এক সৈনিকের নীরব ফুটবল উপাখ্যান
পোস্টটি ১৬২৭ বার পঠিত হয়েছেএক আর্মি অফিসারের গল্প শোনা যাক। চৌকস, দুর্দান্ত মেধাবী, হাসেন মন খোলে। কিংবা এ গল্প হয়তো শুধু ঐ আর্মি অফিসারের নয়৷ জাদুর হাওয়া লাগা আরও এক মানুষের৷ স্বপ্ন এবং বাস্তবতার জগৎ ভ্রমনের ঘোর লাগা এক সময়ের।
গল্পটি শুরু করা যাক 'ফাউসবার্গের' ডি'এমিয়েন্স কবরস্থানের প্রবেশ গেইটের বিশালাকার বিলবোর্ড থেকে। তাতে লেখা, “হিরো’স নেভার ডাই”। বিলবোর্ডটিতে দিনের শেষ আলো আছড়ে পড়ছে। তার ঠিক নিচে একা দাঁড়িয়ে আছেন এলিস। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। স্মিত বাতাসে কখনো-সখনো রেড ম্যাপলের দু’একটি ঝরা পাতা এসে পড়ছে তার গায়ে। এলিসা অপেক্ষা করছেন তার ছেলেদের জন্য। বছরের এই দিনটায় অন্তত কেউ এখানে আসতে ভুল করে না। একটা সময় সবাই আসবে এক এক করে, হয়তো তাদের দু-গন্ড বেঁয়ে অশ্রু নামবে। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা হবে কতক্ষণ, কেউ কথাবার্তা বলবে না। তারা জানে, কবরস্থানে প্রার্থণা করতে হয় নীরবে। এভাবেই চলছে বহু বছর ধরে।
প্রার্থণারত ছেলেদের দল খুব ভালো করেই জানে, যে শূন্যতার সামনে তারা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে আরোও অন্তত পঁয়ত্রিশ হাজার লাশের স্তুপ! যারা দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অকুতোভয় সংগ্রামে। তাদের বাবার অজ্ঞাত লাশের অন্য এক জীবন্ত পরিচয় দিই; তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি যিনি ব্রিটিশ সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেলেছেন; এবং সর্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিক- যিনি অফিসার র্যাঙ্ক পেয়েছিলেন।
এলিস’কে ছেলেদের অপেক্ষায় ঐ বিলবোর্ডের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে বরং চলে যাওয়া যাক বেশ কয়েক বছর পিছনে। যাওয়া যাক ব্রিটিশ আর্মির মিডলসেক্স রেজিম্যান্টের সেভেন্টিন্থ ব্যাটেলিয়নের প্যারেডে। ক্রেনলেইগ, পেরহ্যাম ডাউন কিংবা ক্যাপ্সটন ক্যাম্পের ভয়ংকর ট্রেইনিং অভিজ্ঞতা শেষে অবশেষে অন্য এক অধ্যায়ের সামনে ওয়াল্টার, এলিসের বড় ছেলে। সৈনিকেরা সাধারণত রোবট টাইপ হয়। দেখা গেলো ওয়াল্টার তার ব্যতিক্রম। ১৮-ই নভেম্বর, ১৯১৫। ওয়াল্টারকে দ্যা ফুটবল ব্যাটেলিয়ন থেকে সার্জেন্ট পদে ভূষিত করা হলো। হাস্যোজ্জ্বল দেখালো তাকে। অন্যসব সৈনিকদের থেকে সে ভিন্ন ছিলো তার নানাবিধ আচরনে। প্রয়োজন ছিলো বলেই হয়তো উৎফুল্ল থাকতো। সেকি জানতো তার পথচলা কতটুকু বাকি আছে?
