বানিয়ে না দেয়ার আরেক উদাহরণও বব মার্লে৷ 

সত্তরের দশকে বিশ্বব্যাপি বব মার্লের নাম ছড়িয়ে গেছে। খুব কম সময়ে এতোটা খ্যাতি পাওয়া বিশাল ব্যাপার। তিনি ছিলেন থার্ড ওয়ার্ল্ডের প্রথম কোনো সুপারস্টার; যাকে জাতিসংঘ ভুষিত করেছে শান্তি পদকে। তিনি গান গাইতেন শান্তির, মুক্তির। সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো তার কন্ঠ। 'বাফেলো সোলজার', 'নো ওম্যান, নো ক্রাই', 'গেট আপ স্ট্যান্ড আপ', 'ব্ল্যাক প্রগ্রেস'-এর মতো অনেক ভুবনকাঁপানো গান দিয়ে সংগীত প্রেমীদের মন জয় করেছিলেন বব মার্লে।

লাল গিবসন গিটার, মারিজুয়ানার কুঁড়ি, একখানা বাইবেল আর একটা ফুটবল; এই চারটা জিনিস ছিলো মার্লের জীবনের সর্বাধিক প্রিয়। ধর্ম, গান এবং ফুটবল- একটা মানুষের বেঁচে থাকার উপজীব্য বিষয় হতে পারে, ভাবতে অবাক লাগে। এই তিন জিনিসে মার্লে পেয়েছিলেন মুক্তি। মুক্তি কি জিনিস তার কাছে একবার জানতে চাওয়া হয়েছিলো; তিনি অল্পকথায় জবাব দিয়েছেন। 'বন্দী'র ন্যায় জীবনের প্রত্যেকটা দিন কাটানোর চেয়ে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে মৃত্যু শ্রেয়।' 

TELEMMGLPICT000211566517_trans++hywjgWHgsulPJlKgP99X6bfvtalZ_QX0tkkuNE0oBks

প্রশ্নকর্তার জিজ্ঞাসা ছিলো 'গানের পূর্বে যদি ফুটবল আপনাকে আবিষ্কার করতো, কেমন হতো ব্যাপারটা? বব মার্লের উত্তর, 'ফুটবলের পূর্বে আমি আমার গানকে ভালোবাসি। যদি ফুটবলকে সর্বাধিক ভালোবাসতে চাই তাহলে সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। গান এবং ফুটবল একসাথে চালিয়ে নেয়াও বিপদজনক। কারণ কখনোকখনো ফুটবল উগ্র হয়ে যায়। আমি গান করি শান্তির, ভালোবাসার ৷ কেউ যদি আপনাকে কঠিনভাবে ট্যাকল করে তাহলে সেটি যুদ্ধ সমপর্যায়ের আবেগ।' 

ফুটবল বব মার্লের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল? 

উত্তর'টা সহজ; তবু আরো সহজ করে দিয়েছেন মার্লের একসময়ের বন্ধু নেভিল গ্যারিক, যিনি কিনা দীর্ঘদিন মার্লের আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। নেভিল পুরনো দিনের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ভাঙ্গা স্বরে তবু বলে যান, 'প্রত্যেকবার আমরা যখন ট্যুরে যেতাম, আমাদের সাথে ফুটবল থাকতো। মার্লে টিভি ছাড়া বাসে উঠতো না, শুধুমাত্র ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য। যত জায়গায় আমরা ট্যুরে গেছি, হোটেলের আশেপাশে খোলা জায়গায় ফুটবল খেলেছি, কিংবা পার্কিং লটে। আর হোটেলে আমরা প্রেসিডেন্টশিয়াল স্যুট ভাড়া করতাম৷ কারণ আমরা বাইরে খেতাম না, নিজেরাই রান্না করে খেতাম। প্রেসিডেন্টশিয়াল স্যুটের সুবিধা হলো এখানকার ডাইনিং টেবিল বৃহদাকার। আমরা *মানিবল* খেলতাম। ফুটবলকে আমরা মানিবল নাম দিয়েছিলাম কারন খেলতে গিয়ে যদি কেউ কিছু ভেঙ্গে ফেলে, তবে তাকে সেটির মূল্য দিতে হতো। তবু আমাদের ফুটবল খেলাই লাগবে।'

