মস্কো থেকে মিউনিখ - খলনায়ক থেকে মহানায়ক
পোস্টটি ২১৬২ বার পঠিত হয়েছে
ম্যাচের তখন সর্বসাকুল্যে দু’মিনিট বাকি। বামপ্রান্তে থেকে হুয়ান মাতার কর্ণার উড়ে এলো। জেরোম বোয়াটেংকে ফাঁকি দিয়ে লাফিয়ে তাতে মাথা ছোঁয়ালেন দিদিয়ের দ্রগবা। জোরালে হেডটা ম্যানুয়েল নয়্যার হাত লাগিয়েও ফেরাতে পারলেন না। পুরো ম্যাচে ব্যাকফুটে থাকা চেলসি ফুটবল ক্লাব ইউরোপীয় ফাইনালে সমতায় ফিরলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য টিভির পর্দায় “ব্লুজ” সমর্থকদের চেহারা ভেসে উঠলো। আশাভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়া মানুষগুলোই তখন বাঁধনহারা উল্লাসে মত্ত। টিভি সম্প্রচারে ইংরেজ ধারাভাষ্যকার মার্টিন টাইলারের জাদুকরের উপমাটার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়ঃ “তারা আবার টুপির ভেতর থেকে খরগোশ টেনে বার করতে সক্ষম হয়েছে।“ চেলসিকে ফের স্বপ্নদেখানো সেই জাদুকর দিদিয়ের দ্রগবা অবশ্য খলনায়ক বনতে সময় নিলেন না। অতিরিক্ত সময়ের তৃতীয় মিনিটে ফ্র রিবেরিকে ফাউল করে বায়ার্নকে উপহার দিলেন, সেমিফাইনালে ঠিক যেমনিভাবে সেমিফাইনালে দিয়েছিলেন বার্সোলোনাকে। কিন্তু সেদিন মেসি গোল করতে পারেননি, আজ পারলেন না আরিয়েন রবেনও। ভাগ্যবিধাতার প্রসন্নতায় নাকি কার্যকারণের মারপ্যাঁচে সেটা বোঝার উপায় নেই – তবে চেলসিকে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতার “সোনার হরিণ” জেতানো স্পটকিকটা নিলেন আফ্রিকার সেই মানুষটাই। মস্কোর সেই বৃষ্টিজেতা রাতের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে তখন গ্যালারির ছোট্ট নীল অংশটা আনন্দে উদ্বেল। ২৪ বছর বয়সের আগে যিনি কখনো প্রথম বিভাগ ফুটবল খেলেননি, ইউরোপে বড় হওয়া আর দশটা ছেলের মতো একাডেমিতে কাঠামোবদ্ধ শিক্ষার সুযোগ হয়নি যার, সেই দ্রগবাই চেলসির সবচেয়ে অবিস্মরণীয় রাতটার অবিসাংবাদিত নায়ক। তাঁর আগে-পরে হাজারো ফুটবলার পশ্চিম লন্ডনের ক্লাবটিতে এসেছে-গেছে, কিন্তু দিদিয়ের ইভ্স দ্রগবা তেবিলি একজনই।
পাঁচ বছর বয়স থেকেই বাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন দ্রগবা। নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় ফুটবলার চাচা মিশেল গবার হাত ধরে জন্মভূমি আইভরি কোস্ট ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমাতে হয় তাঁকে। নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে সমস্যা তো হবেই, বিশেষ করে যখন আপনার চামড়ার রং বাকি সবার চেয়ে আলাদা হবে। সেই ছোটটি থেকেই তাই দ্রগবা লাজুক, অন্তর্মুখী স্বভাবের। পেশাদার ফুটবলার হবার জন্য গবাকে নিয়মিত এক ক্লাব থেকে অন্য ক্লাবে বদলি হতে হতো, দ্রগবাও তাই থিতু হবার আগেই নতুন স্কুলের খাতায় নাম লেখানো। ফুটবল মাঠেও বাকি সবার মাঝে আলাদা করে চেনা যেত পশ্চিম আফ্রিকার ছেলেটিকে। কিন্তু বাবার কড়া নির্দেশ ছিল আগে পড়ায় মন দিতে হবে, এমনকি পিত্রাদেশ শিরোধার্য মেনে এক বছর দিদিয়ের ফুটবল খেলেননি। প্যারিস থেকে ৫ মাইল উত্তরের অপেশাদার দল লেভালোয়ার হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে হাতেখড়ি হয় দ্রগবার। এর মধ্যে অবশ্য বাবা-মাসহ পরিবারের বাকি সবাই পাড়ি জমিয়েছে ফ্রান্সে, অস্তিত্ব রক্ষার সার্বক্ষণিক লড়াইয়ের মাঝে ফুটবল খেলার সুযোগ সপ্তাহে একবারই হতো। তবে কোচ সেরেব্রেনকো রেপচিচ কাছে টেনে নিয়েছিলেন তরুণ দিদিয়েরকে। আঠারো বছর বয়সে ফ্রান্সের চতুর্থ বিভাগে অভিষেক, সমবয়সী থিয়েরি অরিরা তখন বিশ্বকাপের মঞ্চে আলো কাড়ছেন। পিএসজিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সুযোগ এসেছিল, কিন্তু চুক্তিসইয়ের টেবিল থেকে পাঁচ মিনিটের কথা বলে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন ক্লাব কর্মকর্তারা। সেদিন বড় ক্লাবে খেলার সুযোগ পাননি ঠিক, কিন্তু সফল হওয়ার নেশায় মেতেছিলেন।
