ডাঙ্কে আন্দ্রে!
পোস্টটি ৩০১৫ বার পঠিত হয়েছে
খুব বেশিদিন হয়নি। এইতো সেদিনের কথা। বিশ্বকাপ জয়ের পথের শেষ বাঁকে বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি দুই ফুটবল পরাশক্তি আর্জেন্টিনা ও জার্মানি। আন্তর্জাতিক শিরোপার অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা আর্জেন্টাইন সমর্থকদের অপেক্ষার পালা কি শেষমেশ ফুরোবে? নাকি একুশ শতকের সবচেয়ে ধারাবাহিক দল জার্মানি চতুর্থবারের মতো বিশ্বসেরা হবার স্বাদ পাবে? একদিকে আছেন তুখোড় মেসি কিন্তু জার্মানদের যে আছে “ডি মানশাফ্ট”, ইংরেজিতে যাকে বলে “দ্য টিম”। হাড্ডাহাড্ডি এক স্নায়ুক্ষয়ী লড়াই চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হয়েছিল প্রায় ৭৪ হাজার সৌভাগ্যবান দর্শকের। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে টিভির পর্দায় চোখ সেঁটে ছিলো কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থক-অনুরাগীর। নির্ধারিত সময়ে বারবার আক্রমণ করা সত্ত্বেও গোল করতে পারলো না কোনো দলই। অতিরিক্ত সময়ে গড়ালো খেলা। দেখতে দেখতে সেটারও প্রথমার্ধ পেরিয়ে গেলো, তবুও জালের দেখা নেই। ম্যাচের বয়স তখন ১১৩ মিনিট। মাঝমাঠের একটু সামনে বল পেলেন জার্মানির শ্যুরলা। হয়তো শরীরে অবশিষ্ট দমের শেষবিন্দু খরচ করে ডান প্রান্ত দিয়ে দৌড় শুরু করলেন। মাশেরানোকে পেরিয়ে গেলেন। বক্সের কাছাকাছি এসে বাঁ পায়ে ভাসানো এক ক্রস ফেললেন বক্সে। পড়িমড়ি স্লাইড করে সেটাকে আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন মাশেরানো, কিছুটা সামনে দাঁড়ানো জাবায়েতা ছিলেন শুধুই দর্শক। বক্সের ভেতর দুই আর্জেন্টাইন সেন্টারহাফের মাঝের ফাঁকা জায়গায় ওঁত পেতে থাকা মারিও গোটজার কাছে উড়ে এলো বল। বুক দিয়ে বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাঁ পায়ের দারুণ এক ভলিতে সার্জিও রোমেরোকে পরাস্ত করলেন গোটজা। আবেগহীন যন্ত্রমানব বলে ব্যঙ্গ করা হয়ে যাদেরকে, সেই জার্মানরা মেতে উঠলো বুনো উল্লাসে। শ্যুরলা-গোটজার যুগলবন্দিতে ২৪ বছর পরে বিশ্বকাপ ঘুরে তুলল জার্মানরা। সময়টাকে ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে ৬ বছর এগিয়ে নিন। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপের মাঝে ২০২০ সালের ১৩ই জুলাইয়ে জার্মান সমর্থকেরা মারাকানা জয়ের ষষ্ঠ বর্ষপূর্তি পালন করলো। এর চারদিন পরেই নিজের বুটজোড়া চিরতরে তুলে রাখার ঘোষণা দিলেন সেই ফাইনালের অন্যতম নায়ক আন্দ্রে শ্যুরলা, তাও মাত্র ২৯ বছর বয়সেই। এই সেই শ্যুরলা যাকে একসময় ভাবা হতো জার্মান ফুটবলের ভবিষ্যৎ, সেই শ্যুরলাযার খেলায় মুগ্ধ হয়ে কেভিন ডা ব্রয়না আর মো সালাহকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন মরিনহো। অনেকটা আড়ালে থেকেই নিভে গেলো জার্মান আকাশের জ্বলজ্বলে তারাটি। কিন্তু বিদায়ের ঘোষণা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল কী?
