রোনালদো-রোনালদিনহো-কাকা কিন্তু রিভালদো?
পোস্টটি ৪৭৭০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ঘটনাটা ২০০২ সালের ৩রা জুনের। দক্ষিণ কোরিয়ার উলসান মুন্সু স্টেডিয়ামে তুরস্কের মুখোমুখি বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট ব্রাজিল। দক্ষিণ আমেরিকানরা রোনালদোর গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর ম্যাচে সমতা ফেরান তুরস্কের হাসান সাস। ৮৭ মিনিটে বিতর্কিত পেনাল্টি থেকে ব্রাজিলকে ফের এগিয়ে দেন রিভালদো। ম্যাচশেষের স্কোরলাইনও ছিল সেটা। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে সেই রিভালদোই। যোগ করা সময়ে ব্রাজিলের কর্নার নেয়ার জন্য ডানপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রিভালদোকে বল বাড়িয়ে দিলেন তুরস্কের হাকান উনসাল, হয়তো রেফারির সিদ্ধান্তে হতাশ উনসাল বেচারা বলের উপরেই সব রাগ ঝাড়তে চেয়েছিলেন। বল উড়ে গিয়ে লাগলো রিভালদোর উরুতে, কিন্তু মুখ চেপে ধরে মাটিতে ধরে এমনভাবে লুটোপুটি খেতে লাগলেন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার যে মনে হচ্ছিল উনসাল বুঝি তাঁকে গুলি করেই বসেছেন। স্বাগতিক দেশের রেফারি কিম ইয়ং-জু তুর্কিদের হতাশা বাড়িয়ে উনসালকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দিলেন। অভিনয়ের মাধ্যমে ম্যাচ পরিচালকদের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টা ফুটবলে ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় রিভালদোকে বর্তমান প্রজন্মের অনেকে কেবল এই “ডাইভ” এর জন্যই মনে রেখেছে। তাই হয়তো ক্যারিয়ারে সবকিছু জেতার পরেও রোনালদো-রোনালদিনহো-কাকাদের আড়ালে তাঁর নামটা অন্যায্যভাবে কিছুটা আড়ালেই থেকে যায়। নাকি রিভালদো অতোটা গ্ল্যামারাস নন?
-
আর দশজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের মতোই চরম দারিদ্র্যের মাঝে রিভালদোর বেড়ে ওঠাটা। তবে অবহেলা, অযত্ন কিংবা ক্ষুধা তাঁর শরীরে চিরদিনের মতো ছাপ রেখে আছে। রিভালদোর কোটরে ঢোকানো চোখজোড়া, ভেতরের দিকে বাঁকানো পা সেই চরম পুষ্টিহীনতারই নির্মম পরিচায়ক। তবে রেসিফের রাস্তায় নির্মম বাস্তবতাকে ভুলিয়ে দেয়া এক ভালোবাসার খোঁজ পেয়ে গেলো ছোট্ট রিভালদো – ফুটবল তাঁর নাম। পলিস্তানো ফুটবল ক্লাবের কোচেরা সন্দিহান ছিলেন শীর্ণকায় ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু ফুটবল মাঠে তাঁর অবিশ্বাস্য কীর্তিতে মুগ্ধ হয়ে ছেলেটাকে দলে টানলেন তাঁরা। কিছুদিন আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা রোমিলদোকে হারিয়ে দিশেহারা রিভালদোর শোককে শক্তি বানিয়ে পথচলার শুরু সেখানেই।

-
ইউরোপের রিভালদোর পা পড়ে বেশি দেরিতেই। ১৯৯৬ সালে দেপোর্তিভো লা করুনিয়ায় যোগ দেয়ার আগে তাঁর জীবনে ২৪টি বসন্ত কেটে গেছে। খেলেছেন সান্তা ক্রুজ, মোগি মিরিম, করিন্থিয়ানস ও পালমেইরাসের হয়ে। গালিসিয়ার ক্লাবটিতে এসে অবশ্য মানিয়ে নিতে মোটেই সময় লাগলো না ব্রাজিলিয়ান জাদুকরের। ৪১ ম্যাচে ২১ বার নিশানা ভেদ করলেন রিভালদো, দেপোর্তিভো লিগ শেষ করলো টেবিলের তৃতীয় স্থানে থেকে। বড় ক্লাবের টনক নড়লো অবশেষে। বার্সেলোনা তাঁকে দলে ভেড়াতে দেপোর্তিভোর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ২৩.