কার্ল ব্রাউনের নাম জ্যামাইকান ফুটবল ইতিহাসের পাতায় শক্তপোক্তভাবে গেঁথে আছে বহুদিন ধরেই৷ সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক কাঁপানো এই তারকা একবার এক সাক্ষাৎকারে  বব মার্লের ফুটবল আসক্তি ব্যাখ্যা করেন এভাবে- 'বয়েজ টাউনে আমি মার্লেকে ফুটবল খেলতে দেখতাম। সেই সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটে অব্দি৷ ট্রেঞ্চ টাউনের তরুনদের কাছে বয়েজ টাউনে ফুটবল খেলতে পারা'টা স্বপ্নের মতো। সত্যি কথা বলতে কি, আমি এখনো খুঁজে বের করতে পারিনি মার্লে কোনটা বেশি ভালোবাসতো- ফুটবল নাকি গান?   

আচ্ছা, 'বব মার্লে কি খুব ভালো মানের ফুটবলার ছিলেন?'

এই প্রশ্নটি নিশ্চয়ই পাঠকদের কৌতুহলী মনের আঙ্গিনায় কড়া নাড়ে। তবে এ প্রশ্নের উত্তর খুব বিদঘুটে এবং একইসাথে হ্যাঁ না এর সাম্যাবস্থা বজায় থাকে উত্তরে। মার্লে টেকনিক্যাল ফুটবল ছিলেন। তার সাথে যারা খেলেছে, তাদের অনেকেই বলেছে 'কখনো ভুলেও মার্লেকে ট্যাকেল করতে যাবে না। এতে নিজেই কষ্ট পাবে।' এ কথা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় মার্লে শক্তিশালী ফুটবলার ছিলেন। তবে তার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা ছিলো উচ্চতা। সে ছিলো ছোটখাটো মানুষ। ম্যাচ হেরে গেলে সে খুবই রাগান্বিত ও বিরক্ত হতেন তার উচ্চতার কারনে। তাছাড়া তিনি হার মেনে নিতে পারতেন না। ফুটবলকে সবসময় তুলনা করতেন মুক্তির সাথে। 'আমি এই মুক্তি চাই, ফুটবল মানে হলো হলো মুক্তি'- মার্লে সবসময় বলতেন। 

cb196cac9a59104f2cb8f0a2b2164245

উইলার্সরা মার্লেকে ডাকতো মিডফিল্ড জেনারেল নামে। নেভিল গ্যারিক ব্যাখ্যা করেছেন ফুটবল ম্যাচে মার্লের প্রভাব কতটুকু। 'সে কখনো বল হারাতে চাইতো না। ওর দৌড়, শক্তিমত্তা অন্য সবার চেয়ে আলাদা ছিলো৷ মিডফিল্ডে তার প্রভাব ছিলো প্রফেশনাল ফুটবলারদের মতোই। সে ছিলো আগ্রাসী মনোভাবের মানুষ। যখন কিক করতো তখন সত্যিকার অর্থেই কঠিনভাবে কিক করতো। মার্লের ক্ষিপ্রগতির কিকের কারনে আমরা অনেক বল হারিয়েছি৷' হেসে উঠেন নেভিল। আবারো যোগ করেন, 'মার্লে শুনলে হয়তো রাগান্বিত হতো, প্লেয়ার হিসেবে তাকে আমি ১০ এ ৬.৭ দিবো। বড় মাঠে মার্লে খুবই আক্রমনাত্মক ফুটবল খেলতো। যখনই সুযোগ পেতো, গোল করার চেষ্টা করতো।' আইল্যান্ড রেকর্ডের ডিস্ট্রিবিউটর ট্রেভর ওয়েট বলেন, 'আপনি মার্লের কাছ থেকে বল নিবেন? সেটা আশাতীত ব্যাপার৷'  

মার্লের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিলেন এলান কোল; যিনি এলান 'স্কিল' কোল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। এলানের ব্যাপারে কিছু বলা প্রয়োজন। এলান ছিলেন সেসময়কার জ্যামাইকার সবচেয়ে সেলিব্রেটেড প্রফেশনাল ফুটবলার। নর্থ আমেরিকান লীগ, ব্রাজিলিয়ান ডিভিশন এবং হাইতির এক ক্লাবের হয়েও খেলেছিলেন তিনি। পাশাপাশি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে জ্যামাইকার জার্সি জড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে তার। মার্লে প্রায়ই আফসোস করে বলতেন, ইশ, এলান যেভাবে ফুটবল খেলে আমি যদি সেভাবে গান গাইতে পারতাম। কোল ছিলেন সঙ্গীতের ভক্ত, আর মার্লে ফুটবলের। যদিও পরিবর্তীতে কোল বনে যান মার্লেদের ব্যান্ড ম্যানেজার। কোল তাদেরকে ট্রেইনিং দিতেন, একসাথে ফুটবল খেলতেন। মার্লেকে দেখে অবাক হয়ে যেতেন কখনোকখনো, সে কোনটা বেশি সিরিয়াসলি নিচ্ছে- ফুটবল নাকি মিউজিক; তিনি দ্বিধায় পড়ে যেতেন।  

ফুটবল মার্লেকে কি দিয়েছে, কি নিয়েছে?

