• ফুটবল

রিওর বাস ও থিয়াগো সিলভা হয়ে ওঠা

পোস্টটি ২৭৭৮ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

রেগেমেগে স্টিয়ারিং হুইলের ওপরেই এক ঘা বসিয়ে দিলেন লুই পেরেইরা। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়? ভদ্রলোক বাস চালা, তাও আবার পৃথিবীর অন্যতম যানযট প্রবণ শহর রিও ডি জেনিরোতে। তাই এমন ভর সন্ধ্যেবেলায় আধঘণ্টার রাস্তা পেরোতে দু'ঘণ্টা লেগে যাওয়াটাও বিচিত্র কিছু নয়। তবে আজ যেন কোনোভাবেই মেজাজ ঠাণ্ডা করতে পারছেন না পেরেইরা সাহেব, মনের অজান্তেই কুঁচকে গেছে ভুরু। মনে মনে ট্রাফিক সিস্টেমের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন। হ্যাঁ, আজও সেই ছোঁড়াটা এই বাসে উঠেছে। ছেলেটার পরনে স্কুল ইউনিফর্ম, শীর্ণ মুখখানায় অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিকটা বেশ স্পষ্ট। বাসভাড়ার টাকাটা বাঁচাতে স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে যাতায়াত করে ছেলেটা, আজকের গন্তব্যও নিশ্চয়ই ফুটবল মাঠ। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন পেরেইরা। আহ্‌, সেই ফুটবল, সেই আবেগ। তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু লুকাও তো ফুটবলার হতে চেয়েছিল, কিন্তু ডিফেন্ডারদের নাকানিচুবানি খাইয়ে মাঠের বাঁ প্রান্ত ধরে বল পায়ে উড়ে বেড়ানো ছেলেটা দুর্বৃত্তের ছুরিটাকে পরাস্ত করতে পারেনি। এলাকার বন্ধু রবার্তোকে সবাই চিনতো রেন্তোর "পেলে" হিসেবে - তবে ফুটবল মাঠ নয়, রবার্তোর বেঁচে থাকার সংগ্রামটা চলে জুতো সেলাই করে। এমন নজির চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ফুটবলের দেশ হলেও ক'জনই বা ফুটবলকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে পারে? লুই পেরেইরা তাই গোধূলির নিভে যাওয়া আলোতে পেছনের সিটে বসা ছেলেটার কোনো সম্ভাবনা দেখেননি। তবে থিয়াগো এমিলিয়ানো দা সিলভা কিন্তু ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা ঠিকই পূরণ করতে পেরেছেন। 

 

Barcelona-v-AC-Milan-Thiago-Silva-celeb_2650807

 

১৯৮৬ সালে রিওতে জন্ম থিয়াগো সিলভার, আর দশজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের মতো তাঁর বেড়ে ওঠাটাও নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে। একদম অল্প বয়সেই মা-বাবার ছাড়াছাড়ি দেখতে হয়ে ছোট্ট থিয়াগো। তবে মা অ্যাঞ্জেলা আর সৎ বাবা মিলে বাবার অভাব ঘুচিয়ে দেবার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। শহরের যে অংশে থিয়াগোদের বাড়ি, তার চারপাশ থেকে নিয়মিত গুলির আওয়াজ ভেসে আসতো। তবে সেদিকে ধ্যান দেওয়ার ফুরসত ছিলো না থিয়াগোর। সুযোগ পেলেই বন্ধুদেরকে নিয়ে রাস্তায় ফুটবল খেলতে নেমে যেতো সে। পিচঢালা পথে খালি পায়ে ফুটবল খেলার অভিজ্ঞতা যে খুব একটা আরামদায়ক ছিল না সেটা বলাই বাহুল্য, কিন্তু অভিযোগ করার সুযোগ কোথায়? কিছুদিনের ভেতরেই স্থানীয় এক ক্লাবে অনুশীলনের সুযোগ এলো থিয়াগোর সামনে। এরপর বাসে বাসেই দিনের অর্ধেকটা কেটে যাওয়া। বাস-স্কুল-বাস-অনুশীলন-বাস-বাসা। কিন্তু পরিশ্রমের প্রতিদান যে মিলছিল না। ফ্লুমিনেঞ্জের অধীনে থাকা স্কুলে পড়লেও বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ হচ্ছিল না তাঁর। মাদুরেইরা, ওলাইরা, বোতাফোগো কিংবা ফ্লামেঙ্গোর মতো ক্লাবে ট্রায়াল দেওয়ার পরেও ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছিল থিয়াগোকে। স্থানীয় ক্লাব বার্সেলোনোর হয়ে কিছুদিন খেলার পর তৃতীয় বিভাগের ক্লাব আর. এস. ফুতেবল হয়ে পেশাদার ফুটবলে অভিষেক। দারুণ পরিণত পারফর্মেন্সে সবাইকে দারুণভাবে মুগ্ধ করলেন, ইতালির ক্লাব রোমাও তাঁকে দলে ভেড়াতে আগ্রহী ছিল। তবে সিলভা যোগ দিলেন ব্রাজিলেরই আরেক ক্লাব যুভেনতুদেতে। এক মৌসুমেই নিজেকে আলাদাভাবে চিনিয়ে ফেললেন সিলভা, তাঁর দস্তখত নিতে তাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো পরাশক্তিরা। সবাইকে পেছনে ফেলে সেই দৌড়ে সফল হলো দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলারদের ইউরোপীয় আঁতুড়ঘর এফসি পোর্তো। স্বপ্নপূরণের পালা চলে এসেছে।