এরপর দ্বিতীয় বিভাগের লা মান্স থেকে গুইগাম্প হয়ে ছেলেবেলার প্রিয় ক্লাব মার্শেইতে যোগ দেয়া। ২০০৩-৪ মৌসুমে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অভিষেক, “গ্যালাকটিকো”দের ভিড়ে ম্যাচের প্রথম গোলটা এসেছিল এই আইভরিয়ানের পা থেকেই। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপপর্বে তাঁর ৬ গোল সত্ত্বেও তৃতীয় হয়ে ইউয়েফা কাপে জায়গা হলো মার্শেইয়ের। পাঁচ গোল করে সেই প্রতিযোগিতায় দলকে শিরোপার দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছিলেন দ্রগবা, কিন্তু রাফা বেনিতেজের ভালেন্সিয়ার কাছে হার মানতে হলো অলিম্পিয়ানদের। তবে যা দেখার দেখে নিয়েছিলেন সদ্য ইউরোপজয়ী জোসে মরিনহো। ২৪ মিলিয়ন ইউরোপ খরচ করে চেলসিতে আনলেন দ্রগবাকে। অপরিচিত এক স্ট্রাইকারের পেছনে বড় অঙ্কের অর্থ ঢালা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে মরিনহো সাফ জানিয়েছিলেন, “ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার সময় ওকে মূল্যায়ন করবেন, তখন দেখা যাবে।“ ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে লন্ডনের ক্লাবটির কাছে বিক্রি করেছিল মার্শেই, দ্রগবার শুরুটা তাই যথেষ্ট নড়বড়ে ছিল। ক্লাবের সমর্থকদের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে সময় লেগেছে, স্কলারির সময়ে তো ব্রাত্যই হয়ে পড়েছিলেন। তবে বড় ম্যাচে প্রতিপক্ষের জন্য যম হয়ে উঠতেন সেই ব্যাপারে সন্দেহ নেই। চাচার কাছ থেকে দেহাবয়বের পূর্ণাংগ ব্যবহার আর হেড করাটা আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। তবে দ্রগবা শুধু গোল করেন বললে ভুল হয়ে যাবে। সতীর্থদের গোল বানিয়ে দেয়া কিংবা ফাঁকা জায়গা তৈরি করাতেও তাঁর জুড়ি ছিল না। বক্সের মাঝে ট্যাপ ইন, হেড, আচমকা ঘুরে শট কিংবা বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শট কিংবা চোখ ধাঁধানো সব ফ্রী-কিক – প্রিমিয়ার লিগের আধুনিক যুগে দ্রগবার মতো পরিপূর্ণ সেন্টার ফরোয়ার্ড খুব কমই দেখেছে বিশ্ব। বারবার সমর্থকদের আনন্দে ভাসালেও ক্যারিয়ারে একটা অতৃপ্তি থেকেই গিয়েছিল – চ্যাম্পিয়ন্স লিগের “হলি গ্রেইল”টা ছুঁয়ে দেখা হয়নি। মস্কোর সেই রাতে মেজাজ হারিয়ে লালকার্ড দেখেছিলেন, অসহায় চোখে শ্যুট-আউট লড়াইতে সতীর্থদের পরাজয় চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। পরের বছরের সেমিফাইনালে রেফারির “নিরপেক্ষ” সব সিদ্ধান্ত ফাইনালে পুরো চেলসি দলকেই দর্শক বানিয়েছিল। মিউনিখে অবশ্য নিজের গল্পের মধুর সমাপ্তিটা নিজ হাতে লেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, এবার ভুল করেননি। মরিনহোর দ্বিতীয় মেয়াদে আরেকবার চেলসিতে ফিরেছিলেন, এবার পার্শ্বচরিত্র হিসেবে অর্জনের লম্বা খাতায় আরেকটি লিগ ট্রফি যোগ হলো। লিগের শেষ ম্যাচে আবেগঘন বিদায় জানিয়ে দিলো ক্যারিয়ারে আটটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেললেও দ্রগবা শুধুই চেলসির। খেলার মাঠে ও মাঠের বাইরে অসামান্য অবদান হিসেবে এইতো সেদিন প্রথম আফ্রিকান ফুটবলার হিসেবে জিতে নিলেন “ইউয়েফা প্রেসিডেন্ট’স অ্যাওয়ার্ড”।
দ্রগবা অবসর নিয়েছেন, গোল করে চেলসিকে ট্রফি জেতানোর গুরুভারটা এখন অন্যদের হাতে। কিন্তু আজ থেকে অর্ধশতক পরেও কোন চেলসি সমর্থক যখন মিউনিখের সেই ফাইনালের কথা মনে করবেন, অগোচরেই শরীরে শিহরণ জাগবে, আলগোছে চোখ মুছে ফেলবেন হয়তো। কারণ সেদিনও স্মৃতির পাতা থেকে এতটুকু ম্লান হবেন না সেই আফ্রিকান বীর, টুপির ভেতর থেকে খরগোশ বের করা জাদুকর।
- 0 মন্তব্য