মাদ্রিদের রাজার গল্প
পোস্টটি ৪০৯৩ বার পঠিত হয়েছেরাউল-রিয়াল...রিয়াল-রাউল.....
প্রথম প্রথম শুনলে যে কারো কনফিউজড হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। হলেও দোষ দেওয়া যায়না। আঠার বছর ধরে যেভাবে শব্দ দুটো একটি অন্যটির সমার্থক হয়ে উঠেছিলো, তাতে রিয়াল মাদ্রিদ না বলে রাউল মাদ্রিদ তো বলাই যায়।
"There was a time when the best players of the world wanted to shine in Madrid. It began in 2000 with Florentino Perez as president of Real Madrid."
হ্যাঁ, তখনই হয়েছিলো লস গ্যালাক্টিকোস যুগের সূচনা। সে দলে আলো ছড়াতে পেরেজের হাত ধরে এসে ভীড় জমিয়েছিলেন সব গ্রেট রা। জিনেদিন জিদান, রোনালদো লিমা, ডেভিড বেকহাম, লুইস ফিগো...সবাই ছুটে এসে জড়ো হয়েছিলেন সে দলে, গঠন করেছিলেন ফুটবল ইতিহাসের ভয়ংকর সেই দল, লস গ্যালাক্টিকোস।
তবে দলের মধ্যমণি, দলের সম্রাট ছিলেন একজনই। লম্বা ছিপছিপে, মাথায় চমৎকার রাজকীয় লম্বা চুল। হ্যাঁ, রাজার তো এমনই হওয়া উচিৎ।
সবাই সে সময় এলেও রাজার আগমন কিন্তু তখন না। রাজার হাতেই তো গড়ে উঠবে দল, তিনি সবার সাথে আসলে কি চলে! তার আগমন টা তাই একটু আগেই।
যাই হোক, রাজার গল্প যখন বলতে এসেছি, শুরু থেকেই বলি। এ যে রূপকথার রাজা না, সত্যিকারের রাজা। তবে তিনি যে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, সেটা রূপকথার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের পাশেই ছোট্ট সুন্দর শহর সান ক্রিস্টোবাল। ১৯৭৭ সালের আজকের এই দিনে সেখানে জন্মগ্রহণ করে ফুটফুটে এক শিশু। বাবা আদর করে ছেলের নাম রাখলেন রাউল। পুরো নাম রাউল গঞ্জালেজ ব্লাঙ্কো। অবাক হলেন নিশ্চয়ই! হ্যাঁ, রিয়াল মাদ্রিদের রাজার নামের পরতে পরতে যেন রিয়াল মাদ্রিদেরই ছোঁয়া।
ফুটবলে আগ্রহ সেই ছোট্টবেলা থেকেই। ফুটবলে হাতেখড়ি হয় স্থানীয় ক্লাব সান ক্রিস্টোবাল ডি লস এঞ্জেলেসে। তবে তার বাবা ছিলেন আতলেটিকো মাদ্রিদের কট্টর ভক্ত। তাই বাবার ইচ্ছাতেই সেখান থেকে পাড়ি জমান আতলেটিকো শিবিরে।
আতলেটিকো তে দারুণ ভাবেই শুরু করেন রাউল। নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন আস্তে আস্তে। সেইখানে বালক দলের হয়েই জয় করেন ন্যাশনাল টাইটেল।
তবে যার ভাগ্য বাঁধা পড়ে আসে রিয়াল মাদ্রিদের সাথে, তাকে আতলেটিকো তে বেঁধে রাখে কার সাধ্য! তখন আতলেটিকো আর্থিকভাবে চরম দুর্দশার সময় পার করছিলো। শেষ পর্যন্ত খরচ কমাতে ক্লাব প্রেসিডেন্ট জেসুস গিল সিদ্ধান্ত নিলেন বন্ধ করে দেওয়া হবে ক্লাবের যুব একাডেমী, তাতে যদি খরচ কিছুটা কমানো যায়। কি আর করা! বাধ্য হয়েই তাই আতলেটিকো ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান রাউল গঞ্জালেজ।
রিয়াল মাদ্রিদে গিয়ে তাদের ক্যাডেট দল লা ফ্যাব্রিকা তে অনুশীলন শুরু করেন রাউল। তারপর প্রমোশন পেয়ে ক্রমান্বয়ে জুভেনিল সি, বি ও এ তে পৌঁছে যান। এখানে থাকতেই ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে জয় করেন ডালাস কাপ।
সিনিয়র ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে, রিয়াল মাদ্রিদ সি দলের হয়ে। শুরুটা করেন দারুণ ভাবে। মাত্র সাত ম্যাচ খেলে করে ফেলেন ষোলখানা গোল। আর পায় কে! নজর এড়ালোনা কোচ জর্জ ভালদানোর। উঠিয়ে নিয়ে গেলেন মূল টিমে।
