আ ব্যাড ডে ইন দি অফিস
পোস্টটি ১৫০০ বার পঠিত হয়েছে
আমাদের সবার জীবনেই এমন কিছু দিন আসে যেটার তেঁতো স্বাদ থেকে যায় মুখে। কোনো কাজেই সাফল্য আসে না, যেটাই করতে যান কেমন যেন গোলমাল পাকিয়ে যায় সবকিছু। ফুটবল ম্যাচের দৈর্ঘ্য মাত্র ৯০ মিনিট হলেও এই দেড় ঘণ্টার পারফর্মেন্সের উপরেই একজন ফুটবলারের দিন ভালো না খারাপ গেলো সেটা বোঝা হয়ে যায়। কেউ কেউ হয়তো দারুণ এক হ্যাট্রিক করে ম্যাচ বল বাগিয়ে নেন, কেউ আবার দারুণ সব সেভ করে সমর্থকদের চোখের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু দিন আসে যেদিন সেই ফুটবলার ভাবতে শুরু করেন তিনি পেশা বেছে নিতে কোনো ভুল করেছেন কিনা? ফুটবল মাঠে আর নামা উচিৎ কিনা হয়তো মনের কোণে সেই প্রশ্নও উঁকিঝুঁকি মারে। আজ এমন তিনটি ঘটনার গল্প শোনা যাক।
(১) জোনাথন ওয়াল্টারস (২০১২-১৩ মৌসুম), প্রতিপক্ষ চেলসি
২০১৩ সালের ১২ই জুলাই নিশ্চয়ই ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই ঘুম থেকে উঠেছিলেন জোনাথন ওয়াল্টারস। ঐ দিন দুপুরে ঘরের মাঠে চেলসির বিরুদ্ধে মাঠে নামার কথা তাঁর দল স্টোক সিটির। আর সাদা-লাল ডোরাকাটা জার্সি গায়ে মাঠে নামলেই সেটা হয়ে যাবে ওয়াল্টারসের শততম প্রিমিয়ার লীগ ম্যাচ। ২৯ বছর বয়সী আইরিশম্যানের জন্য ব্যাপারটা তো স্বপ্নপূরণ হওয়ার মতোই। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ যার কেটেছে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় আর তৃতীয় বিভাগে তাঁর জন্য এটা দারুণ এক অর্জনই বৈকি। নিজেদের মাঠ ব্রিটানিয়া স্টেডিয়ামকে রীতিমতো দূর্গ বানিয়ে রেখেছিল স্টোক। টনি পুলিসের শক্তসমর্থ রক্ষণাত্মক দলের বিরুদ্ধে সব নামীদামী দলকেও বেশ ভুগতে হয়েছে। ম্যাচও পুলিসের পরিকল্পনামাফিকই চলছিল। প্রথমার্ধের ৪৫ মিনিট পেরিয়ে গেলেও নিজেদের গোলের দরজা অটুট রেখেছে “পটার্স”রা। যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে ডান প্রান্ত থেকে বক্সে উড়ে এলো ক্রস। ওয়াল্টারসও সদর্পে দারুণ এক ডাইভিং হেডে জালে ঢুকিয়ে দিলেন বল। কিন্তু এ কী? উল্লাসে ফেটে পড়ার বদলে স্টোক ফরোয়ার্ডের মাথায় হাত কেন? ওয়াল্টারস যে নিজ দলের গোলরক্ষক আজমীর বেগোভিচকে পরাস্ত করেছেন। তবে দুঃস্বপ্নের যে সেটা কেবল শুরু সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি কেউ। দ্বিতীয়ার্ধে ডান প্রান্তে কর্নার পেলো চেলসি। হুয়ান মাতা বাঁ পা দিয়ে দারুণ এক ডেলিভারি দিলেন বক্সে। হেড করতে প্রস্তুত ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছানোর আগেই স্টোকের এক খেলোয়াড়ের মাথায় লেগে জালে জড়ালো বল। আরেকটি আত্মঘাতী গোল। কালপ্রিট কে? সেই ওয়াল্টার্স! এক ম্যাচে দুই-দুইবার প্রতিপক্ষের হয়ে গোল করেছেন, এবার নিশ্চয়ই ক্ষান্ত দেবেন। কিন্তু সেই দীর্ঘ বিকেলে দুর্ভাগ্য এই আইরিশকে এতো সহজে ছেড়ে যাবে? ৪-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পেনাল্টি থেকে ব্যবধান কমানোর সুযোগ পেলো টনি পুলিসের দল। স্টোকের নিয়মিত পেনাল্টি টেকার আবার সেই জন ওয়াল্টারস। যাক জঘন্য দিনটা ভালো কিছু দিয়ে শেষ করা যাবে অন্তত। দৌড়ে এসে বলে জোরসে লাথি কষালেন ওয়াল্টারস। সব রাগ-দুঃখ-অভিমান বুঝি ঐ হতচ্ছাড়া গোলকটার উপর ঝেড়ে দিলেন। বারে লেগে ব্রিটানিয়া স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হারিয়ে গেলো বল। হতাশায় বসে পড়লেন ওয়াল্টারস, প্রিমিয়ার লীগে ১০০ ম্যাচ খেলা কী অপরাধ?
