দ্য গোল্ডেন জেনারেশন অব স্পেন অ্যান্ড বিউটিফুল ফুটবল
পোস্টটি ২০৭০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।
ব্লগের নীতিমালা
ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।
স্পেন।
বিশ্ব ফুটবলে অতি পরিচিত নাম। বরাবর ভালো মানের খেলা উপহার দিয়ে নজর কেড়েছে বিশ্ববাসীর।
তবে সাফল্যের দিক থেকে বেশ পিছিয়েই ছিলো এ দলটা। গত শতকে বড় সাফল্য বলতে সত্তরের দশকে একবার ইউরো জয়, আর ১৯৯২ অলিম্পিকে স্বর্ণজয়। কিন্তু স্পেনের জন্য এটি আসলে নগণ্যই বলা যায়।
তবে একবিংশ শতকে এসে ফুটবল বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার শুরু করে স্প্যানিশরা। শুধু আধিপত্যই নয়, বিশ্ববাসীকে মাতিয়ে রাখে সুন্দর ফুটবল দিয়ে। সেটার সূচনা হয় মূলত ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের পর থেকে।
স্প্যানিশ ফুটবলে নতুন ধারা : টিকি-টাকা
২০০৬ সালে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় জার্মানিতে। তাতে বেশ ভালো প্রত্যাশা নিয়েই অংশ নেয় স্পেন। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাউন্ড অব সিক্সটিনে কোয়ালিফাইও করে। কিন্তু সেখানে জিদানের ফ্রান্সের কাছে ৩-০ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয় টুর্নামেন্ট থেকে।
বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার পর স্পেনের তৎকালীন কোচ লুইস আরাগোনেস বুঝতে পারেন, ফিজিক্যাল ফুটবল খেলে আসলে এ স্পেন দল প্রতিপক্ষের সাথে পেরে উঠবেনা। এ ভাবনা থেকেই তিনি স্প্যানিশ ফুটবলে নিয়ে আসেন সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারা, যার নাম টিকি-টাকা।
টিকি-টাকা হলো এমন একটি কৌশল, যেখানে লং পাস ও কাউন্টার এটাকের পরিবর্তে ছোট ছোট পাস ও পোজেশন ভিত্তিক ফুটবল কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটা কিছুটা ক্রুইফের নেদারল্যান্ডসের টোটাল ফুটবলের মতো। জার্মান সাংবাদিক রাফায়েল হোনিংস্টেইন এটিকে ডাচ টোটাল ফুটবলের "আপগ্রেডেড ভার্সন" হিসেবে বর্ণনা করেন।
ইউরো ২০০৮ : সাফল্যের সূচনা
নতুন ধারার ফুটবলের সাথে তখনকার স্পেন দলে আসে একঝাঁক তারুণ্যে ভরপুর খেলোয়াড়। পিক টাইমে থাকা ক্যাসিয়াস, পুয়োল, তোরেস, ভিয়া; সাথে ইয়ংস্টার রামোস, জাভি, ইনিয়েস্তা, ফ্যাব্রেগাস; সব মিলিয়ে নতুন ধারার সাথে সাথে সাফল্য সারথি এক সোনালি প্রজন্ম পেয়ে যায় স্পেন। আর কি লাগে!
কোয়ালিফাইং রাউন্ডে এফ গ্রুপের শীর্ষে থেকে ২০০৮ ইউরোর জন্য কোয়ালিফাই করে স্পেন। মূল পর্বে গিয়ে গ্রুপ পর্বের সবকটি ম্যাচে জয় পায় তারা। এর মধ্যে রাশিয়ার বিপক্ষে জয় পায় ৪-১ এ, আর সুইডেন ও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন গ্রিসের বিরুদ্ধে জয় আসে ২-১ গোলের ব্যবধানে।
কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের প্রতিপক্ষ হয়ে আসে তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালি। সে ম্যাচে ইতালির ডিফেন্সিভ ফুটবলের বিরুদ্ধে অনেক চেষ্টা করেও গোলের দেখা পায়নি স্পেন। ফলে গোলশূন্য ড্র তেই শেষ হয় নির্ধারিত সময়। খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। তাতে স্পেনের বাজিমাত। ৪-২ এর জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ক্যাসিয়াস-পুয়োলরা।
সেমিতে আবারও দেখা হয় গ্রুপ পর্বের চেনা প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সাথে। এবার জয় আসে কোনো গোল হজম না করেই, ৩-০ গোলের ব্যবধানে।
অবশেষে আসে ফাইনাল। ভিয়েনার আর্নস্ত-হ্যাপল-স্তাদিয়নে সে ম্যাচে স্পেনের মুখোমুখি হয় চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। সে ম্যাচে ৩৩ মিনিটের মাথায় ফার্নান্দো তোরেসের একমাত্র গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে স্পেন। সেই সাথে দ্বিতীয়বারের মতো হাতে তোলে ইউরোর সেই রুপালী ট্রফি টা। ১৯৬৪ সালের পর এটিই ছিলো তাদের প্রথম মেজর শিরোপা জয়।