লা লিগায় রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে প্রথম যখন মাঠে নামেন, তখন তার বয়স মোটে ১৭ বছর ১২৪ দিন। রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী প্লেয়ার হিসেবে লা লিগায় অভিষেক ঘটে তার। প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত। দারুণ এক এসিস্ট করে বসেন। তবে সবার নজর কাড়েন দ্বিতীয় ম্যাচে। সে ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল রিয়ালের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ও তারই সাবেক ক্লাব আতলেটিকো মাদ্রিদে। সে ম্যাচে করেন চমৎকার এক গোল।
সে মৌসুমে আঠাশ ম্যাচ খেলে নয়টি গোল করেন রাউল। সেই সাথে মাদ্রিদ জিতে নেয় লিগ শিরোপা।
সেই যে শুরু, তারপর থেকে শুরু হলো রিয়াল মাদ্রিদের রাউল যুগ। ক্রমান্বয়ে জয় করে গেছেন একের পর এক শিরোপা। গড়ে গেছেন অসংখ্য রেকর্ড।
লস ব্লাঙ্কোসদের হয়ে জিতেছে সম্ভাব্য সবকিছুই। লস গ্যালাক্টিকোস দের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের নিয়ে জয় করেছেন ছয়বার লা লিগা টাইটেল, চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ। আর ছোট ছোট অসংখ্য অন্যান্য শিরোপা তো আছেই।
ব্যক্তিগত অর্জনের দিক দিয়েও পরিপূর্ণ রাউলের ক্যারিয়ার। রেকর্ড পাঁচবার লা লিগার বেস্ট স্প্যানিশ প্লেয়ার, চারবার জারা ট্রফি, দুইবার পিচিচি ট্রফি, দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগ টপ স্কোরার, তিনবার উয়েফা ফরওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার সহ অসংখ্য ব্যক্তিগত অর্জনে পরিপূর্ণ রাউলের ক্যারিয়ার। ২০০১ সালে অল্পের জন্য হাতে উঠেনি ব্যালন ডি'অর, হয়েছিলেন রানারআপ।
সে তুলনায় স্পেনের জার্সিতে তার অর্জন নেই বললেই চলে। হ্যাঁ, কিছুই জেতেননি লা রোজাদের হয়ে। তবে স্পেনের যে সর্বজয়ী গোল্ডেন জেনারেশন, তার সূচনা হয়েছিলো তার হাত ধরেই। তিনিই ছিলেন জাভি-ইনিয়েস্তা-ক্যাসিয়াস দের অগ্রদূত।
অসংখ্য রেকর্ড লেখা হয়েছে তার নামে। স্যার আলফ্রেডো ডি স্টেফানো কে টপকে হয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ ইতিহাসে টপ স্কোরার। পরে অবশ্য সেটা দখল করে নিয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে খেলেছেন তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৭৪১ টি ম্যাচ। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে গোল করার রেকর্ডও তারই। মেসি-রোনালদো এরার আগে পর্যন্ত ছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগেরও টপ স্কোরার। ক্যাপ্টেন হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে ও চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা প্লেয়ার রাউল। সবধরনের ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশী ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তার। স্পেনের হয়ে তেমন কিছু জিততে না পারলেও এখন অবধি লা রোজা দের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি।