সৈনিকদের শরীরচর্চা প্রশিক্ষণের একটা অংশজুড়ে থাকে খেলাধুলা। দেখা গেলো ঘাম ঝরানোর ফুটবলে তার কৌশল, খেলার ধরণ কিংবা খেলোয়াড় সুলভ আচরণ মুগ্ধ করার মতো। এই অধ্যায়ের গল্পটুকু জানতে হলে আমাদেরকে চলে যেতে হবে সার্জেন্ট ওয়াল্টারের বাল্যকালে।
বার্বাডোস থেকে ইংল্যান্ডে অভিবাসী হয়ে আসা পিতা ড্যানিয়েল ও কেন্টের ফল্কস্টোনের বাসিন্দা এলিসের ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন ওয়াল্টার। ক্যান্সারে বাবার অকাল মৃত্য যেন বেঁচে থাকার সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ালো ওয়াল্টারের। ৬ ভাই বোনের বিশাল সংসার সামলাতে না পেরে ওয়াল্টার আর তার ভাইকে অনাথাশ্রমে পাঠিয়ে দিলেন এলিস৷ অনাথাশ্রমে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট, ফুটবল ছাড়াও বাস্কেটবল খেলায় বেশ মনোযোগী ওয়াল্টার আবিষ্কার করলেন ফুটবল-ই তাকে বেশি টানছে। স্কুল শেষে ওয়াল্টার নিয়মিত খেলতে শুরু করলেন স্থানীয় ক্ল্যাপটন ফুটবল ক্লাবের হয়ে৷ ঠিক সেসময়, ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যমের জনপ্রিয় *হটস্পার ম্যাগাজিন*-এ জন ফিনেলি ওয়াল্টারকে নিয়ে বিশদ এক আর্টিকেল লিখলেন। ইংল্যান্ড বাসীকে জানালেন এক তরুণের ফুটবল উপাখ্যান হয়ে চলেছে।
ইষ্ট লন্ডনের ক্ল্যাপটন ক্লাবের হয়ে ততোদিনে ওয়াল্টার বেশ সমাদৃত হয়ে গেছেন তার দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের মাধ্যমে। সাফল্যের ঝুলিতে ১৯০৮/০৯ মৌসুমে একে একে ধরা দিলো লন্ডন সিনিয়র কাপ, দ্যা এফএ এমেচার কাপ এবং লন্ডন কাউন্টি এমেচার কাপের শিরোপা। ফরেষ্ট গেইটের হয়ে খেলতে পারতেন আরোও কিছুদিন৷ তবে ততোক্ষণে ওয়াল্টার নজরে পড়ে গেছেন টটেনহ্যামের!
কথায় আছে মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। ওয়াল্টার যেন তার স্বপ্নকেও ডিঙ্গিয়ে ফেলেছিলেন ততোদিনে। এক নক্ষত্র উদিত হতে চলেছে ব্রিটেনের আকাশে। সে নক্ষত্রের ঈশারা কে আর উপেক্ষা করতে পারে?
টটেনহ্যাম ওয়াল্টারের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বসে থাকলো না৷ বরং তাকে আমন্ত্রণ জানালো তাদের দক্ষিন আমেরিকায় প্রি-সিজন ট্যুরে। তাতেই বাজিমাত। ওয়াল্টার বিনয়ের সাথে সে প্রস্তাবে রাজী হলেন। তবে তার সেরাটা দেয়ার অপেক্ষায় রইলেন। সেবার মাঠের খেলায় ওয়াল্টার যা দেখিয়েছিলেন তা ছিলো অবিশ্বাস্য। রত্ন পেলে যেমন আলগে রাখতে দেরি করতে নেই, ঠিক তেমনি টটেনহ্যাম এই রত্নকে তাদের করে নিলো এক সন্ধ্যায় বাজি ফুটিয়ে৷ ১৯০৯/১০ মৌসুম থেকে টটেনহ্যামের জার্সি জড়ানোর সব ব্যবস্থা করা হলো ততোদিনে।