সেই ইউরোতে ১২ গোল করে টপ স্কোরিং টিম ছিলো স্পেন। চার গোল করে শীর্ষ গোলদাতা হন ডেভিড ভিয়া। টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন জাভি হার্নান্দেজ।
২০০৮ ইউরো জয়ের পরেই ম্যানেজারের পদ থেকে সরে দাঁড়ান আরাগোনেস। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ভিসেন্তে দেল বস্ক।
বিশ্বকাপ ২০১০ : এবার যাত্রা বড় আসরে
ইউরোর সব তারকারা দলে ছিলোই, আবার যুক্ত হয় আরও কিছু নতুন তারকা। তাদের মধ্যে ছিলো পিকে, বুসকেটস, আলোনসো প্রভৃতি। সব মিলিয়ে আরও শক্তিশালী দল নিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে লা রোজারা।
কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ১০ টি ম্যাচের সবগুলিতে জয়লাভ করে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০১০ বিশ্বকাপে অংশ নেয় স্পেন। তাই ফেভারিটের তকমা নিয়েই সেবারের আসর শুরু করে দেল বস্কের শিষ্যরা।
গ্রুপ পর্বে স্পেনের গ্রুপে তাদের সঙ্গী হয় সুইজারল্যান্ড, চিলি ও হন্ডুরাস। তুলনামূলক কঠিন গ্রুপই বলা চলে।
বাজে ভাবেই সে আসর শুরু করে জাভি-ইনিয়েস্তারা। প্রথম ম্যাচেই পরাজিত হয় সুইসদের কাছে। তবে ঘুরে দাঁড়ায় তারপরই। গ্রুপ পর্বের বাকি দুইটি ম্যাচ জিতে উঠে যায় রাউন্ড অব সিক্সটিনে।
দ্বিতীয় রাউন্ডে তারা হারায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে। অতঃপর কোয়ার্টার ফাইনালে টুর্নামেন্টের আন্ডারডগ প্যারাগুয়ের বিপক্ষে জয় আসে ১-০ তে। সেই সাথে ১৯৫০ সালের পর প্রথমবারের মতো শেষ চারে ওঠে স্পেন। তাতেও থেমে থাকেনি। সেমি ফাইনালে কার্লেস পুয়োলের হেড থেকে পাওয়া একমাত্র গোলে জয় নিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় তারা।
জোহানসবার্গের সেই ফাইনালে স্পেন মুখোমুখি হয় আরেক গোল্ডেন জেনারেশন রোবেন-স্নেইডারদের নেদারল্যান্ডসের। দুই সোনালি প্রজন্মের সে ম্যাচে একের পর চলতে থাকে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে গোলের দেখা পেতে ব্যর্থ হয় দু দলই। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে সেস্ক ফ্যাব্রেগাসের পাস থেকে জয়সূচক অসাধারণ গোলটি করেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। সেই সাথে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা ঘরে তোলে স্প্যানিশরা।
ফাইনাল ম্যাচে স্পেনের পাঁচজন হলুদ কার্ড দেখে, আর ডাচদের দলে হলুদকার্ড দেখে আটজন ও একজন দেখে লাল কার্ড। বিশ্বকাপ ফাইনালে এটিই ছিলো সর্বোচ্চ কার্ড দেখার রেকর্ড।
পুরো টুর্নামেন্টে স্পেন মাত্র আট গোল করে ও মাত্র দুটি গোল হজম করে। বিশ্বকাপজয়ী কোনো দলের জন্য দুই ক্ষেত্রেই এটি সর্বনিম্ন সংখ্যা। সেই সাথে বিশ্বকাপ ইতিহাসে তারাই একমাত্র দল, যারা টুর্নামেন্টের শেষ চার ম্যাচে কোনো গোল হজম করেনি। আবার, বিশ্বকাপে তারাই একমাত্র দল, যারা টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ হারার পরও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্বিতীয় দল ও প্রথম ইউরোপিয়ান দল হিসেবে তারা নিজ মহাদেশের বাইরে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়।
পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র দুটি গোল হজম করে সে বিশ্বকাপে গোল্ডেন গ্লাভস জয় করেন ইকার ক্যাসিয়াস। ডেভিড ভিয়া জেতেন ব্রোঞ্জ বল ও সিলভার বুট।
ইউরো ২০১২ : এবার সময় রেকর্ড গড়ার
বিশ্বকাপের পর ইউরো কোয়ালিফায়ারেও সবকটি ম্যাচে জয় নিয়ে মূল পর্বে জায়গা করে নেয় স্পেন।