৫ মিলিয়ন ইউরো যোগ করে দিলো। বর্তমান সময়ে হয়তো নেইমারের পায়ের একখানা আঙ্গুলের দামই এমন, তবে ১৯৯৭ সালে সেটা চমকে যাবার মতো অঙ্কই ছিল। কারণ দলবদলে বিশ্বরেকর্ড ছিল বার্সেলোনায় যার শুন্যস্থান পূরণ করতে এসেছেন সেই রোনালদোর দখলে (বার্সেলোনা থেকে ইন্টার মিলান, ২৮ মিলিয়ন ইউরো)। লুই ফন হালের অধীনে রিভালদোর শুরুটা হলো দুর্দান্ত। গতি, ড্রিবলিং আর শারীরিক সক্ষমতার দুর্লভ এক মিশেলে প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন এই “পারনামবুকানো”। প্রথম মৌসুমে লিগে ১৯ গোলসহ সবমিলিয়ে ২৮ গোল করলেন, বার্সাও লা লিগা ও কোপা দেল রে এর “ডাবল” জিতে নিলো। পরের মৌসুমে লিগে ২৪ গোলসহ ২৯ গোল করলেন। তবে এবার লা লিগার সাফল্য ছাপিয়ে ব্যক্তিগত অর্জনটাই হয়তো বেশি করে মনে পড়বে রিভালদোর। তিনি যে ১৯৯৯ সালের ফিফা বর্ষসেরা ও ব্যালন ডি’অর দুটো পুরস্কারই ঝুলিতে পুরলেন। ১৯৯৯-০০ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১০ গোল করলেও ভালেন্সিয়ার কাছে প্রতিযোগিতার সেমিফাইনাল পর্বে বাদ পড়ে গেলো বার্সেলোনা। ওদিকে রিভালদো ও দলের ডাচ কোচ ফন হালের দ্বন্দ্ব তখন চরমে পৌঁছেছে। রিভালদো চান তাঁর পছন্দের “নম্বর টেন” এর ভূমিকায় খেলতে, কিন্তু ফন হাল তাঁকে বাঁ উইং থেকে সরাতে নারাজ। তবে শেষ পর্যন্ত দলের ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে ২০০০-১ মৌসুমে ফন হাল সরে দাঁড়ালেন, রিভালদো যেন মুক্তির স্বাদ পেয়ে খেলায় পুরনো ধারটা ফিরে পেলেন।
-
মৌসুমটা অবশ্য বার্সেলোনার জন্য যেন ছিল সাক্ষাৎ এক দুঃস্বপ্ন। ফন হালের বিদায়ের পর দলের দায়িত্ব দেয়া হলো লরেনযো ফেরারকে। তবে বাজে ফর্মের কারণে তাঁকেও বরখাস্ত করে কার্লোস রেক্সাসকে প্রধান কোচের ভূমিকায় আনা হলো। লিগের শেষদিকে অভিয়েদো আর ভায়াদোলিদের বিপক্ষে পয়েন্ট খুইয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলাই শংকার মুখে পড়লো। লিগের শেষ ম্যাচে টানা দু’বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রানার্স-আপ হওয়া ভালেন্সিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে নামার আগে “ব্লাউগারানা”দের সামনে জয়ের বিকল্প ছিল না। তিন পয়েন্টে এগিয়ে থাকার সুবাদে এক্তর কুপারের দলের অবশ্য পরাজয় এড়ালেই চলতো। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের চূড়ান্ত প্রদর্শনী নিয়ে ২০০১ সালের ২১শে জুনের সেই রাতটাকে একেবারে নিজের করে নিলেন রিভালদো। চতুর্থ মিনিটেই বাঁ পায়ের “ট্রেডমার্ক” দুর্দান্ত এক ৩০ গজি ফ্রী-কিকে বার্সেলোনাকে এগিয়ে দিলেন। স্প্যানিশ লিগের সেরা গোলরক্ষক ক্লদিও ক্যানিজারেসের পক্ষে অসহায়ের মতো চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। রুবেন বারাহা ভালেন্সিয়াকে সমতায় ফেরানোর পর ফের আঘাত হানলেন রিভালদো। এবার টানা দুটো ‘ফেইন্ট” দিয়ে একজোড়া ভালেন্সিয়া ডিফেন্ডারকে নাস্তানাবুদ করে বাঁ পায়ের জোরালো শট নিলেন, কাকতালীয়ভাবে সেই ফ্রী-কিকের কাছাকাছি জায়গা থেকেই। ক্যানিজারেস সময়মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেও সেই শট ফেরাতে পারলেন না। তাঁর হাতে লেগে বল জালে জড়ালো। বিরতির দু’মিনিট পরেই অবশ্য দ্বিতীয়বারের মতো ভালেন্সিয়াকে ম্যাচে ফেরালেন বারাহা। এরপর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বার্সার ডাগআউটে দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছিল। চোখের নিমিষেই যেন ম্যাচের সময় শেষ হয়ে আসছিল, ভালেন্সিয়া সমর্থকেরা তখন ২২০ মাইলের ফিরতিযাত্রায় উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট বাকি থাকতে ফ্রাঙ্ক ডি বোর বক্সের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রিভালদোকে চিপ করে পাস দিলেন। বুকের ধাক্কায় দিয়ে বলটাকে আকাশমুখী করলেন রিভালদো, এরপর গোলের দিকে পেছন ফেরা অবস্থাতেই তাঁর বিখ্যাত বাইসাইকেল কিকে বলটাকে পাঠিয়ে দিলেন জালে। আদুল গায়ে জার্সি ঘোরাতে ঘোরাতে সতীর্থদের মাঝে হারিয়ে গেলেন রিভালদো, ভিআইপি বক্সে ক্লাব প্রেসিডেন্ট হোয়ান গাস্পারের তখন পাগলপ্রায় অবস্থা।