তবে রেকর্ড দিয়ে কখনো রাউল কে মূল্যায়ন করা সম্ভব না। তিনি ছিলেন রেকর্ডের ঊর্ধ্বে। রাউল একটা আবেগের নাম। এ আবেগ ছড়িয়ে আছে বিশ্বের কোটি কোটি মাদ্রিদ ভক্তের মধ্যে। রাউল নামটির সাথেই ছড়িয়ে পড়ে সে আবেগ।
তবে একট অনন্য রেকর্ড আছে তার দখলে, যেটা না বললেই নয়। সতের বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে একবারের জন্যও লাল কার্ড দেখেননি রাউল। হ্যাঁ, এটা রাউল কে কিছুটা ডিফাইন্ডও করে। রাউল ছিলেন ফেয়ার প্লের রোল মডেল। সত্যিকারের ফেয়ার প্লে আসলে কি, সেটা অনুধাবন করা যায় তার খেলা দেখলেই। তার প্রতিটা স্টেপ, প্রতিটা মুভমেন্ট দেখলেই অনুধাবন করা যায় ফেয়ার প্লে সত্যিকার অর্থে ঠিক কেমন।
খেলোয়াড় হিসেবে ফরওয়ার্ডে ছিলেন পুরোপুরি ভার্সেটাইল। মূলত সেন্টার ফরওয়ার্ড, কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে সাবলীলভাবে খেলেছেন সবখানেই। লেফট উইং, রাইট উইং, অ্যাটাকিং মিড সব খানেই দুর্দান্ত রাউল। মেসির আগে তিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন বাঁ পায়ের জাদু। বল পাসিং, বল রিসিভিং এত চমৎকার যে বার বার দেখলেও মনে হয় আবার দেখি। আর প্রয়োজনের সময় গোল করাতেও তার জুড়ি নেই।
রিয়াল মাদ্রিদে তিনি এসেছিলেন রাজা হিসেবেই। বুত্রাগেনোর জায়গায় যখন কোচ ভালদানো যখন নিয়ে এলেন রাউল কে, তখন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো একটি খবর, "Passing the crown". কাতারের আল সাদে থাকা অবস্থায় তার বিদায়ী ম্যাচ আয়োজন করেছিলো রিয়াল। সে ম্যাচ শেষে যখন তার সাত নম্বর জার্সিটা তুলে দিচ্ছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর হাতে, তখন সবার মনে আরো একবার বেজে উঠেছিলো সেই কথাটাই, "Passing the crown".
হ্যাঁ, রিয়াল মাদ্রিদের রাজার পালা বদলই বটে। কিন্তু রাউল গঞ্জালেজ যা ছিলেন, তেমন টা কেউ কখনো হতে পারেননি, পারবেন না। লস ব্লাঙ্কোসদের সাত নম্বর জার্সি পরে হয়তো অসংখ্য রেকর্ড ভেঙেছেন ও গড়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, কিন্তু মাদ্রিদ ভক্তরা সাত নম্বর জার্সিটার ওপর রোনালদো নয়, রাউল নামটাই খুঁজে ফেরে।
রাউল আসলে কি? হ্যাঁ, আবেগ। রাউল এক আবেগই বটে। রাউল হলেন তিনি, যার নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে আবেগে কেঁপে ওঠে বিশ্বের কোটি কোটি মাদ্রিদিস্তাদের বুক। রাউল হলেন তিনি, যার নামে এখনও মাদ্রিদে বেজে ওঠে সূরের ঝংকার। রাউল হলেন তিনি, যিনি মিশে আছেন রিয়াল মাদ্রিদের অস্তিত্বে। রাউল তিনি, যার রক্তের প্রতিটি কণায় মিশে আছে রিয়াল মাদ্রিদ। রাউল মানেই রিয়াল মাদ্রিদ।
বার্নাব্যুর হাজার হাজার দর্শকের মুখে যখন প্রতিধ্বনিত হয় "রাউল মাদ্রিদ! রাউল মাদ্রিদ!", তখনই সত্যিকার অর্থে অনুভব করা যায় রাউল গঞ্জালেজ কে।
সবশেষে উল্লেখ করছি রাউলের সেই বিখ্যাত উক্তিটা।
“I would like to tell the fans that in every run, every tackles I have given everything. I have always given 100% for this club. My heart will always be with Madrid. Real Madrid is my life and my home.”
- 0 মন্তব্য