• ক্রিকেট

সম্রাটের চিঠি

পোস্টটি ২০১০ বার পঠিত হয়েছে
'আউটফিল্ড’ একটি কমিউনিটি ব্লগ। এখানে প্রকাশিত সব লেখা-মন্তব্য-ছবি-ভিডিও প্যাভিলিয়ন পাঠকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ উদ্যোগে করে থাকেন; তাই এসবের সম্পূর্ণ স্বত্ব এবং দায়দায়িত্ব লেখক ও মন্তব্য প্রকাশকারীর নিজের। কোনো ব্যবহারকারীর মতামত বা ছবি-ভিডিওর কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য প্যাভিলিয়ন কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। ব্লগের নীতিমালা ভঙ্গ হলেই কেবল সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।

ভদ্রলোক একসময় প্রবল প্রতাপশালী সম্রাট ছিলেন। বিশ্বজয়ী দলের সর্বাধিনায়ক ছিলেন তিনি, সম্মুখ সমরে লেলিয়ে দিতেন খুনে ও বন্য কয়েকজন, যারা প্রতিপক্ষ সংহারেই ক্ষান্তি দিত না, প্রতিদ্বন্দ্বীর বিশ্বাস মনোবল সমস্ত ধুমড়ে মুচড়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিত। ভয়ে কাঁপা, ডরে কাঁদা বলতে যা বোঝায় -- ভদ্রলোক ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা ঠিক সেই অনুভুতিই উপহার দিতেন। প্রতিপক্ষ শুরুর আগেই জানত, পরাজয়ই পরিণতি। তবে অপমান যতটা কমানো যায়!

 

সে বহুকাল আগের কথা। সেই লঙ্কাও নেই, নেই সেই লঙ্কা-অধিপতিও। সময়ের ফেরে সম্রাট বিদগ্ধ চিত্তে অবলোকন করেছেন সাম্রাজ্যের একটু একটু করে ক্ষয়, বিনাশ, বিলুপ্তি। চোখ ক্ষণে ক্ষণে ঝাপসা হয়ে আসে তাঁর। কঠিন হৃদয়ের লৌহ পুরুষ তিনি, অথচ অতীতের সোনালী স্মৃতি আর বর্তমানের ফ্যাকাশে চিত্র নিয়ে যখন ভাবতে বসেন বুকের ভেতর তখন উথাল-পাতাল ঢেউ উঠে। অস্থিরতা গ্রাস করে তাঁকে। রাজ-সিংহাসন ছেড়ে যাওয়ার পরও কর্তব্যের ডাকে নানা সময়ে নানা দায়িত্বে বসেছেন, চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের। কিন্তু সম্রাটের আসন অলঙ্কৃত করে যে কাজ সম্ভব, অসম্ভব প্রতিভাবান অনুগত সৈনিক নিয়ে যে অসাধ্য সাধন সম্ভব, তা আর কোনোভাবেই, কোনো ভূমিকাতেই যে সম্ভব নয়!

 

বয়সে দাঁত বসিয়েছে বার্ধক্য। ৭৬ চলছে। শরীরের কলকব্জায় ধরে গেছে জঙ, তবুও সাম্রাজ্যের করুণ অবস্থায় দিশেহারা বোধ করেন তিনি। ছেলেগুলোর প্রতি রাগ হয়, করুণা হয়, মায়া লাগে, বিরক্তি পায়। হতচ্ছাড়াগুলোর মস্তিষ্কে আজ-তক ক্যারিবিয়ানের মহান ঐক্য, ঐতিহ্য ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত হলো না। অবশ্য সব দোষ ওদেরও নয়, কাঁচা পয়সায় কার না মাথা বিগড়ে যায়।
তাঁরা বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলতে যায়, ক্যারিবিয়ানের হয়ে খেলতে যেতে জানায় অস্বীকৃতি। সাগর পাড়ের দিলখোলা ও অল্পে তুষ্ট ছেলেগুলোর এত আরো চাই মনোভাব হলো কীভাবে? বুঝতে পারেন না তিনি।

বাংলাদেশ সফরে অভিজ্ঞ অনেকেই পিছু হটেছে। ছোট ছোট ছেলেগুলো বাংলাদেশ গিয়েছে, এককালের দাপটে পরাশক্তি এখন 'মিনোজ' সেখানে। নিশ্চিত পরাজয়ই পরিণতি। জীবন সায়াহ্নে আবারো কর্তব্যের ডাক অনুভব করেন। ঝড়ের গতিতে চলে মস্তিষ্ক। খটখট, খসখস লিখে যান তাই--

 