(২) সান্ডারল্যান্ড (২০০২-০৩ মৌসুম), প্রতিপক্ষ চার্লটন অ্যাথলেটিক
ফুটবলে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন বলা যেতে পারে হ্যাট্ট্রিক কে। এই হ্যাটট্রিক নিয়েও বহু ধরণের রেকর্ড আছে। কেউ এক অর্ধেই তিনটি গোল করে বসেন, কেউবা শুধু হেডারে কিংবা পেনাল্টি স্পট থেকেই হ্যাট্ট্রিক করেছেন। আবার ডান পা, বাম পা আর হেড –এই তিনের সহযোগে করা “পারফেক্ট হ্যাট্ট্রিক” ফুটবলের পরম আরাধ্য বিষয়গুলোর একটি। কিন্তু সান্ডারল্যান্ড এএফসি ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে যে কীর্তি দেখিয়েছে সেটা যেন সম্ভাব্যতার সব সূত্রকে ছাপিয়ে গেছে। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারির পয়লা তারিখের ম্যাচটা তখন পর্যন্ত মৌসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল সান্ডারল্যান্ডের জন্য। পিটার রীডকে সরিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবের কোচিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হাওয়ার্ড উইলকিনসনকে। কিন্তু গুরু বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি “ব্ল্যাক ক্যাট”দের । পয়েন্ট টেবিলের একদম তলানিতে ধুঁকছে লাল-সাদারা, ওদিকে মৌসুমও শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। তাই ফেব্রুয়ারির শুরুতে অবনমনের আশঙ্কায় পড়া আরেক দল চার্লটনের বিপক্ষে জয়ের বিকল্প ছিলো না সান্ডারল্যান্ডের। কিন্তু ম্যাচ মাঠে গড়াতেই মনে হচ্ছিল অতিথিদের আতিথেয়তায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখতে নারাজ স্বাগতিকেরা। শুরুটা হলো ২৪ মিনিটে। ডান পাশ থেকে কর্নার নিলেন চার্লটনের ক্লাউস ইয়েন্সেন। বল ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ সান্ডারল্যান্ড , কিন্তু চার্লটন মিডফিল্ডার মার্ক ফিস যে দুর্বল ভলি মারলেন গোলের অনেক বাইরে দিয়ে যাচ্ছিল সেটা। কিন্তু দুই সান্ডারল্যান্ড খেলেয়াড়ের গায়ে ডিফ্লেক্টেড হলো সেটা। গোলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ডিফেন্ডার স্টিফেন রাইটের কি মনে হয়েছিল সে জানে। অলস ভঙ্গিতে “স্করপিয়ন কিক” ধরণের কিছু করতে চাইলেন। তাঁর পা ছুঁয়ে জালে জড়ালো বল। চার মিনিট পরে আবার যেচে পড়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনলো সান্ডারল্যান্ড। এবার বাম প্রান্ত থেকে ওভারল্যাপ করে বক্সে ঢুকলেন চার্লটন লেফটব্যাক ক্রিস পাওয়েল। তাঁর নেওয়া শটটা ঠিকমতোই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সান্ডারল্যান্ড গোলরক্ষক থমাস সরেনসন। কিন্তু ভাগ্য নামক বস্তুটাকে টিম বাসে রেখেই সেদিন খেলতে নেমেছিল সান্ডারল্যান্ড। সরেনসনের ডান পায়ে লেগে বলটা আচমকা মাইকেল প্রক্টারের দিকে ধেয়ে গেলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এই ফরোয়ার্ডের উরুতে লেগে গোললাইন পেরিয়ে গেলো বল। ২-০। “স্টেডিয়াম অফ লাইট”-এর আলোটা তখন সান্ডারল্যান্ড সমর্থকদের কাছে বেশ ফিকে লাগার কথা। তবে প্রক্টার দমে গেলেন না। ৩১ মিনিটে আবার ইয়েন্সেনের কর্নার। কাছের পোস্টে সবাইকে মিস করে গেলো সেটা, কিন্তু প্রক্টার বোধহয় গায়ে চুম্বক সেঁটে খেলতে নেমেছিলেন সেদিন। বলের গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইলেও তাঁর পিঠে লেগে জালে ঢুকে গেলো পাজি বলটা। ২৪ থেকে ৩১ - মাত্র সাত মিনিটের ব্যবধানে তিন-তিনটে আত্মঘাতী গোল ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়লো সান্ডারল্যান্ড। প্রথমার্ধ শেষ হবার আগেই মাঠ ছাড়তে শুরু করলেন সান্ডারল্যান্ড সমর্থকেরা। ৮০ মিনিটে কেভিন ফিলিপ্সের সান্ত্বনাসূচক পেনাল্টি দেখা হলো না তাঁদের। সেবার যে অবনমিত হয়েছিল সান্ডারল্যান্ড সেটা বলাই বাহুল্য, এক ম্যাচে তিনটি আত্মঘাতী গোলের ধাক্কা কোন দলই বা সামলাতে পারে!