মূলপর্বে স্পেনের গ্রুপসঙ্গী হয় ইতালি, ক্রোয়েশিয়া ও আয়ারল্যান্ড। প্রথম ম্যাচে ইতালির বিপক্ষে শুরুতে গোল হজম করেও শেষে ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে স্পেন। দ্বিতীয় ম্যাচে ডেভিড সিলভা ও সেস্ক ফ্যাব্রেগাসের সাথে ফার্নান্দো তোরেসের জোড়া গোলে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বড় জয় আসে। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ৮৮ মিনিটে জেসুস নাভাসের গোলে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জয় পায় স্পেন।
কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেন মুখোমুখি হয় ফ্রান্সের। জাবি আলোনসোর জোড়া গোলে সে ম্যাচে সহজ জয় পায় লা রোজারা। সেমি ফাইনালে প্রতিপক্ষ হয়ে আসে রোনালদোর পর্তুগাল। সে ম্যাচে স্পেনকে বেশ স্ট্রাগল করতে হয়। শেষপর্যন্ত মূল সময়ের পর অতিরিক্ত সময়ও শেষ হয় গোলহীনভাবেই। খেলা গড়ায় ট্রাইব্রেকারে। তাতে জয়লাভ করে স্পেন, সেই সাথে চতুর্থবারের মতো পৌঁছে যায় ইউরোর ফাইনালে।
ফাইনালে স্পেন মুখোমুখি হয় গ্রুপ পর্বের সঙ্গী ইতালির। সে ম্যাচে শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় স্প্যানিশরা। পুরো ম্যাচে তেমন কোনো সুযোগই পায়নি আজ্জুরিরা। ম্যাচজুড়ে ডোমিনেট করে স্পেন। প্রথমার্ধেই ডেভিড সিলভা ও জর্ডি আলবার গোলে তারা এগিয়ে যায় ২-০ তে। দ্বিতীয়ার্ধে গোল করে ফার্নান্দো তোরেস ও হুয়ান মাতা। সেই সাথে ইতালি কে ৪-০ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ইউরো জয় করে স্পেন। তিন গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন ফার্নান্দো তোরেস।
এ বিশ্বকাপ জয়ে বেশ কিছু রেকর্ড গড়ে লা রোজারা। তারা ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা তিনটি মেজর ট্রফি জয়ের গৌরব অর্জন করে। ১৯৭৬ সালে জার্মানির পর প্রথম দল হিসেবে ডিফেন্ডিং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইউরোর ফাইনালে ওঠে স্পেন। জার্মানির পর দ্বিতীয় দল হিসেবে তারা সর্বোচ্চ তিনটি ইউরো জয়ের গৌরব অর্জন করে। স্পেন একমাত্র দল, যারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মহাদেশীয় শিরোপা পুনরুদ্ধার করে।
স্প্যানিশ ফুটবলের পতন
এর পরের গল্প টা আর সুখকর নয়। বেশ কিছু তারকা ফুটবলার অবসর নেয় দল থেকে। তাতেই যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ে পুরো দল। সেটা পুরোপুরি দৃষ্টিগোচর হয় ২০১৪ বিশ্বকাপে। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিতে হয় সেবার। প্রথম ম্যাচে আগের বিশ্বকাপের ফাইনালের প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডসের কাছে পরাজিত হয় ৫-১ গোলে। দ্বিতীয় ম্যাচে চিলির সাথে হারে ২-০ তে। সেই সাথে ছিটকে যায় বিশ্বকাপ থেকে। ফ্রান্স ও ইতালির পর তৃতীয় দল হিসেবে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে গ্রুপ পর্বেই ছিটকে যাওয়ার অপ্রীতিকর রেকর্ডে ভাগ বসায় স্পেন।
শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ২-০ গোলে জয় আসে। তবে সেটা শুধু সান্ত্বনা ছাড়া কিছুইনা।
পরের ইউরোতে কোনোরকমে শেষ ষোলতে জায়গা করে নেয়। কিন্তু সেখানে ইতালির কাছে পরাজিত হয় ২-০ গোলের ব্যবধানে। বিদায় নিতে হয় সেখান থেকেও।
ইতালির সেই সোনালি প্রজন্মের গল্প এখানেই শেষ। ক্যাসিয়াস-রামোস-পিকে-পুয়োল, আলোনসো-বুসকেটস-জাভি-ইনিয়েস্তা, ফ্যাব্রেগাস-তোরেস-ভিয়া দের নিয়ে গড়া সেই দলটাকে তর্কসাপেক্ষে ফুটবল ইতিহাসের সেরা দল বলে ধরা হয়।
সর্বজয়ী আরো অনেক দলই হয়তো বিশ্বফুটবল দেখেছে, ভবিষ্যতে আরো দেখবে। কিন্তু তাদের সেই চোখ জুড়ানো সুন্দর ফুটবল কি বিশ্ব দেখবে আর কখনো?
- 0 মন্তব্য