ওয়াল্টারের প্রশংসায় পঞ্চমুখর ছিলেন ক্লাব সমর্থকদের একটা বিরাট অংশ। এতো ঠান্ডা মাথায় একজন মানুষ কিভাবে ১২০ গজের পিচে দাম্ভিকতার সাথে ম্যাচ খেলতে পারে? তার সবচেয়ে বড় গুন ছিলো *একুরেট পাসিং এভিলিটি*। পহেলা সেপ্টেম্বরে সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয়ে গেলো ওয়াল্টারের। যথেষ্ট প্রসংশা কুঁড়ালেন সে ম্যাচে। তবে ভাগ্যের বিধিবাম, তাকে মুখোমুখি হতে হলো বর্ণবাদের। আমার মতে এটা হচ্ছে অতি সুন্দর ফুটবলের সবচেয়ে কুৎসিত দিক৷ পরের পাঁচটি ম্যাচে সাফল্যের সাথে খেলার পর তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হলো। ক্লাবের সাথে শেষটা মধুর হলো না ওয়াল্টারের। হার্বার্ট চ্যাম্পম্যানের নর্থহ্যাম্পটন টাউনে যোগ দেয়ার জন্য হোয়াইট হার্ট লেন ছাড়লেন ওয়াল্টার।
চ্যাপম্যানের দলে ওয়াল্টারের অন্তর্ভুক্তি ছিলো অভূতপূর্ব ব্যাপার। বলতে গেলে ফুটবলার ওয়াল্টার তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোয় ছিলেন এখানেই। একটা সময়ে নর্থহ্যাম্পটনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠলেন ওয়াল্টার। ওয়ার্টফোর্ডের বিপক্ষে ১৯১১ সালের অক্টোবরে অভিষেক হলো তার। পরবর্তী ৩ মৌসুমে শতাধিক ম্যাচ খেলা ওয়াল্টারকে ম্যানেজার হাফ-ব্যাক রুল থেকে সুইচ করলেন ইনসাইড ফরোয়ার্ডে৷ ক্লাব ছাড়ার সময় দেখা গেলো ওয়াল্টারে জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
তখন বিশ্বজুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রফেশনাল ফুটবল বন্ধ হয়ে গেলো। ওয়াল্টার ভাবলেন, ছোট্ট এই জীবনে প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তির হিসেব তো কম হলো না। এখন বরং রোমাঞ্চের মুখোমুখি হওয়া যাক। সিদ্ধান্ত পাকা করলেন। ফুটবল ছেড়ে সৈনিকের পোষাক জড়িয়ে যোগ দিলেন *দ্যা ফুটবলার ব্যাটেলিয়নে*। সে ইউনিটে ওয়াল্টারের মতো ফুটবলার ছাড়াও আরোও হাজারখানেক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যোদ্ধা অংশ নিলেন। উপরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেকি জানতো তার পথচলা কতটুকু বাকি আছে? উত্তরটা 'না'-ই হবে। মানুষ অসীম শূন্যে ভাসতে চায়। অজানাকে জানার নেশায় বুধ মানুষেরা জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে পছন্দ করে। ওয়াল্টার ছিলেন সে ধরনের একজন মানুষ।
সেভেন্টিন্থ ব্যাটেলিয়নে সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে পদোন্নতি দিয়ে সার্জেন্ট পদে ভূষিত করে মিডলসেক্স রেজিমেন্ট। ততোদিনে ওয়াল্টার ইটালিতে এক মিশনে পুরো একটি সৈনিকের দলকে লিড দিয়ে সবার প্রশংসার সাগরে ভাসছেন৷ ঘটনাটা ইতালির এক নদীর পাড়ে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ওয়াল্টার তার সঙ্গীদের বাঁচাতে লাফ দিয়ে পড়েন বারুদের সামনে।
সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারেরা ওয়াল্টারের অসীম সাহসীকতা ও নেতৃত্বগুনে মুগ্ধ হয়। ১৯১৬ সালের জুলাইয়ে *ব্যাটেল অব সোমো* তে যুদ্ধ লড়ার সাহসীকতার পরিচয় দেন। তবে পরিবেশ তাকে অসুস্থ করে তুলে৷ ট্রেঞ্চ ফিভারে আক্রান্ত হতে ওয়াল্টার ফেরত আসেন ইংল্যান্ডে। আরোগ্যলাভ না করতেই যোগ দেন অফিসার ট্রেইনিংয়ে। সে সময় ব্রিটেনে কেবল সাদা চামড়ার সৈনিকেরাই কেবল অফিসারের ট্রেইনিং নিতে পারতো। ওয়াল্টার এই পথে একমাত্র ব্যতিক্রম পথিক। অফিসার র্যাঙ্কের জন্য ট্রেইনিং নিতে তাকে সম্মতি জানানো হলো।
১৯১৭ সালের মে মাসের একদিন।
অনাথাশ্রমের সেই চৌকস ছেলেটা কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে র্যাঙ্ক পেয়ে গেলো! সার্জেন্ট থেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াল্টার।
লেফটেন্যান্ট ওয়াল্টারকে এবার পাঠানো হলো ইতালিয়ান ফ্রন্টে। এটা ছিলো ঐতিহাসিক এক সিদ্ধান্ত। ওয়াল্টার ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ আর্মির একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ অফিসার।
পুরোদস্তুর এক ফুটবলার সেনাবাহিনীতে কি কান্ডটাই না ঘটিয়ে বসলেন সেদিন৷ পাইভের ব্যাটেলে নেতৃত্ব দেয়া ছাড়াও লেলিহান আগুনের মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন ওয়াল্টার। সেদিন তাকে উপাধি দেয়া হয় *গ্যালেন্ট্রি এন্ড কোলনেস*। ওয়াল্টার ১৯১৮ পর্যন্ত ইতালিতে থাকলেন। এক ভীষণ অনিশ্চিত অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। ফ্রান্সে অবস্থানরত জার্মান আর্মিদের পুতা মাইন লাইন ভেঙ্গে তাদের উপর আক্রমণ করার অর্ডার দেয়া হয় ওয়াল্টারকে। হুকুম তালিমে সৈন্যদের নিয়ে নেমে পড়েন ওয়াল্টার। তাকে একটুও ভয়ার্ত দেখালো না। ওয়াল্টার দিন গুনছিলেন বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির। আর ফুটবল মাঠে পদচারণার।
২৫ মার্চ ১৯১৮।
সেদিন ওয়াল্টার নিশ্চয়ই ঈশ্বরকে স্মরণ করতে ভুলেন নি। কিন্তু বিধাতা লিখে রাখলেন অন্য এক কাব্যে। অনাকাঙ্ক্ষিত আক্রমনে বিপর্যস্ত হতে হয় ওয়াল্টারের দলকে। নো ম্যান্স ল্যান্ডে পৌঁছামাত্র জার্মানদের মুহুর্মুহু আক্রমণের শিকার হয় ব্রিটিশ আর্মি। জার্মান বাহিনির মেশিনগান বুকে বিঁধে ওয়াল্টারের। মাঠিতে লুঠিয়ে পড়লেন তিনি। তারপর সব স্তম্ভিত! এক নক্ষত্রের ঝরে পড়া দেখলো ব্রিটিশ আর্মি।
মৃত্যুর পর তাকে রাজকীয় *ব্রিটিশ ওয়ার* এবং *ভিক্টরি ম্যাডেল* প্রদান করা হয়। পাশাপাশি *মিলেটারি ক্রস*র জন্যেও ভূষিত করা হয় এই অকুতোভয় সৈনিককে।
ইতিহাস বলে কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। একজন সৈনিক ওয়াল্টার ড্যানিয়েলেরও মৃত্যু নেই। তার লাশ আলাদা করতে পারেনি ব্রিটিশ আর্মি; ফাউসবার্গের ওই মৃত্যুর মিছিলে স্তুপে বন্দী হয়ে রইলেন তিনি। কবরস্থানে এলিসের সাথে থাকা ছেলেরাও হয়তো ভাবে, বাবা- কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?
© আহমদ আতিকুজ্জামান।
- 0 মন্তব্য