নিঃসন্দেহে ফুটবলে মার্লে খুঁজে পেয়েছিলেন মুক্তি। সাদাকালো বৈষম্য কিংবা অসমতার বিরুদ্ধে কথা বলতো তার গান, প্রেক্টিক্যালি কথা বলতো তার দু'পা। বিশ্বব্যাপি নানা জায়গায় ঘুরেছেন কনসার্টের জন্য, কখনোওবা রেকর্ড বিক্রির জন্য। সে সময়গুলোতে ফুটবল ছিলো তার সঙ্গী। সাদাকালো বৈষম্য ভুলে সবাই এক কাতারে সামিল হয়েছে মার্লের সাথে ফুটবল খেলতে। তার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিলো কিংস্টনের জাতীয় স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলবে; সে ইচ্ছাও পূরন হয়েছে। DnEN3SSWwAI7Uvc

মার্লের জীবনের সর্বনাশে ডেনি বেকার কিছুটা দায়ি। ১৯৭৭ সালের ব্যাটারসি পার্কের ওই ম্যাচে ডেনি বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করেন মার্লের বৃদ্ধাঙ্গুলে। ইঞ্জুরড হয়ে মাঠ থেকে নেমে যান মার্লে। এটা ছিলো দ্বিতীয় আঘাত। ওই বছর প্যারিসে আরেক সাংবাদিক ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত করেন। তবে এটিই প্রথম না, ১৯৭৪ সালে ট্রেঞ্চটাউনের এক ম্যাচ বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হন মার্লে।  

বৃদ্ধাঙ্গুলির আঘাতকে কেউই গুরুত্বের সাথে নেয়নি, এমনকি মার্লে নিজেও না। তবে এতোদিনে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। রেগুলার চ্যাকআপ করতে গিয়ে তার স্কিনে ধরা পড়ে 'ম্যালানমা' ক্যান্সার। মার্লে জার্মানির এক ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা করান। তবে কেউ জানতো না তার জীবন তখন ঠিকে আছে তীরে এসে ডুবতে থাকা তরীর মতো। তবে মার্লে কোনোভাবেই হাল ছাড়লেন না। তিনি তার গান, ট্যুর, এলব্যাম- ফুটবল সব চালিয়ে গেলেন। অনেকসময় দেখা যেত মার্লের দু'পায়ে দুধরনের জুতা। কিংবা কখনো শুধু স্যান্ডেল পরে স্টেজে গান গাইছেন। কারন পায়ের ক্ষতটা শুকায়নি ঠিকমতো; রক্ত বের হতো ক্ষনে ক্ষনে৷ ১৯৮০ সালে মিলানের সানসিরো স্টেডিয়ামে প্রায় ১ লাখ মানুষের সামনে ম্যাজিক পার্ফমেন্স করলেন বব মার্লে। সে কনসার্টের মাত্র দু মাস পার হতে না হতেই জানা গেলো ক্যান্সার ইতিমধ্যে তার সমস্ত ব্রেইনে ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকান এক নিউরোলজিস্ট তাকে মাত্র একমাত্র বেঁচে থাকার সংবাদ শুনান।   

তারপরে কেটে যায় প্রায় কয়েক মাস। মার্লে প্রতিদিন ভোরে নতুন সব টিউন রেকর্ড করেন। উইলার্সরা তার সাথে আলাপ করতে আসে৷ মার্লের অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে থাকে। মৃত্যুর পূর্বে শেষ জন্মদিন পালন করতে জার্মানিতে উপস্থিত ছিলেন নেভিল। মার্লে তখন হসপিটালে। জানালেন তিনি মৃত্যুর পূর্বে তার স্মৃতি বিজড়িত জ্যামাকাইতে যেতে চান। দিনদিন ভেঙ্গে পড়ছিলেন মার্লে। সবাই তাকে আশ্বস্ত করে। জ্যামাইকা যাওয়ার প্রস্তুতিও নেয় তারা। তবে শারীরিক অবস্থা দ্রুত অবনতি হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।  