১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে একত্রিত হলো দুই জার্মানি। এর মাসখানেক পরে পৃথিবীতে এলেন আন্দ্রে শ্যুরলা। ঐতিহ্যবাহী মাইঞ্জ শহর থেকে ৫০ মাইল দূরের লুড্ভিগশাফেন শহরে বেড়ে ওঠা তাঁর। মা লুইজ ছিলেন অ্যাথলেট, বাবা ইয়াকিমও খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। লুডভিগশাফেনের রাস্তায় রাস্তায় বল পায়ে দুরন্তবেগে ছুটে চলা ছোট্ট আন্দ্রেকে আটকানো অসম্ভব ছিলো, নিজের চেয়ে দু’চার বছরের বড়দের সাথেও সমানতালে টক্কর দিতো আন্দ্রে। বাবার ইচ্ছায় স্থানীয় দল লুড্ভিগশাফেনার এফসির যুবদলে ভর্তি করিয়ে দিলেন আন্দ্রেকে। আট বছর সেখানে কাটিয়ে ২০০৬ সালে মাইঞ্জের যুবদলে খেলার সুযোগ পেলেন শুরলা। সেখানেই ডিফেন্ডার থেকে মিডফিল্ডার বনে যাওয়া; টমাস টুখেলের অধীনে ১৯৯৯ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বুন্দেসলিগার শিরোপা জিতল মাইঞ্জ যুবদল – দলের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিভা শ্যুরলা আলাদা করে নজর কাড়লেন। পরের মৌসুম থেকেই মূলদলের নিয়মিত মুখ শ্যুরলা, ৩৩ লিগ ম্যাচ খেলে ৫ গোল করলেন। তবে ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে গেলো পরের মৌসুমে। ডিফেন্ডারদেরকে নিয়মিত যন্ত্রণা উপহার দিয়ে লিগে ৩৩ ম্যাচে ১৫ বার জালে বল জড়ালেন। এরপর ৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বেয়ার লেভারকুসেনে নাম লেখানো। প্রথম মৌসুমে কিছুটা নিষ্প্রভ থাকলেও আবারো দ্বিতীয় মৌসুমে জ্বলে ওঠা। ২০১২-১৩ মৌসুমে লেভারকুসেনের জার্সি গায়ে ৪৩ ম্যাচে ১৪ গোল আর ৯ বার গোলে সহায়তা। মৌসুম চলাকালীন সময়েই লেভারকুসেনের ক্রীড়া পরিচালকের সাথে কথাবার্তা পাকা করে রেখেছিল চেলসি। স্বদেশ ছেড়ে ইংলিশ জমিনে পা রাখলেন শ্যুরলা।
চেলসিতে এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগলো। ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবরে এসে চেলসির হয়ে প্রথমবারের মতো গোল করলেন শুরলা, ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে ২-১ গোলের জয় পেলো “ব্লুজ”রা। পরের মাসে স্টোক সিটির বিপক্ষে জোড়া গোল, কিন্তু ৩-২ গোলে ধরাশয়ী হলো চেলসি। বিখ্যাত নীল জার্সিতে আন্দ্রে শ্যুরলার সেরা দিন ২০১৪ সালের পহেলা মার্চ। সেদিন ফুলহ্যামের বিপক্ষে দারুণ এক হ্যাটট্রিক করলেন দ্রুতগতির এই উইংগার। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোলটা তখনো পাওয়া হয়নি। পিএসজির বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে “ট্যাপ ইন”-এ চেলসিকে এগিয়ে দিলেন। পরের দেম্বা বা’ গোল করায় সেমিফাইনালে উঠে গেলো জোসে মরিনহো’র দল। আর গ্রীষ্মে তো জার্মান ফুটবল ইতিহাসের সুখস্মৃতির বড় অংশই হয়ে গেলেন। ফাইনালে অ্যাসিস্ট বাদেও সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে বিধ্বস্ত করার পথে সপ্তম গোলটি এসেছিল তাঁর বাঁ পায়ের বুলেট শট থেকে। চেলসিতে ফিরে এসে নতুন মৌসুমের শুরুটাও ভালো হয়েছিল। ১৮ই আগস্ট বার্নলির বিপক্ষে তাঁর গোলের আগে ফ্যাব্রিগাসের পাস আর চেলসির “টিম মুভ” প্রিমিয়ার লিগের দর্শকদের শিহরিত করে যাবে আরো বহুদিন। কিন্তু শ্যুরলার ফুটবল ক্যারিয়ারের উর্ধ্বগতি থেমে গেলো এরপরেই, পরের গল্পটা শুধুই বেদনার।