আমার প্রিয় অনুজবৃন্ধ, শোনো!
আমি প্রবলভাবে তাড়িত হয়ে লিখতে বসেছি তোমাদের। কেন যেন মনে হলো তোমাদের অনভিজ্ঞ ও ভঙ্গুর কাঁধটায় শক্তি ও সাহস যোগাতে আমার কিছু বলা দরকার। হয়তো বাড়ির পাশের নদীতে সাঁতার কাটছিলে মনের আনন্দে, আচমকা তোমাকে বলা হলো অলিম্পিকে সাঁতার কাটতে হবে তোমার। কোনো প্রস্তুতিই ছিল না তোমাদের, জানি আমি। আবার একইসঙ্গে এটাও ভাবো, কী ভাগ্যবান তোমরা! তোমাদের সামনে সুযোগ এসেছে পতাকার প্রতিনিধি হওয়ার। এই সম্মান, এই সৌভাগ্য সবার হয় না। সবাই পায় না। সুযোগ কাজে লাগাও, বিশ্বকে দেখাও তোমার যোগ্যতা, নিজের জায়গাটা চিরস্থায়ী করে নাও, জানিয়ে দাও তুমি বা তোমরা পেছনের বেঞ্চির কেউ নয়, মিছিলের পেছন সারির কেউ নয়, তোমরা বরং প্রথম সারির ও প্রথম কাতারেরই উপযুক্ত।

 

আমার অভিষেকের গল্পটা বলি। ভারত সফরে গিয়েছি সেবার, বাইশ বছরের তরুণ তখন আমি, আমাকে একাদশে রাখা হয়নি। সোবার্স, গিবস, কানহাই, গ্রিফিথের মতো স্বপ্নপুরুষেরা আমার চারপাশে। ম্যাচ শুরুর ৪৫ মিনিট পূর্বে আমাকে জানানো হলো, ম্যাচ খেলব আমি। সেইমুর নার্স দুর্ভাগ্যবশত (আমার জন্য যদিও সৌভাগ্যবশত) ইঞ্জুরিতে পড়েছেন। সুযোগটা লুফে নিলাম দু'হাতে। ম্যাচে দুর্দান্ত খেললাম, জয়ও পেলাম আমরা। তারপর একটানা ৩৫টা ম্যাচ আমি খেলেছি, উঁহু, নিশ্চয় সেইমুর নার্স এতটা সময় ইঞ্জুরড ছিলেন না! আসলে আমাকে বাদ দেয়ার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি নির্বাচকমণ্ডলী। তোমাদেরও বলি, সুযোগ কাজে লাগাও। বিশ্বের সামনে মেলে ধরো নিজেকে। জেনে রেখো, ক্যারিবিয়ানের সবচেয়ে সম্মান ও গর্বের মুহূর্ত হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রতিনিধিত্ব করা। বাছা আমার, এই সম্মানকে বোঝার চেষ্টা করো!


অতি স্বল্প জনসংখ্যার দ্বীপাঞ্চল এই ক্যারিবিয়ান। অথচ আমাদের ক্রিকেটে ছিল গৌরবময় মহান অতীত। তোমার ব্লেজার, ক্যাপ সবটার জন্য গর্বিত হবে তুমি। একটানা ২৯টা টেস্ট হারিনি, জিতেছি টানা ১১টা টেস্ট। রেকর্ড ১৭ বছর আমরা কোনো টেস্ট সিরিজ পরাজিত হইনি। আমাদের আভিজাত্য ও বনেদিয়ানা বোঝার চেষ্ট করো। সেই কৌলিন্যের মহান উত্তরাধিকার যে বা যারা, তাদের কেমন হতে হবে বুঝতে পারছ তো?

 

কঠোর পরিশ্রম ও নিবেদন ছাড়া কিচ্ছু হয় না। আমাদের অপ্রতিরোধ্য ও বিশ্বজয়ের যে অর্জন, সেই যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে লেখা আছে কঠিন ও কঠোর পরিশ্রম। অপরাজেয় মনোভাব। হাল না ছাড়া মানসিকতা। নিজেদের সর্বোচ্চ উচ্চতায় প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা, মেধা ও দক্ষতার সুনিপুণ সমন্বয় ঘটিয়ে তুমি হবে দুর্বার। তোমরা হবে দুর্জয়। আমি ও আমার দল ঠিক এইভাবেই ছুঁয়েছিলাম শিখর উচ্চতা। আমার বিশ্বাস এবং আমি খুব আত্মবিশ্বাসীও যে তোমরাও এমনি করে বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের দখল নেবে।

 