-
তবে রিভালদোর সেরাটা বোধহয় দেখেছে আন্তর্জাতিক মঞ্চ। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তিনটি গোল করেছিলেন। মরক্কোর বিপক্ষে গ্রুপপর্বে গোলের পর কোয়ার্টার ফাইনালে শ্মাইকেল-লাউড্রাপদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী ডেনমার্কের বিপক্ষে করলেন জোড়া গোল। পরের বছরের কোপা আমেরিকায় পাঁচ গোল করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হলেন, কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সমতা ফেরানো ফ্রী-কিক তাঁর সংগ্রহে। উরুগুয়ের বিপক্ষে ফাইনালে করেছিলেন জোড়া গোল। ২০০২ বিশ্বকাপে প্রথম পাঁচ ম্যাচে রোনালদোর সাথে পাল্লা দিয়ে গোল করছিলেন। পাঁচ ম্যাচে পাঁচবার জাল খুঁজে পেয়ে একপর্যায়ে গোল্ডেন বুটের দৌড়ে রোনালদোর চেয়ে এগিয়েও ছিলেন। ফাইনালে গোল না করলেও দুটো গোলেই তাঁর অবদান ছিলো। তাঁর বাঁ পায়ের শট ঠেকাতে গিয়েই গড়বড় করে ফেলেছিলেন অলিভার কান, সুযোগ লুফে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি রোনালদোকে। দ্বিতীয় গোলের ঠিক আগে দারুণ এক "ডামি" দিয়ে রোনালদোর জন্য জায়গা তৈরি করে দিয়েছিলেন। বিশ্বকাপে আট গোল নিয়ে ফুটবলের সর্বোচ্চ মর্যাদার টুর্নামেন্টে যৌথভাবে নবম রিভালদো। বিশ্বকাপে তাঁর চেয়ে বেশি গোল করেছেন মাত্র চারজন ব্রাজিলিয়ান (জেয়ারজিনহো, তোস্তাও, পেলে ও রোনালদো)। ৭৪ ম্যাচে ৩৫ গোল নিয়ে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় সপ্তম স্থানে এই ফুটবল কিংবদন্তি। পাঁচ মৌসুম খেলেই বার্সেলোনার ইতিহাসে যৌথভাবে অষ্টম স্থান প্রমাণ করে পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার না হলেও গোলের ব্যাপারে রিভালদোর মোটেই অরুচি ছিলো না। দারুণ গতির সাথে চোখ-ধাঁধানো ড্রিবলিং আর বলের উপর অসামান্য নিয়ন্ত্রণ – লম্বাটে খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে এই তিনের সমন্বয়টা সহজে চোখে পড়ে না। বাতাসেও দারুণ দক্ষ ছিলেন, বাঁকানো ফ্রী-কিকগুলো জালের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে বহুবার, বক্সের বাইরে থেকে গোলার মতো শটে যেন জাল ছিঁড়ে নিতে চাইতেন। বাইসাইকেল কিকের প্রতি টানটা একটু বেশিই ছিল। রিভালদো মানেই যেন বাহারি সব গোলের পসরা। ক্রমশই দুর্লভ হয়ে পড়া “নম্বর টেন” প্রজাতির এক পূর্ণাংগ প্যাকেজ ছিলেন বাঁকা পায়ের এই ফুটবলার।

বার্সেলোনা-মিলান পরবর্তী জীবনে গ্রীস, উজবেকিস্তান, আঙ্গোলা ঘুরে শেকড়ের টানে ব্রাজিলে ফিরে গেছেন। মোগি মিরিমের হয়ে ছেলে রিভালদিনহোর সাথে একই ম্যাচে খেলেছে রেকর্ড গড়েছেন, সেই ম্যাচে গোলও করেছেন বাপ-বেটা। বিশ্বকাপ-চ্যাম্পিয়ন্স লিগ-ব্যালন ডি’অর মুকুটত্রয়ী জেতা মাত্র আটজন ফুটবলারের একজন হলেও তাঁকে নিয়ে আলোচনাটা সবচেয়ে কম হয়। হয়তো ইউরোপে মাত্র সাত মৌসুম খেলার কারণে চোখের আড়ালেই থেকে গেছেন ক্যারিয়ারের বেশিরভাগজুড়ে; তাই বোধহয় রোনালদো, রোনালদিনহো কিংবা কাকার মতো পাদপ্রদীপের আলো তাঁকে সেভাবে খুঁজে পায়নি। কিন্তু তাঁর খেলা যারা দেখেছেন তারা রিভালদোকে ভুলবেন না সেই নিশ্চয়তা দিতে পারি। বিখ্যাত হলুদ জার্সি খুলে মাথার ওপরে ঘোরাতে ঘোরাতে উদযাপনের দৃশ্যগুলো তাই চাইলেই চট করে দেখে নিতে পারেন। বাঁকা পায়ের এক ফুটবল শিল্পী মাঠের সবুজ ক্যানভাসে অবিস্মরণীয় সব সৃষ্টি করে গেছেন, কেউ স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে চাইলেই তো সেগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে না!
- 0 মন্তব্য