২০১৪ সালের অক্টোবরে পোল্যান্ডে ম্যাচ খেলতে গেলো জার্মান জাতীয় দল। সেখানে ম্যাচের আগে মুরগীর মাংস খেয়েছিলেন শ্যুরলা। ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লেন একহারা গড়নের ফুটবলার। তিন সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হলো তাঁকে, তিনি যে সালমোনেলায় আক্রান্ত হয়েছেন এটা বুঝতেই চিকিৎসকদের এক সপ্তাহ লেগে গেলো। চার-পাঁচ কেজি ওজন হারালেন, ফিটনেসের সাথে যুঝতে গিয়ে চেলসির একাদশে জায়গা হারালেন। মরিনহোর পছন্দের খেলোয়াড় হয়েও ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি লিগ ম্যাচের প্রথম একাদশে থাকতে পারলেন। নিয়মিত ফুটবল খেলার তাড়নায় আবার ফিরে এলেন মাতৃভূমির কোলে। ২২ মিলিয়ন খরচা করে তাঁকে দলে ভেড়ালো ভলফ্সবুর্গ। সাবেক চেলসি সতীর্থ কেভিন ডা ব্রয়না আর ডাচ স্ট্রাইকার বাস ডোস্টের সাথে রসায়নটা ভালোই জমলো। কিন্তু ২২ ম্যাচ খেলে গোল পেলেন মাত্র ১টি। লীগশেষে অবশ্য মেডেল পেয়েছিলেন ঠিকই, যদিও সেটা এসেছিল ইংল্যান্ড থেকে। কস্তা-হ্যাজার্দ-ফ্যাব্রিগাসদের দাপটে ইংলিশ লীগ জিতেছে চেলসি, লিগে ১৪ বার মাঠে নামার সুবাদে শ্যুরলাও সেই সাফল্যের ভাগীদার। পরের মৌসুমে ১২ গোল করা, দুটো ট্রফিও জিতেছিলেম ভলফ্সবুর্গে এরপর নতুন চ্যালেঞ্জের খোঁজে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে পাড়ি জমানো। কিন্তু সৌভাগ্য যে চিরতরে ছেড়ে গেছে তাঁকে। দুই মৌসুমে মাত্র ২৭ ম্যাচ একাদশে থাকার সুযোগ মিলল, গোল মোটে ৮টি। ক্যারিয়ারের পচন ঠেকাতে আবার পশ্চিম লন্ডনে ছুটে যাওয়া। এবার ফুলহ্যামের হয়ে ধারে খেলতে এলেন শ্যুরলা। জার্মান উইঙ্গার মাঝে মাঝে সেই পুরনো ঝলক দেখালেও মৌসুমজুড়ে ছন্নছাড়া ফুটবল খেলা ফুলহ্যামের অবনমন আটকানো গেলো না। আবার নিজেকে প্রমাণ করতে বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমানো, রাশিয়ান লিগে এবার তাঁর দল স্পার্তাক মস্কো। তবে সুদিনের দেখা পাননি আর, ১৩ লীগ ম্যাচে সর্বসাকুল্যে ১ গোল। মৌসুম শেষ হবার পর মূলদল বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ফ্রী এজেন্ট হয়ে গেলেন শ্যুরলা। গত অক্টোবরে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন অবসরের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক-দুই বছর পরেই হয়তো ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে দেবেন। ১৭ই জুলাইয়ে এলো সেই “এক-দুই বছর”। ফুটবলকে যে চিরতরে বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন আন্দ্রে শ্যুরলা!
গোল করে কর্নারের পতাকার কাছে এসে গিটার বাদকের ভঙ্গিতে উদযাপন করার অভ্যেস ছিল। আক্রমণাত্মক ছিলেন না একেবারে, বরং দেখে মনে হতো দারুণ উপভোগ করছেন খেলাটা। সেই শ্যুরলার মনের মধ্যে অবসরের চোরাস্রোত কবে থেকে বইতে শুরু করেছিল কে জানে! অবসরের কারণ হিসেবে জানিয়েছেন পেশাদার ফুটবলারদের উপর নিয়মিত পারফর্ম করার জন্য যে সীমাহীন চাপ থাকে সেটা বোঝা হয়ে দাড়িয়েছিল তাঁর জন্য। পেশাদার ফুটবলারের পরিচয়ের আড়ালে সেই “আমি”কে হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। আর হয়তো জার্সি গায়ে মাঠে নামবেন না, কিন্তু এতোদিনের অর্জন তো তাতে মিথ্যে হয়ে যায়নি। বাসার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা বিশ্বজয়ী মেডেলটি হাতে নিয়ে হয়তো রিওর সেই রাতে ফিরে যাবেন, হয়তো বেয়াড়া চোখদুটো বেয়ে দু’ফোঁটা অভিমানী অশ্রুও গড়িয়ে পড়বে। ইতিহাস কিন্তু ভুলবে না আন্দ্রে শ্যুরলাকে - জার্মান ফুটবলের ভক্তদেরকে যিনি আবেগে উদ্বেল করেছেন, জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন তাঁকে কী এতো সহজে ভোলা যায়!
ডাঙ্কে আন্দ্রে শ্যুরলা!
- 0 মন্তব্য