(৩) শাশা বুশার্ট (২০০৯-১০ মৌসুম), প্রতিপক্ষ হ্যামবার্গার এসভি
অভিষেক ম্যাচ নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখেন ফুটবলাররা। আউটফিল্ড প্লেয়ারদের আশা থাকে শেষ মূহুর্তে গোল করে জিতিয়ে দেবেন দলকে, কারো কারো মনে হয়তো হ্যাটট্রিকের আকাঙ্ক্ষাও উঁকি দিয়ে যায়। গোলরক্ষকেরা অভিষেক নিয়ে কী ভাবেন কে জানে? ১৯ বছর বয়সী শাশা বুশার্টেরও নিশ্চয়ই দারুণভাবে করতে চেয়েছিলেন শুরুটা। ২০০৯ সালের ১৯ই সেপ্টেম্বর ইউরোপা লীগে লাটভিয়ান দল ভেন্টসপিল্সের বিরুদ্ধে অভিষেক হয় হার্থা বার্লিনের তরুণ এই গোলরক্ষকের। তবে বুন্দেসলীগায় তখন পর্যন্ত মাঠে নামা হয়নি এই তরুণ শটস্টপারের। পরের মাসেই অপ্রত্যাশিতভাবে সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি। ৮ই অক্টোবর ঘরের মাঠে হ্যামবার্গারকে আতিথ্য দিচ্ছিল হার্থা। ৩৩তম মিনিটে মূল গোলরক্ষক টিমো অক্স চোট পেয়ে মাঠ ছাড়লেন। বদলি হিসেবে প্রথমবারের মতো বুন্দেসলীগায় সীমানারেখা পেরিয়ে মাঠে নামলেন শাশা বুশার্ট। ম্যাচে তখন ১-১ সমতা। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বুশার্টের স্বপ্নের অভিষেকে কালিমার দাগ পড়ল। জে রবার্তোর একটা লং বল ক্লিয়ার করতে বক্সের সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন বুশার্ট। ডাইভিং হেডে বিপদমুক্ত করলেন দলকে, কিন্তু আদৌ পারলেন কী? বল উড়ে গেলো হ্যামবার্গের ইয়ারোলিমের কাছে, গোলের প্রায় ৪০ গোল দূর থেকে ফার্স্ট টাইম ভলি মেরে দিলেন চেক মিডফিল্ডার। বুশার্টের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে একবার ড্রপ খেয়েই জালে জড়ালো বল, অসহায়ের মতো চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না হতভাগ্য গোলরক্ষকের। ১০০ সেকেন্ডের মধ্যেই যেন রিপ্লে দেখলো অলিম্পিয়াস্টাডিয়নের প্রায় ৭২ হাজার দর্শক। আবার লং বল এলো, হ্যামবার্গ স্ট্রাইকার ধরতে চেষ্টা করলেন সেটা। এবার বক্স ছেড়ে বেশ খানিকটা বেরিয়ে এসে ক্লিয়ার করলেন বুশার্ট। কিন্তু বিধি বাম! মধ্যবৃত্তের কাছে বল পেয়ে গেলেন জে রবার্তো। অভিজ্ঞ এই ব্রাজিলিয়ানের একটা টাচ লাগলো বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে। দ্বিতীয় টাচেই বাঁ পায়ের বাঁকানো শট। বুশার্ট ঘুরে দু-চার পা এগিয়ে যাওয়ার আগেই গোল। হার্থা কোচ ফীল্ডহেল্ম ফাংকেলকে দেখে মনে হচ্ছিল এই বর্ষীয়ান কোচ বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখছেন। সমতায় থাকা ম্যাচটার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল এ গোল দুটোই। ৩-১ স্কোরলাইন দেখে অবশ্য বুশার্টের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যাবে না। কোনো আত্মঘাতী গোল করেননি কিংবা গোল দুটোতেও তাঁর দোষ দেওয়া যাবে না খুব একটা। কিন্তু মাত্র আধমিনিটের মধ্যেই নিশ্চয়ই বুশার্টের অভিষেক রোমাঞ্চ উধাও হয়ে গিয়েছিল। এমন অভিষেক কী চেয়েছে কেউ কখনো?
- 0 মন্তব্য