মৃত্যু প্রসঙ্গ এলে আমি সবসময়ই একটা কথা বলি। 'মৃত্যু হচ্ছে সেটা যখন আপনার নাম কেউ আর নিচ্ছে না।' জীবিত বব মার্লের চেয়ে মৃত বব মার্লেকেই মানুষ বেশি মনে রেখেছে। শেষ নিঃশ্বাসের পর প্রায় চার যুগ পেরিয়েছে। বব মার্লে একটুও ম্লান হন নি। বরং আগের চেয়েও অধিকতর উজ্জ্বল দীপশিখার মতো বিশ্বব্যাপি গান প্রেমিদের হৃদয়ের গভীরে টাই করে নিয়েছেন। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই, কথা'টা যেন বারবার স্মরণ করিয়ে দেন বব মার্লে।    

মার্লের মৃত্যুর পরের কথা।

ফুটবল'টা মার্লের পরিবারে অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে ততোদিনে। ১৯৯৮ সাল ছিলো প্রতিটা জ্যামাইকানের শ্রেষ্ট সময়৷ সেবার তারা জায়গা করে নিয়েছিলো বিশ্বকাপের মঞ্চে! কখনো বিশ্বকাপ খেলা তো দূরে থাক, কোয়ালিফাইংয়ের বাঁধা পেরুতে না পারা একটা জাতি কিংবা ফুটবল দলের জন্য এটি কতটুকু আনন্দের বিষয় হতে পারে তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। ফ্রান্সে বিশ্বকাপ খেলতে যাবে তাদের দল, ম্যাচের আগে হাজার হাজার দর্শকের সামনে বুকে হাত রেখে গাইতে পারবে জাতীয় সঙ্গীত। বিশ্বকাপের জন্য '৬২ সালের জাতীয় সঙ্গীত'টাতে সুর দিলেন ঝিগি মার্লের, যিনি বব মার্লের বড় ছেলে। বিশ্বকাপ খেলার আনন্দে, নতুন উদ্যমে  তিনি রেকর্ড করে ফেললেন *রেগে বয়েজ*দের জাতীয় সঙ্গীত।  

১৯৯১ সালে হাইতির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করেছিলো জ্যামাইকার জাতীয় প্রমিলা ফুটবল দল। তবে তা কেবল স্মৃতি হতে থাকলো পরবর্তী বছরগুলোতে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেলো মেয়েদের ফুটবল। শেষমেশ ২০০৭ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে না পারা এবং ২০০৮ অলিম্পিকেও সুবিধা করতে না পারায় জ্যামাইকান জাতীয় মহিলা ফুটবল দল ফিফা রেংকিং লিস্ট থেকে বাদ পড়লো। ফেডারেশনও আর সাহায্য করতে চাইলো না। আর্থিক সমস্যা প্রকট আকারে ধারন করায় কোচ রেখে ট্রেইনিং করানো কিংবা ট্যুরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। বছরের পর বছর এমনটা চলছিলো৷ অবশেষে '১৪ তে তাদের পাশে আলোকবর্তিকা হাতে উপস্থিত হলেন জ্যামাইকান গায়িকা, অভিনেত্রী- মডেল, লেখক ও উদ্যোক্তা সিদেল্লা মার্লে। এসব পরিচয় ছাপিয়ে যার পরিচয় বব মার্লের মেয়ে হিসেবেই বেশি প্রাধান্য পায়।   

সিদিল্লাকে পাশে পেয়ে আবারো আলোর মশাল হাতে তুলে নিলো জ্যামাইকান ফুটবল ফেডারেশন। এর পরের গল্পটা ভয়ংকর সুন্দর।   