বাংলাদেশ সফর নিশ্চয় সহজ নয়, আবার খুব যে কঠিন হবে তেমনটাও নয়। ক্রেইগ ব্রাথওয়েইটের কুশলী নেতৃত্বের সঙ্গে যদি তোমাদের দৃঢ়তা, পেশাদারিত্ব, তারুণ্য ও জেদের সমন্বয় ঘটে, তাহলে আমি নিশ্চিত ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের এক নবযুগের পুনরুত্থান ঘটবে। আমি তোমাদের যা বলেছি বা বলতে চেয়েছি, তা খুব যে চিন্তাভাবনা প্রসূত তেমন দাবী করছি না, তবে আমার এত বছরের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান তোমাদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। তোমাদের আরো একটা ব্যাপার বলি, আমি যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের দায়িত্ব নিই, তখন দলটি ভঙ্গুর ও তলানীর। কুড়িটির বেশি টেস্টে হেরেছিলাম সেসময়, তারপর নতুনভাবে দলটাকে গড়ে তোলা হলো। আমার দল কখনোই পেছোতে জানত না, সম্মুখের যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ছিল সাহসী ও অগ্রসর। হ্যাঁ, আমার দলে অদম্য কিছু সদস্যের সন্নিবেশ ঘটেছিল, আমার ধারণা তোমাদের দলেও আছে তেমন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস -- তোমরা ঠিক ঠিক ঘুরে দাঁড়াবে। রচনা করবে নতুন ইতিহাস। তবে এই সামর্থ্য ও সক্ষমতার বিশ্বাস নিজেদের মধ্যেও থাকতে হবে, আমি যদি বিশ্বাসই না করি যে আমার পক্ষে দৌড়ানো সম্ভব, তাহলে হাঁটবোই-বা কী করে? আমাদের সেই দলটার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছিল টইটম্বুর, আমি বিশ্বাস করি তোমাদের মধ্যেও তা আছে। জানোই তো, আত্মবিশ্বাসই হচ্ছে সফলতার প্রথম সোপান।

 

তোমাদের পুরনো একটা প্রবাদ বাক্য স্মরণ করিয়ে দিই। 'In order to gain altitude, you must have the right attitude', তুমি যদি সুউচ্চ উচ্চতায় পৌছতে বদ্ধপরিকর হও, তাহলে অবশ্যই সেই উচ্চতার সঙ্গে মানানসই মনোভাব লালন করতে হবে। এই সফরেই হয়তো অনেক কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি হতে হবে, ইতিবাচক মানসিকতা যদি ধারণ করো তাহলে সেইসব কঠিন বাঁধা তোমাদের জন্য উতরানো সহজ হবে। মনে রাখবে, মানুষকে সাধারণত বিচার করা হয় তার বাঁধা অতিক্রমের সক্ষমতা ও যোগ্যতার মাধ্যমে। আমার বিশ্বাস, তোমাদের মধ্যে সেই যোগ্যতা ও সক্ষমতা আছে। বাঁধার পাহাড় পাড়ি দিয়ে এখন তা প্রমাণ করার পালা। আরো একটা কথা গেঁথে নাও মাথায়, সাফল্য (SUCCESS) কেবলমাত্র অভিধানেই কাজ (WORK)-এর আগে বসে, জীবনযুদ্ধে কাজকে আগে বসিয়ে সাফল্যকে বুকে পেতে হয়। সফলতা তোমাদের পদতলে চুম্বন করুক, এই প্রত্যাশা। শুভকামনা তোমাদের জন্য।

 

ইতি
লয়েড

 

ভদ্রলোকের জীবন-সূর্যে গোধূলির আনাগোণা। অথচ চোখে এখনো স্বপ্নের মিঠে রোদ। তিনি বিশ্বাস করেন, আবার ফিরবে সোনালী অতীত। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট আবার মাথা উঁচু করে বাঁচবে। বিশ্বক্রিকেটের নমস্য গ্রহন করবে ত্রাস ছড়িয়ে, প্রতিপক্ষের সশ্রদ্ধ অভিবাদনে সিক্ত হবে আবার। তিনি দেখে যেতে পারবেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের আরেকজন অবিসংবাদিত সম্রাট, তাঁর গৌরবোজ্জ্বল  উত্তরাধিকার।

 

পুনশ্চ : ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট কর্তার নির্দেশে ভদ্রলোকের এই খোলা-চিঠি পৌছানো হয়েছে বাংলাদেশ সফররত প্রত্যেকজন উইন্ডিজ ক্রিকেটারের কাছে। কতটা আঁচড় কেটেছে তাদের, তা-ই এখন দেখার অপেক্ষা।