 

thiago-silva-football-soccer-player-pass-kiss-hd-free-mobile-desktop-background-download-photos

 

তবে ক্যারিয়ারটা আবার উল্টোপথে হাঁটা শুরু করলো। পোর্তোর রিজার্ভ দলের হয়ে কিছুদিন খেলার পর নিয়মিত ফুটবলের আশায় সিলভা পাড়ি জমালেন রাশিয়ায়, ধারে ডাইনামো মস্কোর হয়ে খেলবেন। তবে ক্রান্তীয় রৌদ্দ্রোজ্জ্বল আলো-বাতাসে বড় হওয়া সিলভা বরফের দেশে গিয়ে কঠিন অসুখ বাঁধিয়ে বসলেন। যক্ষ্মার কষাঘাতে দেশে ফিরে আসতে হলো, ম্যায়ের আশ্রয় না পেলে হয়তো ফুটবলটাও ছেড়ে দিতে হতো। ব্রাজিলে এসে ফ্লুমিনেনযেতে চোখ দিলেন সিলভা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ফ্লুমিনেনযেতে ২০০৬-২০০৯ এই তিন বছর ছিলেন সিলভা, এর মধ্যেই নিজেকে ব্রাজিলের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ফের ইউরোপে যাবার ডাক এলো, এবার ইতালীয় পরাশক্তি মিলানের হয়ে খেলার প্রস্তাব এলো। ১০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বিখ্যাত লাল-কালো ডোরাকাটা জার্সি গায়ে চাপানোর সুযোগ পেলেন সিলভা। 

 

silva

 

মিলানেও তাঁর স্থায়িত্বকাল ছিল তিনটি মৌসুম। সেরি আ জিতলেন, তবে একেবারে নিজের করে নিলেন ফুটবল ভক্তদের হৃদয়। এসি মিলান নামক ক্লাবটির সুদীর্ঘ সাফল্যমণ্ডিত ইতিহাসে গ্রেট ডিফেন্ডারের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ, সেই তালিকায় আধুনিক সংস্করণে হয়তো থিয়াগো সিলভার নামটাও থাকবে। তাঁকে দলে ভেড়াতে তাই মোটেও কিপ্টেমি করেনি পিএসজি, ৪২ মিলিয়ন ইউরো অঙ্কটা তখন রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের জন্য রেকর্ড ছিল। ফরাসি ফুটবলে পিএসজির একাধিপত্যের পেছনে সিলভার অবদানটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হবার দরকার পড়ে না। ক্লাব ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাটাই বাকি ছিল, গত মৌসুমে হাতছোঁয়া দূরত্বে এসেও বায়ার্নের কাছে হার মানতে হয়েছে। 

 

ব্রাজিল জাতীয় দলের গল্পটাও ব্যর্থতার ছেদচিহ্ন দিয়ে ভরা। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে সাইডলাইনে বসে সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে সতীর্থদের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখতে হয়েছে তৎকালীন সেলেসাও অধিনায়ককে। এক কোপা আমেরিকা ছাড়া বড় টুর্নামেন্ট জেতা হয়নি। বয়সের ভার তাঁর গতির রাশ ধরে টান মেরেছে, তবে সেই হেডিং, পজিশনিং, ট্যাকেল যেন আগের মতোই রয়ে গেছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার স্বপ্নটা হয়তো বর্তমান বাস্তবতায় একটু বাড়াবাড়িই বলা চলে। তবে একটা স্বপ্ন তিনি নিশ্চিতভাবেই দেখেন। মরুদ্যানের বুক চিরে জেগে ওঠা ঘাসের গালিচায় দাঁড়িয়ে মাথার ওপর সোনার ট্রফিটা তুলে ধরছেন। কাতার বিশ্বকাপটাই শেষ সুযোগ? সিলভারা পারবেন? বাস্তবের কাঁটা বিছানো পথ পেরিয়ে স্বপ্নটাকে হাতের মুঠোয় পুরে নেয়ার কাজটা সহজ হবে না। তবে অজানা গন্তব্যে ছুটে চলাটাই তো জীবন। রিওর বাসগুলো কিন্তু থিয়াগো সিলভাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে একটিবারের জন্যও ভুল করেনি।