সিডিলা দলের এম্বেসডর হিসেবে আত্মনিয়োগ করলেন। দলকে নিয়ে ট্যুর করলেন কয়েকটা দেশে; এবং সব ট্যুরেই তিনি গান গাইলেন৷ ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা শুরু হলো ধীরেধীরে। একে একে এগিয়ে এলো স্পন্সররা। সিদেল্লা এর সাথে যুক্ত করলেন বব মার্লে ফাউন্ডেশনকে। দলকে উড়িয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিলো কাঁধে নিলো জ্যামাইকান এয়ারওয়েজ। কোচ ভাড়া করে আনা হলো। মেয়েরা যেন আকাশে ভাসতে শুরু করলো। তবে ভাসলেই হবে না, চাই ফলাফল; তার জন্য কয়েকবছর অপেক্ষা। ২০১৫ বিশ্বকাপে কোলিফাইং করতে ব্যর্থ হলেও ২০১৬ অলিম্পিকে জায়গা করে নেয় জ্যামাইকা। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে রেংকিংয়ের ৭৫ তম স্থান থেকে ৩৪ এ চলে আসে রেগে গার্লসরা। অতপর ২০১৯ ফুটবল বিশ্বকাপের মঞ্চে জ্যামাইকান জাতীয় প্রমিলা ফুটবল দল; এবং আরেকটি ইতিহাসের সূচনা। বব মার্লের মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করতে ভুলে যায় না পুরো জাতি।  

গান ও রাজনীতি; দুটো ভিন্ন জগৎ। দুটোতেই ভ্রমণ করেছেন মার্লে। গানের ব্যাপারে ভয়ংকর সুন্দর একটা কথা বলেছেন মার্লে; 'গানের ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দিক তা হচ্ছে, এটা যখন আপনার হৃদয়ে আঘাত করে আপনি কোনো ব্যাথা অনুভব করেন না।' 

Bob-Marley_3

দ্বিতীয় এলব্যাম মুক্তির পর আসল উইলার্স ব্যান্ডের ৩ সদস্যের মধ্যে দুজন বিদায় নিলে, লিভিংস্টোন আর ম্যকিনতোশ নতুনভাবে শুরু করলেন বানি উইলার্স আর পিটার তোশ নামে। মার্লে নতুন আরেকটি ব্যান্ডকে ভাড়া করলেন। নতুন রিদম গিটারিস্ট, গান লেখক; নতুনদের নিয়ে শুরু করলেন যাত্রা। জ্যামাইকার তৎকালীন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, খাবারের সংকট, বেকারত্ব- সব ফুটে উঠলো তার গানে। পিপলস ন্যাশনাল পার্টিকে সমর্থন জানিয়ে রাজনীতিতে  মার্লের পদচারণ শুরু। তবে এ বিষয়টাকে নিজেদের জন্য বিপদজনক ভাবতে শুরু করলো পিএনপি। তখন ১৯৭৫ সাল। উইলার্সদের ৩য় এলব্যাম *ন্যাটি ড্রেড* মুক্তি পেয়েছে। রাজনৈতিক অসময়ে এলব্যামটি যেন আরোও খানিকটা বারুদ ঢেলে দিলো জ্যামাইকার রাজনৈতিক অঙ্গনে। মূলত এমব্যামের *3'o Clock Road Block* গানটি জ্যামাইকান লেবারপার্টি ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মধ্যকার উত্তেজনা খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। গানটি ছিলো মার্লের নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার। ১৯৭২ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়কার এক রাতে তাকে আর্মিরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিলো।    

ধারণা করা হয় রাজনৈতিক কারণেই '৭৬ এ গুলিবিদ্ধ হতে হয় মার্লেকে। সে যাত্রায় আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি বেচে যান মৃত্যুর হাত থেকে। ঘটনা ৩ ডিসেম্বর ১৯৭৬ সালের। বব মার্লে এবং তার ব্যান্ড রিহার্সেলে ব্যস্ত। ২ দিন পর কিংস্টন ন্যাশনাল হিরো'স পার্কে তাদের কনসার্ট *স্মাইল ফর জ্যামাইকা*। হঠ্যাৎ-ই একদল সশস্ত্র আততায়ী গুলিবর্ষণ শুরু করে তাদের উদ্দেশ্য করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাঠিতে লুটিয়ে পড়েন বব মার্লে এবং স্ত্রী রিটা; ভাগ্যবশত তারা বেঁচে যায় গুলি খেয়েও। তবে প্রাণ দিতে হয় ব্যান্ড ম্যানেজার ডন টেইলরকে। ২ দিন পর গুলিবিদ্ধ মার্লে ঠিকই কনসার্টে উপস্থিত হন আশি হাজার মানুষের সামনে।              

বব মার্লের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো। লেখাটা আমার বন্ধুদের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করবো, বব মার্লের একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে; 'সত্যিকার বন্ধুরা হচ্ছে তারার মতো। তুমি তাদের চিনতে পারবে কেবল তোমার অন্ধকার সময়ে।' 

© আহমদ আতিকুজ্জামান।